হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, অবরুদ্ধ এই উপত্যকায় ইসরাইলী আগ্রাসনে নিহতের সংখ্যা ৬৭ হাজার ছাড়িয়েছে। শুধু গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৬৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল শনিবার মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত মোট প্রাণহানি দাঁড়িয়েছে ৬৭ হাজার ৭৪ জনে। ইসরাইলী সেনাবাহিনী (আইডিএফ) গত এক দিনে তাদের হামলা বা অভিযানের বিষয়ে এখনো কোনো মন্তব্য করেনি। সিবিএস নিউজ, দ্য টাইমস অব ইসরাইল, আলজাজিরা, এএফপি।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আরও জানিয়েছে, খাদ্যাভাব ও পুষ্টিহীনতায় গত ২৪ ঘণ্টায় আরও দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে অনাহার ও অপুষ্টিজনিত মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৫৯ জনে। এর মধ্যে ১৫৪ জন শিশু। সম্প্রতি জাতিসংঘের বৈশ্বিক সম্মেলনে সম্প্রতি ফিলিস্তিনকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ। ফ্রান্স ও সৌদি আরবের আয়োজিত এ সম্মেলনে প্রথমে যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, পর্তুগাল, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা, আন্দোর্রা, মোনাকো। এরপরও থেমে নেই ইসরাইলের নিষ্ঠুর হামলা। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া উপত্যকায় দুর্ভিক্ষ চরম আকার ধারণ করেছে। গত নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) গাজায় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োযভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। এছাড়া ইসরাইলের বিরুদ্ধে গাজায় গণহত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতেও (আইসিজে) মামলা চলছে।

গাজাগামী ত্রাণবাহী নৌকায় ড্রোন হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন নেতানিয়াহু।

গত মাসের শুরুর দিকে গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা বহরের দুটি নৌযানে সামরিক অভিযান চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। গাজা অভিমুখী ওই নৌযান দুটি তিউনিসিয়ায় নোঙর করা ছিল। মার্কিন দুই গোয়েন্দা কর্মকর্তার বরাত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম এ খবর জানিয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কর্মকর্তারা বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৪০টির বেশি নৌযান নিয়ে গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা নৌবহরটি গাজার উদ্দেশে রওনা হয়েছিল। এসব নৌযানে মানবিক সহায়তা ও ফিলিস্তিনপন্থি প্রায় ৫০০ লোক ছিলেন। একটিতে সুইডিশ জলবায়ু কর্মী গ্রেটা থুনবার্গ ছিলেন।

জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক বিষয়ে প্রকাশ্যে কথা বলার অনুমতি না থাকায় ওই কর্মকর্তারা তাদের নাম পরিচয় জানাতে সম্মত হননি। তবে সিবিএস নিউজকে তারা জানিয়েছেন যে, ৮ ও ৯ সেপ্টেম্বর ইসরাইলী বাহিনী একটি সাবমেরিন থেকে ড্রোন উড়িয়ে উনিসিয়ার সিদি বু সাঈদ বন্দরের বাইরে নোঙর করা নৌকাগুলোর ওপর আগুন সৃষ্টিকারী দাহ্য পদার্থ নিক্ষেপ করে। এতে সেগুলোতে আগুন ধরে যায় কর্মকর্তাদের দাবি, পর্তুগিজ পতাকাবাহী একটি নৌযান এবং একটি ব্রিটিশ পতাকাবাহী নৌযানকে আলাদা করে নিশানা করা হয়েছিল। তবে ওই হামলায় কেউ হতাহত হয়নি।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও সশস্ত্র সংঘাত সংশ্লিষ্ট আইন অনুযায়ী, যে কোনও পরিস্থিতিতেই বেসামরিক মানুষ বা বেসামরিক স্থাপনার ওপর দাহ্য সরঞ্জাম দিয়ে হামলা নিষিদ্ধ। নেতানিয়াহু এ ব্যাপারে এখনও কোনও প্রতিক্রিয়া জানাননি। ইসরাইলী প্রতিরক্ষা বাহিনীও সিবিএস নিউজের মন্তব্যের অনুরোধের কোনও জবাব দেয়নি। ইসরায়েল এক দশকেরও বেশি সময় ধরে গাজা উপত্যকায় নৌ অবরোধ জারি রেখেছে। প্রথমবার এই নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করা হয় ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে, যখন ইসরাইলী নৌবাহিনী উপকূলীয় জলের সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধের ঘোষণা দেয়।

গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা একটি আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক উদ্যোগ, যা গাজার ওপর ইসরাইলী নৌ অবরোধ ভেঙে যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলটিতে সাহায্য পৌঁছানোর লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে।

৮ সেপ্টেম্বর ‘ফ্যামিলি’ নামের একটি পর্তুগিজ পতাকাবাহী নৌযানের ওপর একটি আগুন সৃষ্টিকারী দাহ্য পদার্থ নিক্ষেপ করা হয়। গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা সিবিএস নিউজকে জানায়, হামলার আগের রাতে পর্তুগিজ সংসদ সদস্য মারিয়ানা মরটাগুয়া নৌকাটিতে ছিলেন।

