সোমবার দিনভর ইসরাইলী বিমান বাহিনীর গোলাবর্ষণে ফিলিস্তিনের গাজার উপত্যকায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৯৪ জন এবং আহত হয়েছেন আরও অন্তত ৪৩৯ জন। এদিন সন্ধ্যার পর এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় অভিযান শুরু করে আইডিএফ। মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বুধবারের পর ইসরাইলী বাহিনীর অভিযানে গাজায় মোট নিহতের সংখ্যা পৌঁছেছে ৬০ হাজার ৯৩৩ জনে। এদের পাশাপাশি আহত হয়েছেন আরও ১ লাখ ৫০ হাজার ২৭ জন ফিলিস্তিনি। “দখলদার বাহিনীর বোমার শিকারদের অনেকেই ধ্বংসস্তূপের তলায় আটকা পড়ে আছেন। প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও লোকবলের অভাবে তাদের উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না”, সোমবারের বিবৃতিতে বলেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। আনাদুলু, আল-জাজিরা, রয়টার্স।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ত্রাণের খাবার নিতে আসা ফিলিস্তিনিদের ওপরও হামলা করছে ইসরাইলী বাহিনী। সোমবার গাজার বিভিন্ন এলাকায় ত্রাণ নিতে এসে নিহত হয়েছেন ২৯ জন ফিলিস্তিনি এবং আহত হয়েছেন আরও ৩০০ জন। ’২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইলের ভূখণ্ডে ঢুকে অতর্কিত হামলা চালায় গাজা উপত্যকা নিয়ন্ত্রণকারী সশস্ত্র রাজনৈতিক গোষ্ঠী হামাসের যোদ্ধারা। এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে ১ হাজার ২০০ জনকে হত্যার পাশাপাশি ২৫১ জনকে জিম্মি হিসেবে ধরে নিয়ে যায় তারা। হামাসের হামলার জবাব দিতে এবং জিম্মিদের মুক্ত করতে ওই দিন থেকেই গাজায় অভিযান শুরু করে ইসরাইলী বাহিনী। ১৫ মাসেরও বেশি সময় ধরে টানা অভিযান চালানোর পর যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যস্থতাকারী অন্যান্য দেশগুলোর চাপে বাধ্য হয়ে গত ১৯ জানুয়ারি গাজায় যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে ইসরাইল। কিন্তু বিরতির দু’মাস শেষ হওয়ার আগেই গত ১৮ মার্চ থেকে ফের গাজায় অভিযান শুরু করে আইডিএফ। দ্বিতীয় দফার এ অভিযানে গত চার মাসে গাজায় নিহত হয়েছেন ৯ হাজার ৪৪০ জন ফিলিস্তিনি এবং আহত হয়েছেন আরও প্রায় ৩৭ হাজার ৯৮৬ জন।
যে ২৫১ জন জিম্মিকে হামাসের যোদ্ধারা ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তাদের মধ্যে অন্তত ৩৫ জন এখনও জীবিত আছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। সামরিক অভিযানের মাধ্যমে তাদের উদ্ধার করার ঘোষণা দিয়েছে আইডিএফ।
জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার গাজায় সামরিক অভিযান বন্ধের জন্য ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে আহ্বান জানিয়েছে। ইতোমধ্যে জাতিসংঘের আদালত নামে পরিচিত ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে (আইসিজে) ইসরাইলের বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলাও দায়ের করা হয়েছে। তবে নেতানিয়াহু জানিয়েছেন, হামাসকে পুরোপুরি দুর্বল ও অকার্যকর করা এবং জিম্মিদের মুক্ত করা এই অভিযানের লক্ষ্য এবং লক্ষ্য পূরণ না হওয়া পর্যন্ত অভিযান চলবে গাজায়।
ফিলিস্তিনের নিন্দা তীরে অবৈধ ইহুদি বসতি পরিদর্শনে মার্কিন স্পিকার
অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইহুদিদের একটি অবৈধ বসতি পরিদর্শন করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার মাইক জনসন। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ফিলিস্তিনিরা। ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকারের গত সোমবারের এ সফর আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। মাইক জনসন যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় সর্বোচ্চ পদমর্যাদায় থাকা ব্যক্তি। সাংবিধানিকভাবে প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্টের পরই তাঁর অবস্থান। পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি পরিদর্শন করা যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা তিনি।
