রয়টার্স : বিশ্বের যেকোনো দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তির মধ্যে জ্বালানি তেল অন্যতম। গুরুত্বপূর্ণ এই প্রাকৃতিক সম্পদের জোরে কোনো দেশের জিডিপি তরতরিয়ে বাড়তে পারে, আবার প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে এই জ্বালানি তেলই হয়ে ওঠে বড় অস্ত্র।
তবে জ্বালানি তেল সমৃদ্ধ হলেই একটি দেশ অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে, এমনটা ভাবার সুযোগ নেই। কারণ, খনিজ সম্পদ হিসেবে তেলের মজুত থাকা, সেই তেল উত্তোলনের সক্ষমতা এবং বিশ্ববাজারে বিক্রির সুযোগ পাওয়া এক কথা নয়। যেমনÍবিশ্বে সবচেয়ে বেশি তেল মজুত আছে ভেনেজুয়েলায়। তারপরও প্রায় এক দশক ধরে দেশটির অর্থনীতি সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে।
রাশিয়াও জ্বালানি তেলের মজুতে শীর্ষ দেশগুলোর একটি। তাদের সেই তেলকে ব্যবহার করে ট্রাম্প রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে চাপে ফেলতে চাইছেন। রাশিয়া বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ তেল উত্তোলনকারী দেশ। রাশিয়ার আগে আছে শুধু যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব। আর কোন কোন দেশ তেল উত্তোলনে শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে, তা দেখে নেওয়া যাক। এই তালিকা ইউএস এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ইআইএ) থেকে নেওয়া।
যুক্তরাষ্ট্র : বিশ্বের শীর্ষ তেল উত্তোলনকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্র। ইআরএর সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, দেশটি প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি ১২ লাখ ব্যারেল তেল উত্তোলন করে। এটা বিশ্বে প্রতিদিন মোট উত্তোলিত তেলের প্রায় ২২ শতাংশ। শুধু শীর্ষ তেল উত্তোলনকারী দেশ নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্র জ্বালানি তেলের ভোক্তা দেশের তালিকাতেও ১ নম্বরে।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিদিন প্রায় দুই কোটি ব্যারেল তেলের প্রয়োজন পড়ে, যা বিশ্বজুড়ে প্রতিদিনের তেলের চাহিদার প্রায় ২০ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের মজুত ঠিক কত, তা নিয়ে অনেক ভিন্নতা আছে। অয়েল প্রাইস ডটকমের এক হিসাব অনুযায়ী, দেশটির মোট তেলের মজুত ৬৮ দশমিক ৮ বিলিয়ন ব্যারেল বা ৬ হাজার ৮৮৯ কোটি ব্যারেল। আরেক হিসাবে তাদের মজুত ৭৪ বিলিয়ন বা ৭ হাজার ৪০০ কোটি ব্যারেল বলা হয়েছে।
সৌদি আরব : বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ তেল উত্তোলনকারী দেশ সৌদি আরব। ইআরএর সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি প্রতিদিন প্রায় ১ কোটি ১১ লাখ ব্যারেল তেল উত্তোলন করে। এটা বিশ্বে প্রতিদিন মোট উত্তোলিত তেলের প্রায় ১১ শতাংশ।
অপরিশোধিত তেলের গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানিকারক দেশ সৌদি আরব পেট্রোলিয়াম রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংগঠনের (ওপেক) প্রভাবশালী সদস্য। সৌদি আরবের অর্থনীতি তেল রপ্তানি থেকে পাওয়া আয়ের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। জ্বালানি তেলের ভোক্তা দেশের তালিকায় ৫ নম্বরে রয়েছে সৌদি আরব। প্রতিদিন দেশটির গড়ে সাড়ে ৩৬ লাখ ব্যারেল তেলের চাহিদা রয়েছে।
