ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় অনাহার ও অপুষ্টিতে ভুগে গত শনিবার ১৭ বছর বয়সী এক কিশোর মারা গেছে। আগে তার কোনো অসুস্থতা ছিল না। কিন্তু খাবারের অভাবে ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে সে মারা যায়। কিশোরের স্বজনেরা ও চিকিৎসাকর্মীরা এমনটাই বলেছেন। ইসরাইলের অবরোধের কারণে গাজা উপত্যকার মানুষ তীব্র সংকটে আছে। সেখানকার মানুষ এখন খাবারের জন্য মরিয়া। ইসরাইল সেখানে ত্রাণ পৌঁছাতে দিচ্ছে না। গত শনিবার মারা যাওয়া ওই কিশোরের নাম আতেফ আবু খাতের। গাজা শহরের আল-শিফা হাসপাতালের একটি সূত্র আল জাজিরাকে তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে। এক্সে, আল জাজিরা
গাজায় জিএইচএফ পরিচালিত ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে খাবার নিতে আসা ফিলিস্তিনীদের লক্ষ্য করে নিয়মিত গুলী চালাচ্ছে ইসরাইলী সেনারা। জাতিসংঘ চলতি সপ্তাহে বলেছে, গত মে মাসে এই সংস্থার কার্যক্রম শুরু করার পর থেকে এক হাজার তিন শতাধিক ত্রাণপ্রত্যাশী নিহত হয়েছে। আল-জাজিরার গাজা প্রতিনিধি হানি মাহমুদ বলেন, আতেফ স্থানীয়ভাবে খেলাধুলায় চ্যাম্পিয়ন ছিল। কিন্তু খাবার খেতে না পারায় তার ওজন কমে যায়। প্রচণ্ড অপুষ্টিতে ভোগার পর অবশেষে সে মারা যায়। হানি আরও বলেন, আতেফ গাজায় তীব্র অপুষ্টির শিকার হাজার হাজার মানুষের একজন মাত্র।
আল জাজিরার যাচাই করা একটি ভিডিওতে দেখা যায়, আতেফের পরিবার তাকে শেষ বিদায় জানাচ্ছে। সেখানে তার শীর্ণকায় লাশ দেখা যাচ্ছে। তার মুখ ক্যামেরা থেকে আড়াল রাখা হয়েছে। আতেফ আবু খাতেরের পরিবার বলেছে, মৃত্যুর সময় তার ওজন কমে মাত্র ২৫ কেজি হয়েছিল। আগে তার ওজন ছিল ৭০ কেজি। ২৫ কেজি ওজন সাধারণত নয় বছর বয়সী শিশুদের হয়ে থাকে। আতেফের গালে একটুও চর্বি ছিল না। মুখমণ্ডলের হাড়গুলো স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছিল।
ভিডিওতে দেখা যায়, আতেফের এক আত্মীয় তার পাঁজরের প্রতিটি হাড় আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখাচ্ছিলেন। তার পাঁজরের হাড়গুলো যেন গোনা যাচ্ছিল। উইসাম শাবাত নামের এক সাংবাদিক ভিডিওটি নিজের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে শেয়ার করেছেন। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন না খেতে পেরে এবং চিকিৎসার অভাবে আতেফের শরীরে মারাত্মক জটিলতা দেখা দিয়েছিল। আতেফ যখন হাসপাতালে আসে, তখন তার অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন ছিল। শেষ পর্যন্ত সে মারা যায়। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরাইলী হামলা শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ১৬৯ জন ফিলিস্তিনী অনাহারে বা অপুষ্টিতে ভুগে মারা গেছে। এর মধ্যে ৯৩ জনই শিশু।
