বিবিসি : ভারতের নিকটতম প্রতিবেশীদের মধ্যে নেপাল তৃতীয় দেশ, যেখানে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সহিংস বিক্ষোভের পর সরকার পতন হয়েছে। সরকারবিরোধী বিক্ষোভের সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘাতে ২০ জনের বেশি নিহত হওয়ার পর নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা পদত্যাগ করেছেন। এই বিক্ষোভ উসকে দিয়েছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা। এই নিষেধাজ্ঞা এবং রাজনীতিবিদ ও সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গত সোমবার মূলত রাজধানী কাঠমান্ডুতে হাজারো মানুষ বিশেষ করে তরুণেরা সড়কে নেমে আসেন। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে সোমবার ১৯ জন এবং পরদিন মঙ্গলবার অন্তত দুজন নিহত হন। বিক্ষোভকারীরা দেশটির পার্লামেন্ট ভবন এবং বেশ কয়েকজন রাজনীতিবিদের বাড়ি ও দলীয় কার্যালয় ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ করে। নেপালজুড়ে কারফিউ জারি করা হয়েছে এবং সেনাবাহিনী দেশের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে।
কাঠমান্ডুর এসব দৃশ্য অনেককেই গত বছর বাংলাদেশে এবং ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় দেখা উথাল–পাথাল করা বিক্ষোভের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। কাঠমান্ডুর এসব দৃশ্য অনেককেই গত বছর বাংলাদেশে এবং ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় দেখা উথাল–পাথাল করা বিক্ষোভের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে।
যদিও বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কাও দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী, কাঠমান্ডুর সঙ্গে নয়াদিল্লির বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। দুই দেশের মানুষে-মানুষে সম্পর্ক এবং অর্থনৈতিক ও কৌশলগত যোগসূত্রগুলোর ঐতিহাসিক মাত্রা রয়েছে। ভারতের পাঁচটি রাজ্য উত্তরাখন্ড, উত্তর প্রদেশ, সিকিম, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে নেপালের প্রায় ১ হাজার ৭৫০ কিলোমিটার (৪৬৬ মাইল) দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। এই সীমান্তের প্রায় পুরোটাই খোলা। সীমান্তের ওপারে নেপালে কী ঘটছে, দিল্লি তা গভীর মনোযোগে দেখছে। নেপালের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দ্রুত নিজের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। গত মঙ্গলবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে এক পোস্টে মোদি লেখেন, ‘নেপালে চলমান সহিংসতা হৃদয়বিদারক। বহু তরুণের প্রাণহানি আমাকে গভীরভাবে ব্যথিত করেছে।’ তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘নেপালের স্থিতিশীলতা, শান্তি ও সমৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’ তিনি নেপালের সব ‘ভাই-বোনের প্রতি’ আবেদন করেছেন, তাঁরা যেন শান্তির সহায়ক হন।
পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করার জন্য মঙ্গলবার মোদি তাঁর মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠকও ডেকেছিলেন। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ঠিক যেমন ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় গণবিক্ষোভের মুখে তখনকার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের দেশত্যাগে বাধ্য হওয়ার ঘটনা ভারতকে অপ্রস্তুত করেছিল, তেমনি নেপালে যা ঘটেছে, সেটাও ভারতকে চমকে দিয়েছে। নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি গত মঙ্গলবার পদত্যাগ করেছেন। মাত্র এক সপ্তাহ পর তাঁর দিল্লি সফরে যাওয়ার কথা ছিল।
নেপালের কৌশলগত অবস্থানের কারণে দেশটিতে যেকোনো অস্থিরতা ভারতের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নেপাল বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) অশোক মেহতা বিবিসিকে বলেন, ‘চীনের ওয়েস্টার্ন থিয়েটার কমান্ড (পশ্চিমাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড) নেপালের সীমানার সরাসরি ওপারে অবস্থান করছে। ইন্দো-গাঙ্গেয় সমভূমিতে যাওয়ার পথও সরাসরি নেপালের মধ্য দিয়ে বিস্তৃত।’ ভারতে প্রবাসী নেপালিদের জন্যও নেপালের অস্থিরতার তাৎপর্য রয়েছে। ভারতে প্রায় ৩৫ লাখ নেপালি কাজ করেন অথবা বসবাস করেন। যদিও বিশেষজ্ঞদের মতে, তাঁদের প্রকৃত সংখ্যাটি আরও বড়। তারা নেপালে আরেকটি বাংলাদেশ ধাঁচের পরিস্থিতি চাইছে না। নেপাল প্রবলভাবে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। সীমান্তের উভয় পাশে বসবাস করা মানুষদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে।
