মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গাজায় বোমা হামলা বন্ধ করতে নেতানিয়াহু সরকারের প্রতি আহ্বান জানানোর পরও ইসরাইলী হামলায় এখন পর্যন্ত অন্তত ১০০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এদিকে, ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের অংশ হিসেবে সব বন্দি মুক্তির বিষয়ে গত শুক্রবার সম্মতি জানিয়েছে হামাস। তা সত্ত্বেও গাজায় ইসরাইলী বোমাবর্ষণ থামছে না। বিবিসি, আল জাজিরা, সিএনএন।
মিশরে গত সোমবার থেকে নতুন যুদ্ধবিরতি আলোচনা শুরু হয়েছে। তবু গাজা উপত্যকা জুড়ে বোমাবর্ষণের পাশাপাশি যেখানে আবাসিক এলাকা, শরণার্থী শিবির এবং ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রগুলোতে হামলার খবর পাওয়া গেছে। গাজা সিটির বাসিন্দারা জানান, আল-জাল্লা এলাকা ও আশপাশের এলাকায় দূরনিয়ন্ত্রিত যান থেকে বিস্ফোরক ব্যারেল ফেলে ঘরবাড়ি লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে।
গাজাভিত্তিক সরকারি গণমাধ্যম কার্যালয় জানায়, শনিবার ও রবিবার অন্তত ৯৪ জন নিহত হয়েছেন। স্থানীয় গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, সোমবার সকালেও আরো সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। ওই কার্যালয় আরো জানায়, সপ্তাহান্তে ইসরাইলী বাহিনী গাজা উপত্যকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোতে ১৩১টি বিমান ও গোলাবর্ষণ অভিযান চালায়।
গাজায় চলমান ইসরাইলী আগ্রাসনে এখন পর্যন্ত অন্তত ৬৭ হাজার ১৬০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, ১ লাখ ৬৯ হাজার ৬৭৯ জন আহত হয়েছেন এবং খাদ্য ও আশ্রয়ের তীব্র সংকটে পড়েছেন দুই মিলিয়নেরও বেশি মানুষ।
যুদ্ধবিরতি আলোচনা শুরুর দিনও গাজায় হামলা, নিহত ১০
মিশরের পর্যটন শহর শারম এল শেখ-এ চলমান যুদ্ধবিরতি আলোচনার সত্ত্বেও ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইলী বাহিনী। তবে তা ‘সীমিত’ আকারে।
সূত্রের বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, গত সোমাবর সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গাজায় ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) গুলীতে নিহত হয়েছেন ১০ জন। এদের মধ্যে ৩ জন নিহত হয়েছেন খাদ্য ও ত্রাণ নিতে গিয়ে।
গত সপ্তাহে গাজায় যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত নতুন একটি পরিকল্পনা পেশ করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্প এই পরিকল্পনা পেশের পরপরই সেটিকে সমর্থন জানায় ইসরাইল। পরে ৩ অক্টোবর সেই প্রস্তাবে সম্মতি জানায় গাজা উপত্যকা নিয়ন্ত্রণকারী গোষ্ঠী হামাসও।
উভয়পক্ষ সম্মতি জানানোর পর ৪ অক্টোবর গাজায় ইসরাইলী বাহিনী গাজায় হামলা-বোমাবর্ষণ বন্ধ করতে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে আহ্বান জানান ট্রাম্প। নেতানিয়াহু সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে এক বিবৃতিতে নেতানিয়াহু বলেন, গাজায় হামলা বন্ধ করতে আইডিএফকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু গাজার সূত্রের বরাতে জানা গেছে, ট্রাম্প হামলা-বোমাবর্ষণের নির্দেশ প্রদানের পরেও গাজায় গত তিন দিনে নিহত হয়েছেন ১০৪ জন। এদের সবাই নিহত হয়েছেন ইসরাইলী সেনাদের গুলীতে।
ইসরাইলের সরকারের মুখপাত্র শোশ বেদ্রোসিয়ান অবশ্য রোববার এক ব্রিফিংয়ে ইসরাইলী বাহিনীর হামলা-হত্যার সাফাই দিয়ে বলেছেন, ট্রাম্প আহ্বান জানানোর পর থেকে গাজায় ‘রক্ষণাত্মক’ অভিযান পরিচালনা করছে ইসরাইল।
ফ্লোটিলার ১৩০ জনকে জর্ডানে পাঠাল ইসরাইল
