আল-জাজিরা, রয়টার্স, বিবিসি, এএফপি : অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডে একটি স্কুলে বোমা হামলা চালিয়েছে ইসরাইলী বাহিনী। স্কুলটি আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল এবং সেখানে বহু মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে অবস্থান করছিলেন। এই হামলায় কমপক্ষে ২৫ জন নিহত হয়েছেন।
গতকাল সোমবার কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম তাদের এক প্রতিবেদনে এ খবর জানিয়েছে।
সংবাদমাধ্যমটি জানায়, নিহতদের মধ্যে দুইজন রেড ক্রস কর্মী, একজন সাংবাদিক ও একাধিক শিশু রয়েছে। এছাড়া নিহতদের তালিকায় রয়েছে মাত্র ১১ বছর বয়সী গাজার কনিষ্ঠতম সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার ইয়াকিন হাম্মাদও।
আল জাজিরা জানায়, সোমবার ইসরাইল আবারও গাজায় ব্যাপক হামলা চালায়। বোমা বর্ষণের শিকার হওয়া স্কুলটি আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল, যেখানে বহু অসহায় মানুষ মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজছিলেন। এই হামলা ঘিরে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে আন্তর্জাতিক মহলে।
নিহত ফিলিস্তিনি শিশু ইনফ্লুয়েন্সার
গাজা উপত্যকায় ইসরাইলী হামলায় গত ৪৮ ঘণ্টায় এক ডজনের বেশি শিশু প্রাণ হারিয়েছে। চলমান মানবিক বিপর্যয়ের কারণে আরও হাজার হাজার শিশু চরম খাদ্যসংকটের ঝুঁকিতে রয়েছে। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম এ খবর জানিয়েছে।
গত রোববার সকাল থেকে ইসরাইলী হামলায় অন্তত ২২ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
সম্প্রতি পৃথক ইসরাইলী বিমান হামলায় আল নাজার নামক এক চিকিৎসকের নয় সন্তান এবং ইয়াকিন হামমাদ নামক এক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইনফ্লুয়েন্সার প্রাণ হারিয়েছে।
শুক্রবার রাতে গাজার উত্তরাঞ্চলে ইসরাইলী বিমান হামলায় নিহত হয় ১১ বছর বয়সী ইয়াকিন। গাজায় স্বেচ্ছাসেবামূলক কর্মকাণ্ড এবং তার হাসিমাখা মুখের কারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছিল ইয়াকিন।
বড় ভাই মোহাম্মদ হামমাদের সঙ্গে গাজার বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলোর জন্য খাবার, খেলনা ও পোশাক বিতরণ করতো ইয়াকিন। সে গাজাভিত্তিক একটি মানবিক সংগঠনের সক্রিয় সদস্য ছিল।
ইয়াকিনের মৃত্যুর পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শোক ও শ্রদ্ধার বার্তা ছড়িয়ে যায়। গাজার একজন ফটোসাংবাদিক মাহমুদ বাস্সাম লিখেছেন, সে দেহত্যাগ করলেও তার কাজ আমাদের জন্য আলোর দিশারী হয়ে থাকবে।
অন্য একজন লিখেছেন, স্কুলে যাওয়া এবং শৈশব উপভোগ করার বদলে সে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় ছিল অন্যদের সহায়তা করতে। (এ দুঃখ প্রকাশের) ভাষা নেই, একদম কোনও ভাষা নেই। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৯ মাস ধরে গাজায় চলমান ইসরাইলী আগ্রাসনে নিহতদের অন্তত ৩১ শতাংশই শিশু। তবে, অজ্ঞাত মৃত ব্যক্তিরা এই সংখ্যার বাইরে রয়েছেন। অর্থাৎ, প্রকৃত নিহতের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে শিশুদের লক্ষ্য করে ইসরাইলী বাহিনীর হামলার বিষয়টি তুলে ধরা হয়। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ইচ্ছাকৃত হামলা, বিশেষ করে আবাসিক ভবনে বারবার বিমান হামলা, শিশু মৃত্যুর হার বৃদ্ধি করেছে বলে ওই প্রতিবেদনে দাবি করা হয়।
খাদ্যের অভাবে কঙ্কালসার শিশু সিওয়ার
ইসরাইলী অবরোধের কারণে গাজায় ভয়াবহ খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে এখন গাজা। খাদ্যের অভাবে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা শিশুদের। এমনই এক শিশুকে নিয়ে লিখেছেন বিবিসির ফার্গাল কিন। আজ সোমবার অনলাইনে লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে।
ক্যামেরা দেখার পরও কারও মধ্যে উৎসাহ দেখা যায় না। শিশুরা চোখ তুলে তাকায় না বললেই চলে।
মৃত, মুমূর্ষু ও মৃত্যুর প্রহর গোনা মানুষের মধ্যে বসবাস করা একটি শিশুকে আর কীই–বা অবাক করতে পারে?
