অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, শুক্রবার যেসব শিশুকে হাসপাতালে আনা হয়েছে তাদের অনেকের শরীরেই মারাত্মক দগ্ধ হওয়া ও ধাতব বস্তুর আঘাতে জখম স্পষ্ট। ইহুদিবাদী ইসরাইলী বাহিনীর পেরেক ভর্তি ড্রোন মিসাইল হামলায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে বলে জানা গেছে। চিকিৎসকার তাদের বাঁচানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই ড্রোন মিসাইলগুলোর ভেতরে ঠেসে ভরা থাকে অসংখ্য পেরেক। বিস্ফোরণের সময় সেগুলো দ্রুতগতিতে ছুটে গিয়ে শরীর ভেদ করে ভেতরে ঢুকে যায়। আল-জাজিরা, বিবিসি, আনাদোলু।
এতে অভ্যন্তরীণ রক্তপাত শুরু হয়, যা অধিকাংশ মৃত্যুর প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত প্রায় ৪০ দিন ধরে ড্রোন হামলার পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়েছে ইহুদিবাদী ইসরাইলী বাহিনী। এসব হামলা জনবহুল এলাকায় চালানো হচ্ছে— বাজারের রাস্তা, পানি সংগ্রহের লাইনে দাঁড়ানো লোকজন কিংবা কমিউনিটি কিচেন থেকে খাবার নেওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ সাধারণ মানুষ— সবাই তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছে। বর্বর ইসরাইলী সেনাবাহিনী অত্যাধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর অস্ত্র ব্যবহারের দাবি করলেও বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন কথা বলছে। যেসব এলাকা লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে এবং হতাহতের সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে, তা ইসরাইলী বাহিনীর প্রচারের বিপরীত চিত্র উপস্থাপন করছে।
গাজার হৃদয়ে ধ্বংসের রাজনীতি : ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরাইলী সেনাবাহিনী হাজার হাজার বেসামরিক ভবন পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করছে বলে চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে স্যাটেলাইট চিত্র, যাচাই করা ভিডিও ফুটেজ ও মানবাধিকার বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণে। মার্চ মাসে হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি প্রত্যাহারের পর থেকে এই ধ্বংসযজ্ঞ চলছে বলে জানিয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যাচ্ছে, গাজার বহু শহর ও উপশহরের অধিকাংশই এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এসব এলাকায় একসময় হাজার হাজার মানুষের বসবাস ছিল। ইসরাইল দাবি করছে, এই এলাকাগুলো বর্তমানে তাদের ‘অপারেশনাল নিয়ন্ত্রণে’ রয়েছে। বিশাল বিস্ফোরণের মাধ্যমে ভবন ধসে পড়ছে, বাতাসে উড়ছে ধুলো ও ধ্বংসাবশেষ। শুধু যে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলো ধ্বংস করা হচ্ছে, তা নয় বরং অক্ষত ভবনগুলোকেও ইচ্ছা করে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই তালিকায় রয়েছে গাজার স্কুল, হাসপাতাল, টাওয়ার ব্লক, এমনকি শিশুদের জন্য পরিচালিত আশ্রয়কেন্দ্রও।
রাফাহ শহরের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত টেল আল-সুলতান এলাকায় অবস্থিত একমাত্র মাতৃসদন হাসপাতাল ও অনাথ শিশুদের যত্নকেন্দ্রসহ প্রায় সব অবকাঠামো ধ্বংস করা হয়েছে। স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে, এই এলাকার অধিকাংশ ভবন আগে থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত ছিল। তবে জুলাইয়ের মাঝামাঝি নাগাদ পুরো এলাকা মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। কেবল একটি হাসপাতাল এখনো টিকে আছে। এছাড়া রাফাহ’র সৌদিপাড়াসহ আশপাশের এলাকায় ইসরাইলী বুলডোজার ও ট্যাংকের উপস্থিতি দেখা গেছে। ভিডিওতে ধরা পড়েছে, রাস্তার পাশে খননযন্ত্র দিয়ে ভবন গুঁড়িয়ে দিচ্ছে ইসরাইলী সেনারা।
টেল আল-সুলতান এলাকার বাসিন্দা মুয়াতাজ ইউসুফ আহমেদ আল-আবসি বলেন, যুদ্ধ শুরুর মাত্র এক বছর আগে আমি আমার নতুন ঘরে উঠেছিলাম। ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। এখন আমার সেই ঘর নেই, কোনো আশ্রয়ও নেই। গাজা সীমান্ত থেকে মাত্র ১ দশমিক ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কৃষিনির্ভর শহর খুজা’আতেও ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে। টমেটো, গম ও জলপাই চাষের জন্য বিখ্যাত এই শহরের ১২০০টিরও বেশি ভবন গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ইসরাইলী বাহিনীর দাবি, ধ্বংস করা ভবনগুলো ‘সন্ত্রাসী অবকাঠামো’র অংশ। পাশের শহর আবাসান আল-কবিরা, যেখানে যুদ্ধের আগে প্রায় ২৭ হাজার মানুষের বাস ছিল, সেখানেও মে ও জুলাইয়ের মধ্যে মাত্র ৩৮ দিনে একটি বিশাল এলাকা ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে।