পশ্চিম তীরে গত জুলাইয়ে ফিলিস্তিনিদের ওপর বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতায় যুক্তরাষ্ট্রের দুজন নাগরিকও নিহত হন। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার চলা অবস্থায় পশ্চিম তীরে গেলেন জনসন। ফিলিস্তিনের গাজায় নৃশংস আক্রমণ ও অবরোধ চলা অবস্থায় ইসরাইলী সামরিক বাহিনী পশ্চিম তীরেও একের পর এক প্রাণঘাতী তল্লাশি অভিযান, ঘরবাড়ি ভাঙচুর এবং বাস্তুচ্যুতির লক্ষ্যে অভিযান জোরালো করেছে। এ পরিস্থিতিতে জনসনের পশ্চিম তীর সফরের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে ফিলিস্তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরও বলেছে, এ সফর ‘সহিংসতার চক্রের অবসান’ করার জন্য আরব দেশগুলো ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টার পরিপন্থী। সেই সঙ্গে এটা বসতি স্থাপনকারীদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ওয়াশিংটনের সাধারণ মানুষের অবস্থানের বিরোধী। মন্ত্রণালয় জানায়, তারা এটা নিশ্চিত করছে যে বসতি স্থাপনের সব কার্যকলাপ অবৈধ ও বেআইনি। এটা দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের (ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকটের) বাস্তবায়ন ও শান্তি অর্জনের সুযোগ ক্ষুণন করে। ইসরাইলের সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনের তথ্য, গতকাল রামাল্লার উত্তরে অ্যারিয়েল এলাকায় ইহুদি বসতি পরিদর্শন করেছেন জনসন। পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি স্থাপন আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অবৈধ। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গত বছর তাঁর অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেন, অধিকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলে ইসরাইলের উপস্থিতি বেআইনি এবং ‘যত দ্রুত সম্ভব’ তা বন্ধ করতে হবে। জনসনের পরিদর্শনের বিষয়ে জানতে চাইলে জাতিসংঘের মুখপাত্র ফারহান হক গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘বসতি স্থাপনের বিষয়ে আমাদের অবস্থান আপনারা জানেন-আন্তর্জাতিক আইনে এটা অবৈধ।’ ১৯৬৭ সালে পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম দখলে নেয় ইসরাইল। আর ১৯৮০ সাল থেকে পবিত্র শহরটি পুরোপুরি ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
পুরোটাই দখলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেতানিয়াহুর
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার পুরোটাই দখলে নেওয়ার পরিকল্পনা ঘোষণা করতে যাচ্ছেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ইসরাইলের একাধিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে এমনটা জানানো হয়েছে। এই পরিকল্পনার বিষয়ে গত সোমবার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ইসরাইলী সংবাদমাধ্যম । এসব প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর এ সিদ্ধান্তের ফলে ইসরাইলী সামরিক বাহিনী পুরো গাজায় অভিযান সম্প্রসারণ করবে। এর মধ্যে হামাসের হাতে জিম্মি থাকা ব্যক্তিদের যেসব এলাকায় রাখা হয়েছে, সেগুলোও থাকবে। ‘সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে’ নেতানিয়াহুর দপ্তরের নাম প্রকাশ না করা একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা চ্যানেল ১২–এর প্রধান রাজনৈতিক বিশ্লেষক অমিত সেগাকে এ কথা বলেছেন।
ওই কর্মকর্তা অমিতকে বলেছেন, ‘পুরোপুরি আত্মসমর্পণ না করলে হামাস নতুন করে কোনো জিম্মিকে মুক্তি দেবে না। আমরাও আত্মসমর্পণ করব না। তাই এখনই পদক্ষেপ না নিলে জিম্মিরা না খেয়ে মারা যাবেন এবং গাজা হামাসের নিয়ন্ত্রণেই থাকবে।’ সংবাদমাধ্যমে এমন খবর প্রকাশের পর নেতানিয়াহুর এমন পরিকল্পনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পরিকল্পনাটি রুখে দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ চাওয়া হয়েছে।
হামাসের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ওসামা হামদান গতকাল যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতি ইসরাইলী নৃশংসতার বিরুদ্ধে ‘চোখ বন্ধ রাখার’ অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেন, একগুঁয়েমি, অহংকার ও যুদ্ধবিরতি চুক্তি নিয়ে গরিমসি করার কারণে ইসরাইলী জিম্মিদের জীবনকে ‘ঝুঁকিতে ফেলার’ দায় নেতানিয়াহুর। হামাসনিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় দুই বছর চলা যুদ্ধে ৬০ হাজার ৯৩০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে শিশুর সংখ্যা অন্তত ১৮ হাজার ৪৩০। ইসরাইলী কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, হামাসের হাতে এখনো ৪৯ জন জিম্মি রয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, তাঁদের মধ্যে ২৭ জন আর বেঁচে নেই।