জাতিসংঘ ও অন্যান্য মানবিক সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, সাম্প্রতিক দিনগুলোয় গাজায় ত্রাণ সরবরাহের ওপর ইসরাইলী বিধিনিষেধ কিছুটা শিথিল করা হলেও ফিলিস্তিনীরা পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছে না। তাদের পরিবারের জন্য খাবার জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মহলের ব্যাপক সমালোচনার মুখে ইসরাইল বলেছে, তারা ফিলিস্তিনীদের জন্য ত্রাণসহায়তা বাড়াচ্ছে। এর মধ্যে উড়োজাহাজ থেকে নিচে খাবার ফেলার মতো ব্যবস্থাও আছে। তবে মানবিক সহায়তা সংস্থাগুলো বলছে, এ ধরনের সহায়তা ঝুঁকিপূর্ণ ও অকার্যকর। তাদের দাবি, গাজার সব সীমান্ত ক্রসিং খুলে দেওয়া হোক, যেন প্রয়োজনীয় সহায়তা অবাধ প্রবেশ করতে পারে। জাতিসংঘের ফিলিস্তিনী শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএর প্রধান ফিলিপ লাজারিনি শনিবার বলেন, ‘গাজায় যে মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ চলছে, তা মূলত জাতিসংঘের ত্রাণ কার্যক্রমকে সরিয়ে দিয়ে তার জায়গায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল সমর্থিত বিতর্কিত সংস্থা জিএইচএফকে প্রতিষ্ঠিত করার ইচ্ছাকৃত প্রচেষ্টার ফল।’ গাজায় জিএইচএফ পরিচালিত ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে খাবার নিতে আসা ফিলিস্তিনীদের লক্ষ্য করে নিয়মিত গুলী চালাচ্ছে ইসরাইলী সেনারা। জাতিসংঘ চলতি সপ্তাহে বলেছে, মে মাসে এই সংস্থার কার্যক্রম শুরু করার পর থেকে এক হাজার তিন শতাধিক ত্রাণপ্রত্যাশী নিহত হয়েছে।
শিশুরা ধুঁকে ধুঁকে মরছে : এদিকে গাজার হাজার হাজার ফিলিস্তিনী পরিবার মরিয়া হয়ে খাবার ও অন্যান্য জরুরি জিনিস খুঁজে বেড়াচ্ছে। গতকাল গাজার মধ্যাঞ্চলীয় দেইর আল-বালাহ থেকে আল-জাজিরার সংবাদকর্মী হিন্দ খৌদারি বলেন, ইসরাইল সৃষ্ট খাদ্যসংকটের কারণে শিশুসহ অনেক মানুষ ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তেমনই একজন মিস্ক আল-মাধুন। অপুষ্টিতে ভোগা পাঁচ বছর বয়সী শিশুটিকে খাওয়ানোর মতো কোনো কিছুই তাদের কাছে নেই। তারা বলছেন, প্রতিদিন চোখের সামনে তারা তাদের মেয়েটিকে ধুঁকে ধুঁকে মরতে দেখছেন। মা-বাবারা তাদের সন্তানদের বাঁচাতে যা যা করা সম্ভব, সবই করছেন বলে উল্লেখ করেন খৌদারি। খৌদারি বলেন, ‘আমরা এমন অনেক মায়ের সঙ্গে কথা বলেছি, যাঁরা দুধ না পেয়ে বাধ্য হয়ে শিশুদের শুধু পানি খাওয়াচ্ছেন। কারণ, তাদের হাতে আর কোনো বিকল্প নেই। আমরা আরও দেখছি, ফিলিস্তিনী মা-বাবারা প্রতিদিন প্রচণ্ড গরমে দীর্ঘ পথ হেঁটে রান্না করা খাবার বা ত্রাণ বিতরণকেন্দ্র খুঁজে ফিরছেন। এমনকি কেউ কেউ জিএইচএফের ত্রাণকেন্দ্রগুলোতেও যাচ্ছেন। সেখানে তারা মৃত্যুর ঝুঁকিতে থাকেন, আহত হন কিংবা খালি হাতেই বাড়ি ফেরেন।
গত মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক ক্ষুধাবিষয়ক পর্যবেক্ষণ সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্ল্যাসিফিকেশন (আইপিসি) বলেছে, গাজায় দুর্ভিক্ষের সবচেয়ে ভয়াবহ চিত্র উন্মোচিত হচ্ছে। সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজার বেশির ভাগ এলাকায় মানুষ এত কম খাবার পাচ্ছে যে তা এখন দুর্ভিক্ষের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়, অবিরাম সংঘর্ষ, গণহারে বাস্তুচ্যুতি, মানবিক সহায়তা প্রবেশে কঠোর বাধা, স্বাস্থ্যসেবাসহ প্রয়োজনীয় সব পরিষেবায় ধস নামার কারণে এই সংকট এখন এক ভয়ংকর ও প্রাণঘাতী পর্যায়ে পৌঁছেছে।