নিরাপত্তা করিডোর ও বাফার জোন তৈরির অভিযোগ : ইসরাইল গাজার বিভিন্ন অংশকে বিভক্ত করে নিরাপত্তা করিডোর তৈরি করছে, আর এসব করিডোর বরাবর ভবন গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস এলাকায় পূর্ব ও পশ্চিম অংশকে আলাদা করতে এক বিশাল করিডোর নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া কিজান আবু রাশওয়ান নামক একটি গ্রামে, যা ইসরাইলী সীমান্ত থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে- ১৭ মে’র পর থেকে প্রায় সব ভবন ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। এক ভিডিওতে দেখা গেছে, একত্রে থাকা বেশ কয়েকটি টাওয়ার ব্লক একযোগে বিস্ফোরণের মাধ্যমে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
ইসরাইলের অবস্থান ও আন্তর্জাতিক আইনের প্রশ্ন : ইসরাইলী প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) বিবিসির প্রশ্নের উত্তরে জানায়, তারা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কাজ করছে ও হামাস মূলত বেসামরিক এলাকায় তাদের সামরিক স্থাপনা গোপন করে রাখে। সেনাবাহিনী কেবল তখনই ভবন ধ্বংস করে, যখন তা সামরিক প্রয়োজনে একান্ত জরুরি হয়ে ওঠে। তবে মানবাধিকার আইনজীবীরা বলছেন, ইসরাইলের এই ধ্বংসযজ্ঞ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও বিশেষ করে চতুর্থ জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে। জেরুজালেমভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবিক আইন সংস্থা ডায়াকোনিয়ার সিনিয়র আইনি বিশ্লেষক ইইতান ডায়মন্ড বলেন, আবশ্যিক সামরিক প্রয়োজন ছাড়া এ ধরনের পরিকল্পিত ধ্বংস আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থি। ভবিষ্যতে ব্যবহার হতে পারে- এই আশঙ্কায় কোনো স্থাপনা ধ্বংস করা আইনত বৈধ নয়।
‘মানবিক শহর’ না ‘ঘেটো’? : ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাটজ রাফাহ শহরের ধ্বংসাবশেষের ওপর ছয় লাখ ফিলিস্তিনীকে স্থানান্তর করে একটি তথাকথিত ‘মানবিক শহর’ গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট এই পরিকল্পনাকে ‘একটি ঘেটোর মতো’ আখ্যা দিয়ে তীব্র সমালোচনা করেছেন। ‘ঘেটো’ শব্দটি সাধারণত শহরের এমন একটি এলাকাকে বোঝায় যেখানে কোনো একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ, বিশেষ করে সামাজিক, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক কারণে একত্র বসবাস করে। এটি প্রায়শই দরিদ্র এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হয়।
ধ্বংস যেন শেষ হচ্ছে না : সম্প্রতি ইসরাইলী মিডিয়া জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে নতুন করে ডজনখানেক ডি-৯ বুলডোজার ইসরাইল সেনাবাহিনীর হাতে পৌঁছেছে, যা আগে বাইডেন প্রশাসনের অধীনে স্থগিত ছিল। সেইসঙ্গে মে মাস থেকে ইসরাইলী ফেসবুক গ্রুপগুলোতে গাজার বিভিন্ন অঞ্চলে ভবন ভাঙার জন্য কন্ট্রাক্টর নিয়োগের বিজ্ঞাপনও লক্ষ্য করা গেছে। এ বিষয়ে একজন নিয়োগকারীর মন্তব্য চাইলে তিনি কটূ ভাষায় উত্তর দেন, তোমরা আর গাজা- দুজনই ধ্বংস হও।
ইসরাইলী হামলায় একদিনে প্রাণ হারালেন ৯৪ ফিলিস্তিনী : গাজায় চলমান ইসরাইলী হামলায় সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টার তথ্য অনুযায়ী অন্তত ৯৪ জন নিহত এবং সাড়ে তিনশ জন আহত হয়েছেন। ফলে, অবরুদ্ধ উপত্যকাটিতে মৃতের সংখ্যা ৫৮ হাজার ৭০০ জনের কাছে পৌঁছালো। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় গাজা জুড়ে ইসরাইলী বাহিনীর হামলায় ৯৪ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এই একই সময় হামলায় আরও ৩৬৭ জন ফিলিস্তিনী আহত হয়েছেন। এতে মোট আহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় এক লাখ ৩৯ হাজার ৯৭৪ জনে। ওই বিবৃতিতে আরও জানানো হয়, হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন ভবনের ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনও অনেক মানুষ আটকা পড়ে আছেন। উদ্ধারকর্মীরা তাদের কাছে পৌঁছাতে পারছেন না বলে হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এদিকে, ত্রাণ নিতে গিয়ে ইসরাইলী সেনাবাহিনীর গুলিতে ২৬ জন ফিলিস্তিনী নিহত হয়েছেন এবং ৩২ জনের বেশি আহত হয়েছেন। গত ২৭ মে থেকে এখন পর্যন্ত এই ধরনের ঘটনায় মোট ৮৭৭ জন প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত পাঁচ হাজার ৬৬৬ জন।