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ত্রাণ নিয়ে যাওয়া গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার আরও ১৩০ জনকে ছেড়ে দিয়েছে দখলদার ইসরাইল। তাদের জর্ডানের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার এ তথ্য জানিয়েছে জর্দানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এই ১৩০ জনের মধ্যে বাহরাইন, তিউনিশিয়া, আলজেরিয়া, ওমান, কুয়েত, লিবিয়া, পাকিস্তান, তুরস্ক, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কলম্বিয়া, চেক রিপাবলিক, জাপান, মেক্সিকো, নিউজিল্যান্ড, সার্বিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং উরুগুয়ের নাগরিক রয়েছেন।
জর্দানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম পেত্রা নিউজ জানিয়েছে, দেশটির পররাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ইসরাইল থেকে ১৩০ অধিকারকর্মীকে গ্রহণ ও তাদের প্রয়োজনীয় সেবা দিয়েছে।
৪২টি জাহাজে করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৫০০ অধিকারকর্মী ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার দিকে রওনা দিয়েছিলেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল গাজায় ইসরাইলের অবৈধ নৌ অবরোধ ভাঙা ও সেখানকার মানুষের কাছে ত্রাণ পৌছে দেওয়া।
তবে গত সপ্তাহে আন্তর্জাতিক জলসীমা থেকে সবগুলো জাহাজ আটক করে দখলদার ইসরাইল। জাহাজগুলোতে থাকা অধিকারকর্মীদের আসোদ বন্দরে নিয়ে যায় ইসরাইলী নৌ কমান্ডোরা।
জর্ডানে ১৩০ জনকে পাঠানোর আগে আরও কয়েকশ অধিকারকর্মীকে তুরস্ক ও ইতালিতে পাঠিয়েছে ইসরাইল।
ইসরাইলের হাতে আটক এসব অধিকারকর্মী জানিয়েছেন, জাহাজ থেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। এমনকি বিশ্বব্যাপী পরিচিত পরিবেশবাদী গ্রেটা থুনবার্গকেও ছাড়েনি দখলদাররা। তারা তাকে জোরপূর্বক ইসরাইলী পতাকা গায়ে জড়িয়ে ছবি তুলেছে। এছাড়া গ্রেটাকে পর্যাপ্ত খাবার ও পানিও দেয়নি তারা।
মিশরে হামাস-ইসরাইলের প্রতিনিধিরা
গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে প্রথম দফার আলোচনা ‘ইতিবাচক’
গাজা যুদ্ধবিরতি নিয়ে হামাস ও মধ্যস্থতাকারীদের মধ্যে অনুষ্ঠিত প্রথম দফার আলোচনা ‘ইতিবাচক’ পরিবেশে শেষ হয়েছে।
মিশরের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন টেলিভিশন আল-কাহেরার প্রতিবেদনের বরাতে আল জাজিরার খবরে বলা হয়েছে, গত সোমবার মিশরের শার্ম আল-শেখ শহরে এ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে হামাসের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মধ্যস্থতাকারীরা বৈঠকে বসেন। মধ্যস্থতাকারী হিসেবে মিসর, কাতার ও যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে এই আলোচনা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজা আলোচনার প্রথম দিন ‘ইতিবাচক পরিবেশে’ শেষ হয়েছে। মঙ্গলবারও এই আলোচনা অব্যাহত থাকবে।
শার্ম আল-শেখে অনুষ্ঠিত আলোচনায় অংশ নিতে সোমবারই ইসরাইলী একটি প্রতিনিধি দল পৌঁছেছে বলে জানা গেছে। তবে আলোচনার অগ্রগতি বা সম্ভাব্য সমঝোতার বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি।
এই আলোচনাকে ফিলিস্তিনের গাজায় চলমান গণহত্যা বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, মিসরে তার প্রস্তাবিত গাজা যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনা নিয়ে চলমান আলোচনায় হামাস বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সম্মতি দিচ্ছে। খবর- সিএনএন
