আল-জাজিরা : ইসরায়েল প্রায় দুই বছর ধরে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড গাজায় শতাব্দীর ভয়াবহ গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। এ গণহত্যার বিরুদ্ধে বড় বড় বিক্ষোভ হচ্ছে পশ্চিমা দুনিয়ায়, আবার সেখানেই অনেকে এ গণহত্যাকে গণহত্যা বলতে চান না। ২২ জুলাই নিউইয়র্ক টাইমস ইসরায়েলের এ গণহত্যাকে অস্বীকার করে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। সেটির বিপরীতে পরদিন নিউইয়র্ক টাইমস-এর সমালোচনা করে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে কাতারভিত্তিক আল-জাজিরা।

এটা কঠোর শোনাতে পারে, কিন্তু গাজায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে একটা বড় রকমের অসামঞ্জস্য আছে। ধরুন, যদি ইসরায়েলের উদ্দেশ্য ও কাজ সত্যিই গণহত্যামূলক হয়; অর্থাৎ তারা যদি গাজাবাসীকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য এতটাই নিষ্ঠুর হয়ে থাকে, তাহলে তারা আরও বেশি পরিকল্পিত এবং অনেক বেশি প্রাণঘাতী কেন হয়নি?

কেন মৃতের সংখ্যা লক্ষাধিক নয়। কেন মৃতের সংখ্যা ৬০ হাজারে সীমাবদ্ধ? আর এই সংখ্যা এসেছে হামাস-নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে। আর এই সংখ্যাটি এসেছে হামাস-নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে, যারা যোদ্ধা আর সাধারণ মানুষের মধ্যে পার্থক্য করে না।

ইসরায়েলের পক্ষে আরও বেশি ধ্বংস চালানো সম্ভব ছিল না, এমন নয়। তারা অঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক শক্তি। হিজবুল্লাহকে ধ্বংস করার পর এবং ইরানকে দুর্বল করে আরও শক্তিশালী হয়েছে। তারা চাইলে কোনো পূর্বসতর্কতা ছাড়াই বোমা ফেলতে পারত, কিন্তু সাধারণত গাজাবাসীকে আগেই জানানো হয় কোন এলাকায় হামলা হবে। তারা এমনও করতে পারত যে নিজেদের সেনাদের, যাঁদের অনেকেই যুদ্ধে নিহত হয়েছেন, ঝুঁকিতে না ফেলে কেবল আকাশপথে আক্রমণ চালাত। এমনও নয় যে গাজায় ইসরায়েলের জিম্মিরা থাকায় তারা হামলা থেকে বিরত থেকেছে। ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা বেশ ভালোভাবেই জানে, কোথায় এসব জিম্মিকে রাখা হয়েছে, আর এটাই একটি কারণ যে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া জিম্মিদের খুব বেশি মারা যায়নি। এবং এটা তারা জানে যে হামাস জিম্মিদের জীবিত রাখার পক্ষেই আগ্রহী।

কূটনৈতিক সমর্থনের দিক থেকেও ইসরায়েলের ঘাটতি নেই। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকাশ্যে বলেছেন, গাজার সবাইকে এলাকা ছাড়তে হবে এবং বারবার হুঁশিয়ার করেছেন যে হামাস জিম্মিদের ছেড়ে না দিলে গাজায় ‘নরক নেমে আসবে’। তাই প্রশ্ন আসে, যাঁরা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ তুলছেন, তাঁদের আগে বলা উচিতমৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি কেন নয়? উত্তর খুব সহজ: কারণ, ইসরায়েল গণহত্যা চালাচ্ছে না।

‘গণহত্যা’ শব্দটির একটি নির্দিষ্ট আইনগত এবং নৈতিক ব্যাখ্যা আছে, যা জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী হলো কোনো জাতীয়, জাতিগত, বর্ণগত বা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার ইচ্ছা। এখানে ‘ইচ্ছা’ এবং ‘গোষ্ঠী হিসেবে’Íএই শব্দ দুটি গুরুত্বপূর্ণ। গণহত্যা মানে কেবল অনেক বেসামরিক মানুষ মারা যাওয়া নয়। বরং এটি মানে কেবল কোনো গোষ্ঠীর সদস্য হওয়ার কারণে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার চেষ্টাযেমন হিটলার ও নাৎসিরা কেবল ইহুদি হওয়ার কারণে ইহুদিদের হত্যা করেছে, কিংবা রুয়ান্ডার গণহত্যায় হুতুরা তুতসিদের মেরেছে।

এটা সত্য যে গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ অনেক বেশি। ইসরায়েল যেসব কৌশল অবলম্বন করছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারেবিশেষত খাবার সরবরাহব্যবস্থা নিয়ে, যেখানে তারা চেয়েছে হামাসের হাত থেকে খাবারের নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নিতে। ইতিহাসে খুব কম সামরিক বাহিনীই এমন আছে, যাদের কোনো না কোনো যুদ্ধে কেউ না কেউ যুদ্ধাপরাধ করেনি। এই তালিকায় ইসরায়েলও পড়ে। অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির হামবুর্গ ও ড্রেসডেন শহরে বোমা হামলায় লাখ লাখ বেসামরিক মানুষ মারা গেলেও তাঁরা যুদ্ধের শিকার হয়েছেন। তাঁরা গণহত্যার শিকার নন। কারণ, মিত্রশক্তির লক্ষ্য ছিল জার্মান জাতিকে ধ্বংস করা নয়, বরং নাৎসিদের পরাজিত করা।