৯ সেপ্টেম্বর ‘আলমা’ নামের একটি ব্রিটিশ পতাকাবাহী নৌযানের ওপর একইভাবে হামলা চালানো হয়। উভয় ক্ষেত্রেই নৌকাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ক্রুরা দ্রুত আগুন নেভাতে সক্ষম হয়েছিল। কেউ নিহত বা আহত হননি। এদিকে গত বুধবার থেকে এ পর্যন্ত গাজার জলসীমায় প্রবেশের আগেই গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা নৌবহরের সব নৌযান জব্দ ও আরোহীদের গ্রেফতার করে ইসরাইলী বাহিনী।

ট্রাম্পের আহ্বান উপেক্ষা করে গাজায় ব্যাপক বোমাবর্ষণ ইসরাইলের

ফিলিস্তিনী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতির চুক্তিতে ইতিবাচক সাড়া জানিয়েছে। এরপর ট্রাম্প গাজায় ইসরায়েলকে হামলা বন্ধের আহ্বান জানায়। তা সত্ত্বেও গত শনিবার মধ্যরাতে উপত্যকাটিতে ব্যাপক বোমাবর্ষণ করেছে দখলদার ইসরায়েল। গাজার সিভিল ডিফেন্সের মুখপাত্র মাহমুদ বাসিল বলেছেন, “গতকাল রাতটি ছিল বেশ সহিংস। ওই সময় ইসরাইলী সেনাবাহিনী গাজা সিটি ও অন্যানয় জায়গায় অসংখ্য বিমান হামলা ও গোলাবর্ষণ করেছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বোমাবর্ষণ বন্ধের আহ্বান জানানো সত্ত্বেও তারা হামলা চালিয়েছে।” গতকাল রাতের হামলায় ২০টি বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে বলেও জানিয়েছেন মাহমুদ বাসিল।

এদিকে হামাস ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মানার পর এবং ট্রাম্প গাজায় হামলা বন্ধের নির্দেশনা দেওয়ার পর গাজা সিটির মানুষ তাদের নিজ বাড়িতে ফেরা শুরু করে। এরপর সাধারণ মানুষকে সতর্কতা দিয়েছে দখলদার ইসরায়েল। তারা বলেছে, গাজা সিটি অত্যন্ত বিপজ্জনক যুদ্ধপ্রবণ এলাকা। সেখানে ফিরলে প্রাণহানি ঘটতে পারে। ইসরাইলী সেনাবাহিনী বলেছে, “গাজা সিটিতে আমাদের সেনারা এখনো অভিযান চালাচ্ছে। সেখানে ফেরা অত্যন্ত বিপজ্জনক। আপনার নিরাপত্তার জন্য, গাজার উত্তরাঞ্চল, দক্ষিণাঞ্চল এবং যেখানে সেনারা সক্রিয় রয়েছে সেখানে যাবেন না।” এদিকে ট্রাম্পের প্রস্তাবে হামাস শর্তসাপেক্ষে হ্যাঁ বলার পর গাজার সাধারণ মানুষ আশা দেখছেন আড়াই বছর ধরে চলা এ যুদ্ধ অবশেষে থামবে। তবে এ যুদ্ধবিরতিটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি হবে কি না সেটি এখনো স্পষ্ট নয়। কারণ ট্রাম্পের প্রস্তাবে ইসরাইলী সেনাদের তাৎক্ষণিকভাবে গাজা থেকে প্রত্যাহারের কথা বলা হয়নি। অপরদিকে হামাসকে অস্ত্র সমর্পণ করতে বলা হয়েছে। যা ফিলিস্তিনী এ গোষ্ঠী সহজে মানবে না।

নিহত ৭

গাজার সিভিল ডিফেন্স সংস্থা জানিয়েছে, হামাস যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে সম্মত হওয়ার পরও ইসরাইল গাজা নগরীতে বেশ কয়েকটি বিমান হামলা ও গোলাবর্ষণ চালিয়েছে। এতে শনিবার ভোর থেকে অন্তত সাতজন নিহত হয়েছেন। সিভিল ডিফেন্সের মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল এএফপিকে বলেন, রাতটি ছিল অত্যন্ত সহিংস। ইসরাইলী সেনারা গাজা নগরী ও উপত্যকার অন্যান্য এলাকায় বহু বিমান হামলা ও আর্টিলারি গোলাবর্ষণ চালিয়েছে, যদিও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বোমা হামলা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি জানান, রাতে এসব হামলায় ২০টি বাড়ি ধ্বংস হয়েছে।

গাজা নগরীর ব্যাপটিস্ট হাসপাতাল এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, শহরের তুফাহ এলাকায় একটি বাড়িতে হামলায় নিহতদের মধ্যে চারজনের মরদেহ এবং কয়েকজন আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে আনা হয়েছে। খান ইউনিসের নাসের হাসপাতাল জানিয়েছে, বাস্তুচ্যুতদের একটি শিবিরে তাঁবুর ওপর ড্রোন হামলায় দুই শিশু নিহত ও আটজন আহত হয়েছে।