কখনো কখনো প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে এই জ্বালানি তেলই হয়ে ওঠে বড় অস্ত্র। এর অতি সাম্প্রতিক নজির ভারতের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘অতিরিক্ত’ ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ। ট্রাম্প স্পষ্ট করেই বলেছেন, নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে রাশিয়ার কাছ থেকে জ্বালানি তেল কেনার কারণে ভারতকে এ সাজা পেতে হয়েছে। একই কারণ দেখিয়ে চীনকেও শাস্তির হুমকি দিয়ে রেখেছেন ট্রাম্প।
রাশিয়া : রাশিয়া বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ তেল উত্তোলনকারী দেশ। ইআরএর সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, রাশিয়া প্রতিদিন প্রায় ১ কোটি ৭ লাখ ব্যারেল তেল উত্তোলন করে। এটা বিশ্বে প্রতিদিন মোট উত্তোলিত তেলের প্রায় ১১ শতাংশ।
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পশ্চিমাদের নানামুখী নিষেধাজ্ঞায় রাশিয়ার তেল রপ্তানি খানিকটা কমে গেছে। তারপরও এশিয়ার দেশগুলোতে রপ্তানি অনেকটা বেড়ে যাওয়ায় রাশিয়ার তেল উত্তোলনে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব তেমন একটা পড়েনি।
জ্বালানি তেল উত্তোলনকারী দেশের তালিকায় রাশিয়া সৌদি আরবের পেছনে হলেও ভোক্তা দেশ হিসেবে তারা মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিকে পেছনে ফেলেছে। ভোক্তা দেশের তালিকায় চার নম্বরে থাকা রাশিয়ার প্রতিদিন প্রায় ৩৭ লাখ ব্যারেল তেলের প্রয়োজন পড়ে।
২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী চীন দৈনিক প্রায় ৫৩ লাখ ব্যারেল তেল উত্তোলন করে। এটা বিশ্বে প্রতিদিন মোট উত্তোলিত তেলের প্রায় ৬ শতাংশ। তবে নিজেদের তেলক্ষেত্র থেকে এত তেল উত্তোলন করার পরও চীন সারা বিশ্ব থেকে সবচেয়ে বেশি অপরিশোধিত তেল আমদানি করে।
কানাডা : দৈনিক প্রায় ৫৮ লাখ ব্যারেল তেল উত্তোলন করা কানাডা বিশ্বের চতুর্থ সর্বোচ্চ তেল উত্তোলনকারী দেশ। এটা বিশ্বে প্রতিদিন মোট উত্তোলিত তেলের প্রায় ৬ শতাংশ।
এই উৎপাদনের বড় অংশ আসে পশ্চিম কানাডা থেকে, বিশেষ করে আলবার্টা থেকে।
২০২৩ সালে কানাডায় মোট উত্তোলিত তেলের ৮৪ শতাংশ এসেছিল ওই অঞ্চল থেকে।
কানাডার তেল মূলত যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়। তেল উত্তোলনে চতুর্থ হলেও তেলের ভোক্তা দেশ হিসেবে কানাডা আছে নয় নম্বরে।
চীন : বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতির দেশ চীন সবচেয়ে বেশি তেল উত্তোলনকারী দেশের তালিকায় পাঁচ নম্বরে রয়েছে। ২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, দেশটি দৈনিক প্রায় ৫৩ লাখ ব্যারেল তেল উত্তোলন করে। এটা বিশ্বে প্রতিদিন মোট উত্তোলিত তেলের প্রায় ৬ শতাংশ। তবে নিজেদের তেলক্ষেত্র থেকে এত তেল উত্তোলন করার পরও চীন সারা বিশ্ব থেকে সবচেয়ে বেশি অপরিশোধিত তেল আমদানি করে।
ইউক্রেন যুদ্ধের পর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে যে দুটি দেশ রাশিয়া থেকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে অপরিশোধিত তেল আমদানি করেছে, তার একটি চীন, অন্য দেশটি হচ্ছে ভারত। সবচেয়ে বেশি তেলের ভোক্তা দেশের তালিকায় চীন দুই নম্বরে। দেশটিতে প্রতিদিন গড়ে ১ কোটি ৫০ লাখ ব্যারেলের বেশি তেলের প্রয়োজন পড়ে।