সোমবার ওভাল অফিসে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ট্রাম্প বলেন, হামাস বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সম্মত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ‘ রেড লাইন’ বা সীমারেখা আছে কি না; যেমন- হামাসকে নিরস্ত্র করার দাবি, এমন প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প বলেন, যদি কিছু শর্ত পূরণ না হয়, তাহলে আমরা তা করবো না। তবে আমার মনে হয়, আমরা বেশ ভালো অগ্রগতি করছি।
ট্রাম্প আরও বলেন, এটা এমন এক চুক্তি যেখানে সবাই অবিশ্বাস্যভাবে একসঙ্গে এসেছে। আমি সত্যিই মনে করি আমরা এই চুক্তিটি সম্পন্ন করতে পারবো।
বিবিসির এক খবরে বলা হয়, আলোচনার প্রধান লক্ষ্য মাঠ পর্যায়ে উপযুক্ত পরিস্থিতি তৈরি করা; যাতে বন্দি ও জিম্মি বিনিময় চুক্তি সম্ভব হয়। চুক্তিতে পৌঁছালে গাজায় বন্দি ইসরাইলী সব জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া হবে। এই জিম্মিদের বিনিময়ে ইসরাইলের কারাগারে বন্দি নির্দিষ্ট সংখ্যক ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেবে ইসরাইল।
মিশরে ইসরাইল ও হামাসের প্রথম দিনের আলোচনায় কী হলো
আল-জাজিরা, রয়টার্স : মিশরে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসের মধ্যে নতুন করে শুরু হওয়া পরোক্ষ আলোচনার প্রথম দিনটি ভালোভাবে শেষ হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সূত্র ও অন্যান্য গণমাধ্যমকে বলেছে, গাজায় যুদ্ধ অবসানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০ দফা পরিকল্পনা নিয়ে সমঝোতার আশা দেখা দিয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার ও আলোচনা অব্যাহত রাখার সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।
আলোচনায় অংশ নেওয়া হামাসের প্রতিনিধিদলে ছিলেন সংগঠনটির দুই নেতা খলিল আল-হায়া ও জাহের জাবারিন। এ দুই আলোচক গত মাসে দোহায় ইসরাইলের হামলা থেকে বেঁচে যান। ওই হামলায় পাঁচজন নিহত হন।
মিসরের সংবাদমাধ্যম আল-কাহেরা নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রথম দিনের আলোচনায় বন্দিবিনিময়, যুদ্ধবিরতি ও গাজায় মানবিক সহায়তা নিয়ে কথা হয়েছে।
হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট বলেন, ট্রাম্প দ্রুত ইসরাইলী ও ফিলিস্তিনি বন্দিবিনিময়ের প্রক্রিয়াটি শেষ করতে চাইছেন। এর মধ্য দিয়ে গাজায় যুদ্ধ অবসানে তাঁর পরিকল্পনার অন্য অংশগুলো বাস্তবায়নের কাজে গতি আনতে চান তিনি।
ট্রাম্প গতকাল বিকেলে ওভাল অফিসে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘আমাদের চুক্তি করার ভালো সুযোগ আছে।’ তবে তাঁর মতে, কিছু বিষয় নিয়ে সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, ‘কিন্তু আমি মনে করি, আমরা ভালো করছি। হামাস এমন কিছু বিষয়ে সম্মত হয়েছে, যা খুব গুরুত্বপূর্ণ।’
হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট বলেছেন, ট্রাম্প দ্রুত ইসরাইলী ও ফিলিস্তিনি বন্দিবিনিময়ের প্রক্রিয়াটি শেষ করতে চাইছেন। এর মধ্য দিয়ে গাজায় যুদ্ধ অবসানে তাঁর পরিকল্পনার অন্য অংশগুলো বাস্তবায়নের কাজে গতি আনতে চান তিনি।
ওয়াশিংটন ডিসি থেকে আল–জাজিরার প্রতিনিধি রোজিল্যান্ড জর্ডান বলেন, আলোচনার বিস্তারিত কীভাবে এগোচ্ছে, সেটি ট্রাম্প বলেননি। কেবল সাধারণ ইতিবাচক মূল্যায়ন দিয়েছেন।
জর্ডান আরও বলেন, ‘মার্কিন প্রেসিডেন্ট হামাসকে আলোচনায় রাখার জন্য যৌথ আরব-তুর্কি সমর্থনের প্রশংসা করেছেন, তিনি ইসরাইলের জনগণকে প্রশংসা করেছেন এবং অবশ্যই তাঁর নিজস্ব বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফকে প্রশংসা করেছেন, যিনি এই আলোচনায় মার্কিন প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।’