ফিলিস্তিনের গাজায় গত বৃহস্পতিবার ইসরাইলী হামলায় অন্তত ৮২ জন নিহত হয়েছেন। স্থানীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ তথ্য জানিয়েছে। গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠার আলোচনা ও রাফায় ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক স্থানান্তর করার ইসরাইল-মার্কিন পরিকল্পনা নিয়ে সমালোচনা চলার মধ্যে গতকাল ভোর থেকে এসব হামলা হয়। এদিকে এই ব্যক্তিদের মধ্যে ১৫ জন দেইর আল-বালাহ এলাকায় খাবার সংগ্রহের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় ইসরাইলি হামলায় নিহত হন। এর মধ্যে ৯টি শিশু আর ৪ জন নারী। এ হামলায় আরও অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ১৯টিই শিশু। আল জাজিরা, রয়টার্স।
জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ক্যাথরিন রাসেল এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, সহায়তা নিতে আসা পরিবারগুলোর সদস্যদের যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, তা একেবারেই অমানবিক।
ক্যাথরিন রাসেল, ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক: ক্যাথরিন আরও বলেন, গাজায় এখন যা ঘটছে, সেটারই নির্মম বাস্তবতা হলো এই ঘটনা। মাসের পর মাস ধরে এখানে যথেষ্ট সাহায্য ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আর সংঘাতে জড়িত পক্ষগুলো বেসামরিক মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিতে মৌলিক দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ক্যাথরিনের মতে, ত্রাণসহায়তার ঘাটতি থাকার মানেই হলো শিশুরা অনাহারে ভুগছে। আর তাতে দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিও বাড়ছে। পুরোদমে যদি সহায়তা ও সেবা নিশ্চিত না করা যায়, তবে অপুষ্ট শিশুর সংখ্যা বাড়তে থাকবে।
এ হামলার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিত করতে এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন পুরোপুরি মেনে চলতে ইসরাইলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ক্যাথরিন। এ হামলার নিন্দা জানিয়েছে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসও। তারা বলেছে, এটি গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের ‘চলমান জাতিহত্যা অভিযানের অংশ’। এক বিবৃতিতে হামাস বলেছে, ‘ইসরাইল এখন স্কুল, রাস্তা, আশ্রয়কেন্দ্র ও বেসামরিক এলাকায় নিরীহ মানুষের ওপর নৃশংস হত্যাযজ্ঞ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এসব হামলা একেবারে পরিকল্পিতভাবে চালানো হচ্ছে; যা পুরোদমে জাতিগত নির্মূল অভিযানের শামিল। আর এ অপরাধ পুরো বিশ্বের চোখের সামনেই ঘটছে।’ ক্যাথরিন রাসেল এ হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। সহায়তা নিতে আসা পরিবারগুলোর সদস্যদের যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, তা একেবারেই অমানবিক। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গাজায় ইসরাইলের হামলায় এ পর্যন্ত অন্তত ৫৭ হাজার ৭৬২ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ১ লাখ ৩৭ হাজার ৬৫৬ জন।
এদিকে গত রোববার থেকে যুক্তরাষ্ট্র, কাতার ও মিসরের মধ্যস্থতায় ইসরাইল ও হামাসের প্রতিনিধিরা যুদ্ধবিরতি চুক্তির জন্য আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন। এ আলোচনার লক্ষ্য হলো গাজায় ইসরাইলি হামলা সাময়িকভাবে বন্ধ করা এবং জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া। হামাস বলেছে, তারা ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতির অংশ হিসেবে ১০ জন জিম্মিকে ছেড়ে দিতে রাজি হয়েছে। তবে গতকাল হামাস বলেছে, গাজায় সহায়তা প্রবেশ ও ইসরাইলী সেনা প্রত্যাহারÑদুই বিষয়ে এখনো মতপার্থক্য আছে।
যুক্তরাষ্ট্র সফরের শেষ দিনে ওয়াশিংটনে একাধিক বৈঠক করে ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, গাজায় ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতি ও সেখানে থাকা ৫০ জিম্মির অর্ধেককে মুক্ত করার লক্ষ্যে একটি চুক্তির জন্য ইসরাইল কাজ করছে। নেতানিয়াহু আরও বলেছেন, এ চুক্তি হলে ইসরাইল স্থায়ীভাবে যুদ্ধ শেষ করার বিষয়ে আলোচনা করতে প্রস্তুত। তবে শর্ত হলো, হামাসকে নিরস্ত্র হতে হবে এবং গাজায় তাদের শাসন ও সামরিক ক্ষমতা ছাড়তে হবে।
গাজায় ত্রাণ নিতে গিয়ে নিহত ৭৯৮ ফিলিস্তিনী --- জাতিসংঘ
গাজায় ত্রাণ সংগ্রহের সময় অন্তত ৭৯৮ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর ওএইচসিএইচআর সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়। ওএইচসিএইচআর-এর মুখপাত্র রাভিনা শামদাসানি বলেন, ‘৭ জুলাই পর্যন্ত আমরা ৭৯৮ জন নিহত হওয়ার ঘটনা নথিভুক্ত করেছি। এর মধ্যে ৬১৫ জন যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইল পরিচালিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন জিএইএফ পরিচালিত সহায়তা কেন্দ্রের আশপাশে এবং বাকি ১৮৩ জন জাতিসংঘসহ অন্যান্য ত্রাণসহায়তাকেন্দ্রে নিহত হয়েছেন।’
যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল পরিচালিত জিএইচএফ গাজায় সরাসরি ত্রাণ বিতরণ করছে, যেখানে তারা মার্কিন বেসরকারি নিরাপত্তা ও সরবরাহ সংস্থাগুলোর সহায়তা নিচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘের নেতৃত্বাধীন ত্রাণ বিতরণ ব্যবস্থাকে পাশ কাটানো হচ্ছে। এ ব্যাপারে ইসরাইল দাবি করেছে—পূর্বের ত্রাণকার্যক্রম ব্যবস্থায় হামাস যোদ্ধারা ত্রাণ সরিয়ে নিচ্ছিল। তবে জাতিসংঘ এই নতুন ব্যবস্থাকে ‘সহায়তার নিরাপত্তাহীন পরিবেশ’ এবং মানবিক সহায়তার পক্ষপাতহীনতার নীতির লঙ্ঘন বলে উল্লেখ করেছে।
মে মাসের শেষ দিকে গাজায় প্যাকেট করে খাদ্য বিতরণ শুরু করে জিএইচএফ। সংস্থাটি বারবার দাবি করে এসেছে, তাদের পরিচালিত কেন্দ্রগুলোতে কোনো প্রাণঘাতী ঘটনা ঘটেনি। যদিও জাতিসংঘের রিপোর্টে বিপরীত চিত্র উঠে এসেছে। গাজায় চলমান মানবিক সংকটে এই সহিংসতার নতুন মাত্রা উদ্বেগ তৈরি করছে বলে মত প্রকাশ করেছেন মানবাধিকার বিশ্লেষকেরা।