আল-জাজিরা, রয়টার্স : এত বড় হামলা, এত বড় সন্ত্রাসবাদী ঘটনা, তা-ও আবার খোদ রাজধানীতে। অথচ এখনো পাকিস্তানের দিকে আঙুল তুলল না ভারত। বলল না, এটা সীমান্তপারের চক্রান্ত। শেষ কবে এমন ঘটেছে? এর উত্তর খোঁজার পাশাপাশি উঠে আসছে এ সত্য, নিজের দৃপ্ত ঘোষণা কার্যকর করার দিকে ভারত এগোতে পারছে না। রাজধানী দিল্লির ভয়াবহ গাড়ি বিস্ফোরণকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘সন্ত্রাসবাদী’ ও ‘দেশবিরোধী শক্তির’ কাজ বলা হলেও তার উৎস হিসেবে সরকার পাকিস্তানের নামোচ্চারণ করতে পারছে না। পারছে না পশ্চিম প্রান্তের প্রতিবেশীকে কাঠগড়ায় তুলতে। এর চেয়েও বড় কথা, এ ঘটনাকে ‘অ্যাক্ট অব ওয়ার’ বা ভারতের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’ হিসেবেও তারা জাহির করতে পারছে না। এতটাই সাবধানী হয়ে উঠেছে বিজেপিশাসিত ভারত।
এ অদ্ভুত পরিবর্তনের কারণ হঠাৎ বদলে যাওয়া ভূরাজনীতি, যা নানা কারণে ভারতের পায়ে বেড়ি পরিয়ে দিয়েছে। গত এপ্রিলে ভারতশাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলা ও পরের মাসে পাকিস্তানে ভারতের হামলার ঘটনা স্মরণ করুন। পাকিস্তানের সঙ্গে চার দিনের ‘সংঘাত’ হুট করে বন্ধ করতে হয়েছিল। দুই পরমাণু শক্তিধরের সে লড়াই বন্ধের কৃতিত্ব দাবি করেছিলেন (এখনো করেন) মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
অবশ্য ট্রাম্পের দাবি বারবার অস্বীকার করা ভারত যুদ্ধ বন্ধে বাধ্য হলেও ঘোষণা করেছিল দেশের নতুন ‘রণনীতি’। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দৃপ্ত কণ্ঠে জানিয়েছিলেন, ‘অপারেশন সিঁদুর’ বন্ধ করা হয়নি। তা শুধু স্থগিত রাখা হয়েছে। ভবিষ্যতে যেকোনো সন্ত্রাসবাদী হামলাকে ভারত তার বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’ বা অ্যাক্ট অব ওয়ার হিসেবে দেবে। গত বুধবার কেন্দ্রীয় মোদি সরকারের মন্ত্রিসভার বৈঠকে দিল্লি বিস্ফোরণকে সন্ত্রাসবাদী ও দেশবিরোধী কাজ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু সেটি সীমান্তপারের সন্ত্রাস কি না, সে ব্যাপার নিয়ে কিছু বলা হয়নি। সন্দেহের তির জইশ-ই-মোহাম্মদের দিকে হলেও সরকারিভাবে তা কবুল করা হচ্ছে না।
যে সংগঠন এতকাল ধরে পাকিস্তানের মাটি ব্যবহার করে ভারতের বিরুদ্ধে ‘লো কস্ট ওয়ার’ চালিয়ে আসছে, বারবার যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে পাকিস্তান সরকারকে ভারত বিঁধে এসেছে, এই প্রথম বিস্ময়করভাবে তা নিয়ে মোদি সরকার নীরব। অথচ ওই ঘটনার পর সন্ত্রাস দমন আইন ইউএপিএর আওতায় দিল্লি পুলিশ এফআইআর দায়ের করেছে। লালকেল্লা বিস্ফোরণের তদন্তের ভার তুলে নিয়েছে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)।
