আল জাজিরা : ইরানে ১১ দিনের টানা বিমান হামলার পর যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে ইসরাইল। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু দাবি করেছেন, “আমাদের লক্ষ্য পূরণ হয়েছে।” কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন—এমনটাই বলছেন বিশ্লেষক ওরি গোল্ডবার্গ।

ঘোষিত দুই লক্ষ্যÑ দুটোই ব্যর্থ যুদ্ধ শুরুর সময় নেতানিয়াহু বলেছিলেন, ইসরাইলের লক্ষ্য দুটি: ১. ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ধ্বংস ২. সরকারের পতন, কিন্তু গোল্ডবার্গ লিখেছেন, এই দুই লক্ষ্যই ব্যর্থ হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ফোরদো পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাত করলেও, ইরান তার মূল পরমাণু পদার্থ আগেই সরিয়ে ফেলেছিল। ফলে ‘পরমাণু কর্মসূচি ধ্বংস’ আদতে সম্ভব হয়নি। আর শাসনব্যবস্থা পতনের চেষ্টা উল্টো ফল দিয়েছে। ইসরাইল বিপুলসংখ্যক আইআরজিসি কমান্ডারকে হত্যা করে গণবিক্ষোভ উসকে দিতে চাইলেও, ইরানিরা একে দেশের ওপর আক্রমণ হিসেবে দেখেছে এবং সরকারের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।

প্রতীকী হামলায় ফল উল্টো: ইসরাইল ইভিন কারাগারে বোমা হামলা চালিয়ে সেটাকে মানবাধিকার সমর্থনের প্রচার হিসেবে দেখাতে চেয়েছিল, কিন্তু এতে বন্দিদের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। অনেককে অজানা স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ইরান রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম আইআরআইবি-তে হামলা চালিয়েও ফল পেয়েছে উল্টো। ইরান এরপর ইসরাইলি টিভি স্টেশনগুলোকে হুমকি দিতে শুরু করে।

যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা ছিল সীমিত: যুক্তরাষ্ট্র ইরানে বোমা ছুড়লেও, পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে অংশ নেয়নি। দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পরে একাধিকবার জানিয়েছেন, তিনি ইরানের সঙ্গে চুক্তিতে আগ্রহী। জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্জ ইসরাইলকে সমর্থন করলেও, ইসরাইলের কড়া শর্ত—যেমন ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিকরণ সম্পূর্ণ বন্ধ—কোনো দেশই মেনে নেয়নি। বিশ্ব আবার ফিরে গেছে ‘পারমাণবিক অস্ত্র নয়’-এই পুরনো সমঝোতায়, যেটাতে ইরান আগেই রাজি ছিল। ইসরাইল ভোগ করেছে প্রতিরক্ষা সংকট: যুদ্ধের শুরুতে ইসরাইল আকাশে প্রাধান্য পেলেও, ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র বহুবার তার প্রতিরক্ষা ভেদ করে দেশজুড়ে হামলা চালায়। ইসরাইল দ্রুত প্রতিরক্ষামূলক ক্ষেপণাস্ত্রের ঘাটতিতে পড়ে, যার ফলে ব্যাপক ধ্বংস ও হতাহতের শিকার হয়।

ইরানের বিজয় কী? : ইরান শত শত হতাহত ও অবকাঠামোগত ক্ষতি সত্ত্বেও টিকে আছে। আন্তর্জাতিকভাবে দেশটি ‘আক্রমণের শিকার’ হিসেবে দেখা হয়েছে। মার্কিন হামলার জবাব দেওয়ার আগে ইরান সতর্কবার্তা দিয়েছিল, যা যুদ্ধ না বাড়িয়ে বরং নিয়ন্ত্রণে আনে। ট্রাম্প পরে ইসরাইলকে হামলা বন্ধ রাখতে সতর্ক করে—এটাও ইরানের এক ধরনের কূটনৈতিক জয়। সার্বিকভাবে, ইরান যেভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে চায়—ঠিক সেইভাবে যুদ্ধ শেষে দাঁড়িয়ে আছে।

এদিকে ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধবিরতির বিষয়টি মঙ্গলবার দেশটির প্রেসিডেন্টসহ সিনিয়র কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছিলেন। কিন্তু এরপরেও দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির দিক থেকে বিষয়টি স্বীকার করে প্রকাশ্যে কোনো বক্তব্য আসেনি। দেশটির কোনো বিষয়ে তার বক্তব্যই শেষ কথা। সে কারণে দেশটির ভেতরে ও বাইরে থেকে এখন নজর দেওয়া হচ্ছে, যে তিনি এ বিষয়ে কখন কথা বলেন। খামেনি তেহরানে তার নিয়মিত বাসবভনে অবস্থান না করে নিরাপদ বাঙ্কারে অবস্থান করছেন- এমন খবর আগেই এসেছে, যদিও তা ইরান নিশ্চিত করেনি।

সবশেষ গত ১৮ জুন তার আগে থেকে রেকর্ড করা একটি ভিডিও বার্তা টেলিভিশনে প্রচার হয়েছে। ওই ভাষণে তিনি ‘নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ’ করতে ডোনাল্ড ট্রাম্প যে আহ্বান জানিয়েছিলেন তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সোমবার সন্ধ্যায় ইসরাইল ও ইরান যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে বলে ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, এটি একটি স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার দিকে নিয়ে যেতে পারে।

ইরান বলেছে, ইসরাইল যদি তাদের আক্রমণ বন্ধ করে দেয়, তবে তারা গোলাবর্ষণ বন্ধ করতে প্রস্তুত। অন্যদিকে ইসরাইল বলেছে, ইরানে তাদের আক্রমণের উদ্দেশ্য অর্জন হয়েছে। তাই তারা এই যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে। প্রায় দুই সপ্তাহ আগে ইরানে ইসরাইলি বিমান হামলার পর, ইরানও প্রতিশোধ নিতে ইসরাইলে মিসাইল হামলা শুরু করে। এরপর দুই দেশের মধ্যে চলমান পাল্টাপাল্টি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোয় বোমা হামলা করে। প্রায় ১২ দিন ধরে চলা সংঘাতের পর যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে দুই দেশ।