বিবিসি,রয়টার্স: নেপালে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে দীর্ঘদিন ধরেই যুক্ত ছিলেন সন্দীপ। তার মতো অনেকেরই প্রচারণা চালানোর প্রধান পছন্দ ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। ভুয়া খবরের স্রোত সামলাতে গত সপ্তাহে সরকার যখন ফেসবুকসহ একাধিক প্ল্যাটফর্মের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়, আন্দোলনকারীরা ওই সিদ্ধান্তকে দেখেন তাদের দমিয়ে রাখার প্রচেষ্টা হিসেবে। তবে নিষেধাজ্ঞা জারি করে বরং আগুনে ঘি ঢালে নেপাল সরকার। ভাইবার ও টিকটকের মতো নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকা অ্যাপ ব্যবহার করে বিক্ষোভের ডাক দেন আন্দোলনকারীরা। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়া সংঘর্ষে ১৯ জনের মৃত্যুর পর গত মঙ্গলবার পদত্যাগে বাধ্য হন প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি।

গত বছর আরেক দক্ষিণ এশীয় রাষ্ট্র বাংলাদেশেও তরুণদের আহ্বানে শুরু হওয়া আন্দোলনে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানেও ইন্টারনেট বন্ধ করাসহ আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন সরকারি সিদ্ধান্তে পরিস্থিতি বরং ক্ষমতাসীনদের হাতের নাগালের বাইরে চলে যায়। বিক্ষোভের ডাক দিলেও সাড়া পাওয়ার পরিমাণে কিছুটা বিস্মিত হয়েছিলেন সন্দীপ। রাজধানী কাঠমান্ডুসহ বিভিন্ন শহরে অসংখ্য লোক রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। বিক্ষোভে সবার অংশগ্রহণ স্বতঃস্ফূর্ত ছিল দাবি করে সন্দীপ বলেছেন, নেপালের সবাই দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছিল। আসলে, বহুদিন ধরেই সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের মনে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছিল।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতি বিষয়ক সর্বশেষ সূচকে নেপালের অবস্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১০৭তম। এছাড়া, দেশে বাড়তে থাকা বৈষম্য এবং কর্মসংস্থানের অভাবেও নেপালের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে চাপা অসন্তুষ্টি ছিল। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, তিন কোটি মানুষের দেশটিতে ২০ শতাংশের বেশি মানুষ দরিদ্র। ২০২২-২৩ সালের এক হিসাবে দেখা গেছে, ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে ২২ শতাংশের বেশি মানুষ বেকার। নেপালে ধনী-গরিবের আয়বৈষম্যও চোখে পড়ার মতো। দেশটির ১০ শতাংশ সর্বোচ্চ ধনীর আয় দরিদ্রতম ৪০ শতাংশ মানুষের আয়ের চেয়ে অন্তত তিনগুণ বেশি। এসব বৈষম্যের তথ্য নিয়ে অনলাইনে প্রচারণ চালিয়ে আসছিলেন নেপালি তরুণরা। গৌরব নেপুনে নামের এক আহ্বায়ক বলেন, মন্ত্রী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার পার্থক্য তুলে ধরে তিনমাস ধরে অনলাইনে ক্যাম্পেইন চালানো হচ্ছিল। তরুণরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল। আমরা সহিংসতা বা অগ্নিসংযোগ থেকে আন্দোলনকারীদের বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছি। অথচ সরকার আন্দোলন দমনে সহিংসতার আশ্রয় নেয়। নেপালের ভবিষ্যত সরকারের কাছে তার প্রত্যাশা, আমরা দুর্নীতিমুক্ত এক সরকার চাই, যা কোনও প্রতিবেশীর তাঁবেদারি না করে স্বাধীনভাবে কাজ করবে। উল্লেখ্য, দেশটির রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের অভিযোগ রয়েছে প্রতিবেশী চীন ও ভারতের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের সাবেক সরকারের বিরুদ্ধে ভারত মুখাপেক্ষিতার অভিযোগ ছিল। বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের পর শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে অন্তবর্তীকালীন সরকার। ড. ইউনূসের পক্ষে তখন আন্দোলনকারীদের ব্যাপক সমর্থন ছিল। আর নেপালে আন্দোলনকারীদের অন্যতম পছন্দ হচ্ছেন কাঠমান্ডুর মেয়র বালেন্দ্র শাহ। গানের জগৎ থেকে রাজনীতিতে আসা ৩৫ বছর বয়সী বালেন্দ্র রাজধানীর সড়ক ও নালা পরিষ্কারের অঙ্গীকার দিয়ে ২০২২ সালে ক্ষমতায় আসেন।

বিমল পোখরেল নামের এক ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে বালেন্দ্র শাহকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন, নেপালের রাজনীতিতে আপনার নেতৃত্বের জন্য আমরা অধীরভাবে অপেক্ষা করছি। আমাদের জন্য আপনিই শেষ ভরসা। দয়া করে, নেপালকে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসুন। আন্দোলন চলাকালীন সংঘর্ষে মৃত্যুর জন্য ওলিকে 'সন্ত্রাসী' তকমা দিয়ে বালেন্দ্র বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী সন্তান হারানোর বেদনা অনুভব করেন না। গত মঙ্গলবার ওলি পদত্যাগ করার পর সবাইকে শান্ত থাকার অনুরোধ করেন তিনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইন্সটাগ্রামের এক পোস্টে তিনি আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে বলেন, আপনাদের হেনস্থাকারীরা পদত্যাগ করেছেন। এবার দয়া করে ধৈর্য ধরুন। আমাদের সহনশীল হতে হবে। তরুণদেরকে দেশের হাল ধরার আহ্বান জানিয়ে তিনি আরও বলেন, আপনাদের প্রজন্মই সামনে দেশের নেতৃত্ব দেবেন। প্রস্তুত থাকুন।