ক্ষুধা তাদের নিঃশেষ করে ফেলেছে। সামান্য একটু খাবারের আশায় তারা লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে। লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে কখনো কখনো ভাগ্যে কিছুই জোটে না।
বিবিসির জন্য কাজ করা আমার সহকর্মী ও তার ক্যামেরার সঙ্গে এসব গাজাবাসী অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন।
একদিকে যুদ্ধ, তার ওপর ইসরাইল গাজায় ত্রাণসামগ্রী ঢুকতে দিচ্ছে না। এ কারণে সেখানে সিওয়ারের মতো শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় ফর্মুলা দুধের তীব্র ঘাটতি তৈরি হয়েছে।
বিবিসির সহকর্মী দেখেছেন তাদের অনাহার, মৃত্যু পথযাত্রা এবং কীভাবে তাদের মরদেহ বা দেহের খণ্ডাংশ সাদা কাফনে মোড়ানো হয়। নাম জানা থাকলে তাদের নাম সেই কাফনের ওপর লেখা হয়।
১৯ মাস ধরে চলা যুদ্ধ এবং এখন নতুন করে ইসরাইলী হামলার মধ্যে এই স্থানীয় ক্যামেরাম্যান হাসপাতাল প্রাঙ্গণে বেঁচে থাকা মানুষের যন্ত্রণাক্লিষ্ট আহাজারি শুনে চলেছেন। নিরাপত্তার স্বার্থে আমি তার নাম প্রকাশ করছি না।
তিনি শারীরিকভাবে সম্মানজনক দূরত্বে থাকেন, কিন্তু তারা দিনরাত তার মনে জেগে থাকেন।
তিনিও তাদেরই একজন একই সংকীর্ণ নরকে বন্দী।
এই সকালে বিবিসির সহকর্মী খুঁজতে বেরিয়েছেন শিশু সিওয়ার আশুরকে। খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালে পাঁচ মাস বয়সী এই কন্যাশিশুর কঙ্কালসার দেহ এবং কান্না তাকে এতটাই নাড়া দিয়েছিল যে তিনি আমাকে লিখেছিলেন, তার ভেতরটা ভেঙেচুরে গেছে।
ত্রাণের অভাবে গাজাজুড়ে এখন হাহাকার। একটু খাবারের আশায় ত্রাণ বিতরণের স্থানগুলোয় ভিড় করছেন অসহায় ফিলিস্তিনিরা। এমনই এক বিতরণকেন্দ্রে খাবার সংগ্রহ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে এক শিশু। আজ মধ্য গাজার সিওয়ার আশুরের ওজন ছিল মাত্র দুই কেজির একটু বেশি।
পাঁচ মাস বয়সী একটি শিশুর ওজন সাধারণত ছয় কেজি বা তার বেশি হওয়া উচিত।
সিওয়ারকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে এবং সে এখন তার বাসায়, এমনটাই শুনেছেন আমার সহকর্মী।
এ খবর পেয়ে আমার বিবিসির সহকর্মী ছুটে এসেছেন গুঁড়িয়ে যাওয়া ঘরবাড়ি আর ত্রিপল ও টিনের তৈরি অস্থায়ী আশ্রয়শিবিরে।
কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেই আমার সহকর্মী অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন। কয়েক দিন আগে আমি খুদে বার্তা দিয়ে তার খোঁজ নিয়েছিলাম। জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি ঠিক নেই। মাত্র কিছুক্ষণ আগে ইসরাইলী সেনাবাহিনী খান ইউনিসের বেশির ভাগ এলাকা খালি করার নির্দেশ দিয়েছে...আমরা জানি না কী করব, যাওয়ার জন্য কোথাও কোনো নিরাপদ জায়গা নেই।
‘আল-মাওয়াসি এলাকাটি বাস্তুচ্যুত মানুষের ভিড়ে গিজগিজ করছে। আমরা দিশাহারা, এখন কী করব বুঝতে পারছি না।’
বিবিসির সহকর্মী এক কক্ষবিশিষ্ট একটি ছোট কুটির খুঁজে পেলেন, যার প্রবেশপথে ধূসর-কালো ফুলেল পর্দা টাঙানো। কক্ষের ভেতরে রয়েছে তিনটি গদি, একটি ড্রয়ারের অংশবিশেষ আর একটি আয়না। সে আয়নায় সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে তা সিওয়ার, তার মা নাজওয়া ও নানি রিমের সামনে মেঝেতে এসে পড়েছে।
সিওয়ার চুপচাপ, দুই নারীর সুরক্ষার ছায়ায় সে এখন নিরাপদে আছে।
শিশুটি প্রচণ্ড অ্যালার্জির কারণে সাধারণ দুধের ফর্মুলা হজম করতে পারে না।