বিশ্বের সবচেয়ে গভীর তেলখনি রয়েছে লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিলে। দেশটি দৈনিক প্রায় ৪৩ লাখ ব্যারেল তেল উত্তোলন করে। ব্রাজিলের বেশির ভাগ তেল আসে দেশটির সমুদ্রতলদেশে থাকা তেলখনি থেকে।
ইরাক : মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে তেল উত্তোলনে সৌদি আরবের পরেই আছে ইরাক। দৈনিক ৪৪ লাখ ২০ হাজার ব্যারেল তেল উত্তোলন করে দেশটি সর্বোচ্চ তেল উত্তোলনকারী দেশের তালিকায় ছয় নম্বরে। বিশ্বে মোট উত্তোলিত তেলের ৪ শতাংশ আসে ইরাক থেকে।
দেশটি নিজেদের এই সক্ষমতা আরও বৃদ্ধির পরিকল্পনা করেছে এবং ২০২৯ সাল নাগাদ দৈনিক তেল উত্তোলন ৬০ লাখ ব্যারেল ছাড়িয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।
তেল উত্তোলনে শীর্ষ দশে জায়গা পেলেও ভোক্তা দেশের তালিকায় ইরাক বেশ পেছনে। দেশটি তাদের উত্তোলিত তেলের প্রায় ৮০ শতাংশ রপ্তানি করে।
ব্রাজিল : বিশ্বের সবচেয়ে গভীর তেলের খনি রয়েছে লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিলে। দেশটি দৈনিক প্রায় ৪৩ লাখ ব্যারেল তেল উত্তোলন করে। সর্বোচ্চ তেল উত্তোলনকারী দেশের তালিকায় ব্রাজিল সাত নম্বরে। বিশ্বে মোট উত্তোলিত তেলে দেশটির অবদান ৪ শতাংশ।
ব্রাজিলের বেশির ভাগ তেল আসে দেশটির সমুদ্র তলদেশে থাকা তেলখনি থেকে।
তেল উত্তোলনের পাশাপাশি ব্রাজিল জ্বালানি তেলের বড় ভোক্তা দেশও বটে। দেশটিতে প্রতিদিন ৩০ লাখ ব্যারেল পরিশোধিত তেলের প্রয়োজন পড়ে। ভোক্তা দেশের তালিকাতেও ব্রাজিল সাত নম্বর।
সংযুক্ত আরব আমিরাত : দৈনিক প্রায় ৪১ লাখ ব্যারেল তেল উত্তোলন করা সংযুক্ত আরব আমিরাত বিশ্বের অষ্টম সর্বোচ্চ তেল উত্তোলনকারী দেশ। এটা বিশ্বে প্রতিদিন মোট উত্তোলিত তেলের প্রায় ৪ শতাংশ। সংযুক্ত আরব আমিরাতের মোট তেলের প্রায় ৯৬ শতাংশ আসে আবুধাবি থেকে। দেশটি তাদের উত্তোলিত তেলের ৬৬ শতাংশই রপ্তানি করে।
১৯৭১ সালে যাত্রা শুরু করা আবুধাবি ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি (এডিএনওসি) সংযুক্ত আরব আমিরাতের শীর্ষ তেল ও গ্যাস কোম্পানি।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের মোট তেলের প্রায় ৯৬ শতাংশ আসে আবুধাবি থেকে। দেশটি তাদের উত্তোলিত তেলের ৬৬ শতাংশই রপ্তানি করে।
ইরান : ইরান দৈনিক প্রায় ৪০ লাখ ব্যারেল তেল উত্তোলন করে। বিশ্বে মোট উত্তোলিত তেলে দেশটির অবদান প্রায় ৪ শতাংশ। ইরান এই তেলের প্রায় ৪৩ শতাংশ রপ্তানি করে।
পেট্রোলিয়াম রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংগঠনের (ওপেক) সদস্য ইরান। ওপেক দেশগুলোর মধ্যে ইরান চতুর্থ বৃহত্তম তেল উত্তোলনকারী দেশ।
বিশ্ব তালিকায় ইরান আছে নয় নম্বরে। বিশ্বের প্রমাণিত যে তেলের মজুত আছে, তার প্রায় ১২ শতাংশের মালিক ইরান। দেশটিতে প্রায় ১৫ হাজার ৭০০ কোটি ব্যারেল তেলের মজুত রয়েছে।
কুয়েত : কুয়েত দৈনিক প্রায় ২৯ লাখ ব্যারেল তেল উত্তোলন করে। বিশ্বে মোট উত্তোলিত তেলে দেশটির অবদান প্রায় ৩ শতাংশ। কুয়েত এই তেলের প্রায় ৭১ শতাংশ রপ্তানি করে। মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটি তেল উত্তোলন দিন দিন বাড়াচ্ছে। এ লক্ষ্যে কুয়েত গত কয়েক বছরে তেল ও গ্যাস খাতে প্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগ করেছে। দেশটি তেল পরিশোধন খাতেও নিজেদের সক্ষমতা বাড়াচ্ছে।