রয়টার্স: ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। ফলে দখলদার সেনারা গাজার কিছু অংশ থেকে পিছু হটতে শুরু করেছে। এতেই কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে অবরুদ্ধ উপত্যাকাটিতে। হাজার হাজার বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি গতকাল শুক্রবার তাদের পরিত্যক্ত বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েলের অন্যতম বৃহৎ সামরিক নির্মম অভিযানের শিকার হয় গাজা সিটি। যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর ধুলোমাখা পথ ধরে বিশাল এক বাস্তুচ্যুত মানুষের স্রোতকে শহরটির দিকে এগিয়ে যেতে দেখা গেছে। গাজা সিটির শেখ রাদওয়ান এলাকার ৪০ বছর বয়সী ইসমাইল জায়দা এই খবরে স্বস্তি প্রকাশ করেছে। তিনি রয়টার্সকে বলেন, আল্লাহকে ধন্যবাদ যে আমার বাড়িটি এখনও দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু চারপাশ ধ্বংস হয়ে গেছে, আমার প্রতিবেশীদের বাড়িঘরসহ পুরো এলাকা নিশ্চিহ্ন। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, স্থানীয় সময় দুপুর ১২টায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর হয়েছে। গতকাল শুক্রবার ভোরের দিকে ইসরায়েলের সরকার হামাসের সঙ্গে এই যুদ্ধবিরতি অনুমোদন দেয়। যার ফলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গাজায় আংশিক সেনা প্রত্যাহার এবং পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ স্থগিতের পথ সুগম হয়।
চুক্তি অনুযায়ী, হামাস ৭২ ঘণ্টার মধ্যে জীবিত থাকা ২০ জন ইসরায়েলি জিম্মিকে হামাসকে মুক্তি দেবে বলে আশা করা হচ্ছে। এর বিনিময়ে ইসরায়েল কারাগার থেকে ২৫০ জন দীর্ঘমেয়াদি সাজাপ্রাপ্ত ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেবে। পাশাপাশি যুদ্ধ চলাকালীন গাজায় আটক ১৭০০ জনকে মুক্তি দেওয়া হবে। চুক্তি কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গাজায় শত শত ট্রাক ভর্তি খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা পৌঁছাবে। ইসরায়েলি বাহিনীর আক্রমণে ঘরবাড়ি হারানো ও তাঁবুতে আশ্রয় নেওয়া লাখ লাখ বেসামরিক মানুষের জন্য এই সাহায্য অপরিহার্য।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুদ্ধ অবসানের উদ্যোগের প্রথম পর্বে গাজার প্রধান শহরাঞ্চল থেকে ইসরায়েলি বাহিনী প্রত্যাহার করা হবে। তবে উপত্যকার প্রায় অর্ধেক এলাকার নিয়ন্ত্রণ থাকবে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতেই। টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ট্রাম্পের পরিকল্পনার পরবর্তী ধাপগুলোতে গাজা যাতে সামরিকীকরণমুক্ত হয় এবং হামাস যাতে অস্ত্র সমর্পণ করে; তা নিশ্চিত করতে ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় অবস্থান করবে। তিনি বলেন, যদি এটা সহজে অর্জন করা যায় তবে ভালো, আর যদি না হয় তবে তা কঠিন উপায়ে অর্জন করা হবে।
গাজার দক্ষিণে খান ইউনিসে কিছু ইসরায়েলি সেনা সীমান্ত সংলগ্ন পূর্বাঞ্চল থেকে পিছু হটেছে। তবে বাসিন্দাদের সাথে রয়টার্সের যোগাযোগ অনুযায়ী এখনও কোথাও কোথাও গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। গাজার কেন্দ্রে নুসিরাত ক্যাম্পে কিছু সেনাকে পূর্ব ইসরায়েল সীমান্তের দিকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। তবে ভোরের দিকে গোলাগুলির শব্দের পর অন্য সেনারা এলাকাতেই রয়ে যায়। গাজা সিটির দিকে ভূমধ্যসাগরীয় উপকূল বরাবর রাস্তা থেকে ইসরায়েলি বাহিনী সরে গেছে। ৪০ বছর বয়সী মাহদি সাকলা তার আবেগ বলেন, যুদ্ধবিরতির খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা খুব খুশি হয়ে গাজা সিটিতে আমাদের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলাম। যদিও সেখানে কোনো বাড়ি নেই। সব ধ্বংস হয়ে গেছে। তবুও আমরা শুধু আমাদের বাড়ির জায়গায়, এমনকি ধ্বংসস্তূপের ওপর ফিরতে পেরেও আনন্দিত। দুই বছর ধরে আমরা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বাস্তুচ্যুত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। হামাসের নির্বাসিত গাজা প্রধান খলিল আল-হায়া জানিয়েছেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য মধ্যস্থতাকারীদের কাছ থেকে যুদ্ধ শেষ হওয়ার বিষয়ে নিশ্চয়তা পেয়েছেন।
এই সংঘাতের ফলে ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা বেশ বেড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক সংঘাত ছড়িয়ে পড়েছে। ইরান, ইয়েমেন এবং লেবানন জড়িয়ে পড়েছে সংঘাতে। এটি মার্কিন-ইসরায়েল সম্পর্ককেও কঠিন পরীক্ষার মুখে ফেলেছিল। ট্রাম্পকেও নেতানিয়াহুর ওপর চুক্তির জন্য চাপ দিতে দেখা গেছে। এই যুদ্ধে ৬৭ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তবে এখনও কিছু বাধা রয়ে গেছে। যার মধ্যে ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি তালিকা প্রকাশ এবং যুদ্ধ শেষ হলে ধ্বংসস্তূপ হয়ে যাওয়া গাজার শাসনভার কার হাতে থাকবে, তা নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপের বিষয়ে এখনও চুক্তিবদ্ধ হওয়া বাকি। হামাস এখনও ইসরায়েলের নিরস্ত্রীকরণের দাবি মেনে নেয়নি।