সহজ উত্তর, লালকেল্লার কাছে গাড়ি বিস্ফোরণে ১৩ জনের মৃত্যু ও ২০ জনের গুরুতর আহত হওয়া, দিকে দিকে বিপুল পরিমাণে বিস্ফোরক উদ্ধারের মতো ঘটনা অ্যাক্ট অব ওয়ার বা ‘যুদ্ধ’ বলে মানলে স্থগিত রাখা অপারেশন সিঁদুর আবার শুরু করতে হয়। প্রধানমন্ত্রী মোদিকে সিদ্ধান্ত মেনে আক্রমণাত্মক ভূমিকায় নামতে হয়। বর্তমান ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তা সম্ভব নয়। তাহলে কি সেই কারণে কিল খেয়ে মোদিকে কিল হজম করতে হচ্ছে। বিরোধীদের সমালোচনা শুনতে হচ্ছে। কেন এ হামলাকে যুদ্ধ গণ্য করা হচ্ছে না, তা নিয়ে কংগ্রেস মুখপাত্র পবন খেরা, আম আদমি পার্টির (এএপি) নেতা সঞ্জয় সিং বা অন্যদের প্রশ্নে মোদিকে বিদ্ধ হতে হচ্ছে। অথচ প্রধানমন্ত্রীসহ বিজেপি সরকারের কারও কাছে এর উত্তর নেই।
মোদি সরকারের এ অসহায়ত্বের ব্যাখ্যা শুনিয়েছেন সাউথ এশিয়া টেররিজম পোর্টালের নির্বাহী পরিচালক অজয় সাহনি। তিনি বলেছেন, ভারত নিজের পাতা ফাঁদে পড়ে গেছে। নতুন যে রণনীতির কথা তারা ঘোষণা করেছিল, যাতে বলা হয়েছিল সন্ত্রাসী হানা যুদ্ধ বলে পরিগণিত হবে, তার কোনো বিস্তারিত ব্যাখ্যা না থাকায় তারা নিজেদের বিপদগ্রস্ত করে তুলেছে। ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে ওই বোকা বোকা অবস্থান ঘোষণা করা হয়েছিল বলে তিনি মনে করেন। সহজ কথায়, এ বিস্ফোরণ পাকিস্তানের ‘অপকর্ম’ বলে চিহ্নিত করা হলে স্বাভাবিকভাবে দেশবাসী জানতে চাইবে, ঘোষিত রণনীতি মেনে দ্রুত কোন ব্যবস্থা ভারত নিচ্ছে। অপারেশন সিঁদুরের দ্বিতীয় পর্ব কবে কোথায় কীভাবে হতে চলেছে। দেশবাসীর তোলা সেসব প্রশ্নের সদুত্তর দেওয়া প্রধানমন্ত্রী মোদির পক্ষে সম্ভবপর নয়। কারণ, বদলে যাওয়া ভূরাজনীতি।
গত মে মাসের পর ভূরাজনীতির ক্যানভাস দ্রুত বদলে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারত ও পাকিস্তানের সম্পের্কে বদল ঘটেছে অনেকটাই। হোয়াইট হাউসে পাকিস্তানি সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের কদর দিন দিন বাড়ছে। পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ও সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের ভূয়সী প্রশংসা শোনা যাচ্ছে ট্রাম্পের মুখে। যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের সম্পর্ক যত বেশি মাখো মাখো হচ্ছে, ট্রাম্পকে ততই এড়িয়ে চলছেন মোদি। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও ইসলামাবাদের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করে তুলেছে তুরস্ক। অপারেশন সিঁদুরের সময় থেকেই তারা পাকিস্তানের পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছে। ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যচুক্তি হব হব করেও এখনো হয়ে ওঠেনি। দর–কষাকষি অব্যাহত। এ পরিস্থিতিতে নতুন সংঘাত শুরু করলে তার মাশুল গুনতে হবে ভারতকে। ভারত তা বিলক্ষণ বুঝতে পারছে। অপরাধীদের কঠোর শাস্তির প্রতিশ্রুতি শোনানো ছাড়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর এ মুহূর্তে আর কিছুই করার নেই। এত বড় নাশকতা ঘটে গেলেও এই প্রথম পাকিস্তানকে তাঁরা অপরাধী ঠাওরাতে পারছেন না। সরকারের দায় ও গাফিলতিও এড়াতে পারছেন না। গত ১১ বছরের রাজত্বে মোদি সরকার ও শাসক দল বিজেপিকে এতটা অসহায় আগে দেখায়নি।