দুই দেশের মানুষ নিজেদের মধ্যে ভিসা ও পাসপোর্ট ছাড়া চলাচল করে থাকেন। ১৯৫০ সালের একটি চুক্তির আওতায় নেপালিরা ভারতে অবাধে কাজ করতে পারেন। এ অঞ্চলে এমন সুযোগ আর ভোগ করে কেবল ভুটান। তার ওপর কয়েক দশকের পুরোনো একটি বিশেষ চুক্তির আওতায় নেপালের প্রায় ৩২ হাজার গুরখা সৈন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কাজ করছেন। দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সংগীতা থাপলিয়াল বলেন, ‘সীমান্ত খোলা থাকার কারণে (সীমান্তের দুই পাশের) মানুষজন একত্রে যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতার অংশীদার। উভয় পাড়ের পরিবারগুলো প্রতিদিনই একে অপরের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করতে পারে।’
নেপালে হিন্দুধর্মের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থানও রয়েছে। যেমন হিমালয় অঞ্চলের পাহাড়ে অবস্থিত মুক্তিনাথ মন্দির। প্রতিবছর ভারতের হাজারো তীর্থযাত্রী এই মন্দির দর্শনে যান। অন্যদিকে কাঠমান্ডু ভারতীয় রপ্তানির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল, বিশেষ করে খাদ্যপণ্য ও তেলের জন্য। ভারত-নেপাল বার্ষিক দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য প্রায় ৮৫০ কোটি ডলার। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) বর্তমানে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় রয়েছে। তাতে করে ভারতের জন্য প্রতিবেশী দেশগুলোতে রাজনৈতিক পরিবর্তন ও অস্থিরতার মোকাবিলা করা চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে।
দুই দিনের সহিংস বিক্ষোভ, রক্তপাত ও সরকার পতনের পর বুধবার কাঠমান্ডুর পরিস্থিতি খানিকটা শান্ত রয়েছে। তবে এই শান্তি একেবারেই ভঙ্গুর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কূটনৈতিক পদক্ষেপে ভারতকে এখন অত্যন্ত সাবধানী হতে হবে। কারণ, নেপালি বিক্ষোভকারীদের মধ্যে দেশটিতে সরকার পরিচালনা করা প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দলের প্রত্যেকটির প্রতি ব্যাপক ক্ষোভ রয়েছে। আর ভারত এই তিনটি দলের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখেছে। দলগুলো হচ্ছে অলির নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (সিপিএন-ইউএমএল), শের বাহাদুর দেউবার নেপালি কংগ্রেস এবং প্রচণ্ড নামে পরিচিত পুষ্প কমল দহলের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (মাওবাদী)। হিমালয়কন্যা নেপালের কৌশলগত অবস্থানের কারণে ভারত ও চীন—উভয়ই দেশটির ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চায়। এ কারণে এশিয়ার এই দুই পরাশক্তিকে বারবার নেপালের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার অভিযোগের মুখে পড়তে হচ্ছে। অলির সরকারের জায়গা নেপালে কী ধরনের প্রশাসন আসতে চলেছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে এমন একটি প্রশাসন আসতে হবে, যেটি বিক্ষোভকারীদের কাছেও গ্রহণযোগ্য হবে। নতুন সরকারের বা নেতৃত্বের রূপরেখা অনিশ্চিত হওয়ায় ভারত সতর্ক থাকবে বলে মনে করেন অধ্যাপক থাপলিয়াল। নেপালের ভেতরে দেশটির তরুণদের জন্য সুযোগ সীমিত। ভারতের উচিত নেপালি শিক্ষার্থীদের জন্য ফেলোশিপ বাড়ানো এবং আরও কর্মসংস্থানের সুযোগ দেওয়া।
দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় থাপলিয়াল বলেন, ‘তারা নেপালে আরেকটি বাংলাদেশ ধাঁচের পরিস্থিতি চাইছে না।’ বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দিল্লির বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। ভারত শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্র্বতী প্রশাসনের সঙ্গে দিল্লির সম্পর্কে টানাপোড়েন রয়েছে। নেপাল ও ভারতের মধ্যেও মতপার্থক্য রয়েছে। সেগুলোকে এখন বাড়তি যত্ন নিয়ে দেখভাল করতে হবে।