ইসরায়েলের সমালোচকেরা গাজায় যে ব্যাপক ধ্বংস হয়েছে, তা তুলে ধরেন। তাঁরা কিছু ইসরায়েলি রাজনীতিকের উসকানিমূলক বক্তব্যও তুলে ধরেন, যেগুলোয় গাজাবাসীকে অমানবিকভাবে চিত্রিত করা হয়। কিন্তু ৭ অক্টোবরের হামাসের ভয়ংকর হামলার পর এসব ক্ষুব্ধ মন্তব্যকে নাৎসি গণহত্যার পরিকল্পনার (যেমন ওয়ানসি সম্মেলন) সঙ্গে তুলনা করা যায় না। এবং আমি এমন কোনো প্রমাণ জানি না, যাতে বলা যায় যে ইসরায়েল পরিকল্পিতভাবে গাজাবাসীকে হত্যা করছে।

তবে এটা সত্য যে গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ অনেক বেশি। ইসরায়েল যেসব কৌশল অবলম্বন করছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারেÍবিশেষত খাবার সরবরাহব্যবস্থা নিয়ে, যেখানে তারা চেয়েছে হামাসের হাত থেকে খাবারের নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নিতে। ইতিহাসে খুব কম সামরিক বাহিনীই এমন আছে, যাদের কোনো না কোনো যুদ্ধে কেউ না কেউ যুদ্ধাপরাধ করেনি। এই তালিকায় ইসরায়েলও পড়ে। কিন্তু ত্রাণ বিতরণে ভুল, অতি সংবেদনশীল সেনা, ভুল টার্গেট কিংবা প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতিকদের বক্তব্যÍএসব দিয়ে ‘গণহত্যা’ প্রমাণ করা যায় না। এগুলো যুদ্ধের স্বাভাবিক ট্র্যাজেডির অংশ।

গাজাকে ঘিরে যে বিষয়টি বিশেষ, তা হলো হামাস যেভাবে যুদ্ধ করছে, তা একেবারেই অপরাধমূলক এবং ঠান্ডা মাথার হিসাব-কিতাব। যেমন ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার সময় সাধারণ মানুষ বাংকারে আশ্রয় নেন, আর সেনারা ওপরে থেকে লড়াই করেন। কিন্তু গাজায় এর উল্টোটা। সেখানে হামাস নিজেদের সুরক্ষিত রাখে টানেলের ভেতর আর সাধারণ মানুষ ওপরে থাকেন। এখানে একটা বিষয় ভেবে দেখা দরকার: একই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র কী করত? ২০১৬-১৭ সালে ওবামা ও ট্রাম্পের অধীন যুক্তরাষ্ট্র ইরাক সরকারকে সাহায্য করেছিল মসুল শহর দখলমুক্ত করতে। শহরটি তিন বছর ধরে আইএসের নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং টানেলে ভরা এক দুর্গে পরিণত হয়েছিল।

নিউইয়র্ক টাইমস- এই প্রকাশিত এক বর্ণনায় বলা হয়েছিল, মার্কিন বিমান হামলায় কখনো কখনো পুরো ব্লক ধ্বংস হয়ে যেত। মসুলের জিদিদেহ এলাকায় এমন এক হামলায় ২০০ জন বেসামরিক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। আইএস তখন বেসামরিক মানুষদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করত এবং বেপরোয়া স্নাইপার ও মর্টার হামলা চালাত। ৯ মাস ধরে চলা এই যুদ্ধ ছিল দুই দলেরই সমর্থনপুষ্ট রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক পার্টি উভয়ের। অনেকে বলেন, এতে প্রায় ১১ হাজার বেসামরিক মানুষ মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় বিক্ষোভ হয়েছিল বলে মনে পড়ে না। কিছু পাঠক বলতে পারেনযদিও এই যুদ্ধ গণহত্যা না হয়, তা–ও এটা অনেক দীর্ঘ হয়ে গেছে এবং এর এখনই শেষ হওয়া দরকার। এটা যৌক্তিক দাবি এবং বেশির ভাগ ইসরায়েলিও তা বিশ্বাস করেন। কিন্তু তাহলে ‘গণহত্যা’ শব্দটি নিয়ে এত বিতর্ক কেন? বিতর্ক দুটি কারণে।

প্রথমত, অনেক চিন্তাবিদ হয়তো আন্তরিকভাবে ‘গণহত্যা’ শব্দটি ব্যবহার করেন। কিন্তু কিছু লোক এই শব্দ ব্যবহার করেন ইচ্ছাকৃতভাবে ইসরায়েলকে নাৎসি জার্মানির সঙ্গে তুলনা করার জন্য। এতে শুধু ইসরায়েল সরকার নয়, বরং যেকোনো ইহুদি (যিনি ইসরায়েলকে সমর্থন করেন), তাঁকেও গণহত্যার পক্ষে দাঁড়ানো ব্যক্তি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। বহু বছর ধরেই ইসরায়েলবিরোধীরা বিভিন্ন মিথ্যা বা অতিরঞ্জিত অভিযোগ তোলে। ‘গণহত্যা’ শব্দটি এখন সেই একই কৌশলের আরও ভয়ংকর রূপ। দ্বিতীয়ত, ‘গণহত্যা’ শব্দটি ১৯৪০-এর দশকে তৈরি হয়েছিল এবং এটি এককভাবে ভয়াবহ অপরাধ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। এই শব্দকে যদি আমরা প্রতিটি অপছন্দের সামরিক সংঘাতে ব্যবহার করি, তাহলে ভবিষ্যতের আসল গণহত্যার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলব।