রয়টার্স, এএফপি : পৃথিবীর ইতিহাসে এমন অনেক শহর ছিল, যেগুলোতে একসময় মানুষ বসবাস করতেন। সেগুলো ব্যবসা-বাণিজ্য, ধর্মীয় আচার ও সংস্কৃতির কেন্দ্র ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেসব শহর ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে গেছে। কোনোটি ধ্বংস হয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগে কিংবা শত্রুপক্ষের আক্রমণে, কোনোটি আবার পরিত্যক্ত হয়েছে পরিবেশগত পরিবর্তনের কারণে। ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাস ধ্বংস হয়ে যাওয়া এমন ১০টি পুরোনো শহরের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। সেই প্রতিবেদনের আলোকে ১০টি হারিয়ে যাওয়া শহরের পরিচয় পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো।

মাচুপিচু, পেরু

দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরুর উরুবাম্বা উপত্যকার ওপর প্রায় আড়াই হাজার মিটার উচ্চতায় ইনকা সভ্যতার প্রাচীন শহর মাচুপিচুর অবস্থান। ১৪৫০-এর দশকে ইনকা সম্রাট পাচাকুতি এ শহরের গোড়াপত্তন করেন। এটি ছিল ইনকা সভ্যতার ধর্মীয় ও প্রশাসনিক কেন্দ্র। অঞ্চলটিতে স্পেনের দখলদার বাহিনী ঢোকার পর ষোড়শ শতকে শহরটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষক হিরাম বিংহাম ১৯১১ সালের ২৪ জুলাই মাচুপিচুকে নতুন করে বিশ্বের নজরে নিয়ে আসেন।

পেত্রা, জর্ডান

ধারণা করা হয়, খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের দিকে পেত্রা নগরী গড়ে ওঠে। লোহিত সাগর থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে জর্ডানের দক্ষিণ-পশ্চিমের শহর ওয়াদি মুসার ঠিক আগে হুর পাহাড়ের পাদদেশে এর অবস্থান। পেত্রা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্র। প্রায় দুই হাজার বছর ধরে মৃত সাগর ও লোহিত সাগরের মধ্যকার একটি বাণিজ্যপথ হিসেবে এটিকে ব্যবহার করা হতো। সিরিয়া, মিসর ও আরব দেশ থেকে আসা ব্যবসায়ীরা এখানে মিলিত হতেন।

শহরটি পাথরের গায়ে খোদাই করা স্থাপত্যের জন্য বিখ্যাত ছিল। এখানে একসময় ৩০ হাজারের বেশি মানুষ বাস করতেন। শহরটিতে ছিল জলের কুয়ো, বাগান, প্রাসাদ, মন্দির, নাট্যমঞ্চসহ নানা কাঠামো। ৩৬৩ খ্রিষ্টাব্দে ভূমিকম্পে শহরটি আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং পরে আরবদের দখলে যাওয়ার পর এটি পুরোপুরি পরিত্যক্ত হয়। ১৮২২ সালে সুইস পরিব্রাজক জোহান লুডিগ নতুন করে এই শহরের সন্ধান পান।

পম্পেই, ইতালি

রোমান সাম্রাজ্যের ঐতিহ্যবাহী শহর ছিল পম্পেই। ইতালির ক্যাম্পানিয়া প্রদেশের নেপলস শহরের অদূরে অবস্থিত শহরটি ছিল রোমান সাম্রাজ্যের বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। ৭৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ আগস্ট ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে মুহূর্তেই শহরটি ছাই ও পাথরে চাপা পড়ে যায়। মর্মান্তিক এ ঘটনায় হাজারো মানুষ মারা যান। এরপর শহরটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। ১৫৯২ সালে একটি খাল খননের সময় শহরটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। তবে ১৮৬০ সালের আগে সেখানে বড় ধরনের কোনো খননকাজ চালানো হয়নি। অবশ্য আজও শহরের এক-তৃতীয়াংশ মাটির নিচে চাপা পড়ে আছে।

সিউদাদ পেরদিদা, কলম্বিয়া

স্প্যানিশ ভাষায় সিউদাদ পেরদিদার অর্থ হলো হারানো নগরী। কলম্বিয়ায় আন্দিজ পর্বতমালার সিয়েরা নেভাদা দে সান্তা মারতা অঞ্চলে ৮০০ খ্রিষ্টাব্দে শহরটি গড়ে উঠেছিল। সে হিসাবে মাচুপিচুর চেয়ে প্রায় ৬৫০ বছরের পুরোনো এটি। স্থানীয় আদিবাসীদের কাছে শহরটি ‘তেয়ুনা’ নামে পরিচিত ছিল। সিউদাদ পেরদিদাতে ছিল পাহাড়ের ঢাল কেটে বানানো ১৬৯টি ট্যারেস, টাইলসযুক্ত রাস্তার একটি নেটওয়ার্ক এবং বেশ কয়েকটি ছোট গোলাকার জায়গা। স্প্যানিশ দখলদার বাহিনীর অভিযানের পর শহরটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়। ১৯৭২ সালে কিছু লুটেরা সোনা খুঁজতে গিয়ে শহরটি খুঁজে পায়। ১৯৮২ সালে এর পুনর্গঠনের কাজ শেষ হয়।

মেমফিস, মিসর

মিসরের একটি প্রাচীন শহর মেমফিস। প্রায় তিন হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মেনেস নামের এক ফেরাউন এই শহর প্রতিষ্ঠা করেন। গিজার প্রায় ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে এর অবস্থান ছিল।

ধারণা করা হয়, মেনেস এই শহরকে একটি দুর্গ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। সেখান থেকে তিনি ডেলটা ও মিসরের দক্ষিণ ভাগের মধ্যকার বাণিজ্যপথ নিয়ন্ত্রণ করতেন। এর অবস্থান নীল নদের মুখে হওয়ায় এটি প্রাকৃতিকভাবে আকর্ষণীয় স্থান হয়ে ওঠে এবং একসময় গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় কেন্দ্রেও পরিণত হয়। বর্তমানে এটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান হিসেবে পরিচিত এবং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটনকেন্দ্র। সপ্তম শতকে শহরটি চিরতরে পরিত্যক্ত হয়।

তক্ষশিলা, পাকিস্তান

পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত একটি প্রাচীন শহর তক্ষশিলা। একে ‘কাটা পাথরের শহর’ নামেও ডাকা হয়। মধ্য এশিয়া ও ভারতীয় উপমহাদেশের সংযোগস্থলে তক্ষশিলার অবস্থান। ধারণা করা হয়, শহরটি খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ সালের দিকে গড়ে উঠেছিল। এর কিছু ধ্বংসাবশেষ পারস্য সাম্রাজ্যের সময়কার।

কৌশলগত অবস্থানের কারণে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই শহরের দখল অনেকবার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু পরে বাণিজ্য কমে যাওয়া এবং কিদারি, আলচন হুন ও শ্বেত হুনদের আক্রমণে শহরটি তার গুরুত্ব হারায়।

হেদেবি, জার্মানি

হেদেবি জার্মানির একটি প্রাচীন শহর। অষ্টম থেকে একাদশ শতক পর্যন্ত এই শহর ভাইকিংদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বর্তমান জার্মানির শ্লেসভিগ-ফ্লেনসবুর্গ অঞ্চলে এর অবস্থান ছিল। প্রায় ৭৭০ সালের দিকে বাল্টিক সাগরের কাছে শ্লে নামে একটি সরু জলপথের পাশে একটি বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে হেদেবি গড়ে ওঠে। প্রায় ৪০ বছর পর ডেনমার্কের রাজা গডফ্রেড রেরিক শহরের ব্যবসায়ীদের হেদেবিতে নিয়ে আসেন। এতে শহরটি উন্নতির পথে এগোতে থাকে। তবে পরে নরওয়ের রাজা হ্যারাল্ড হার্দরাদা ডেনমার্কের রাজা দ্বিতীয় সোয়েনের সঙ্গে যুদ্ধকালে শহরটি ধ্বংস করে দেন।

গ্রেট জিম্বাবুয়ে, জিম্বাবুয়ে

গ্রেট জিম্বাবুয়ে ছিল একটি প্রাচীন রাজ্যের রাজধানী শহর। বর্তমান জিম্বাবুয়ের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ে এর অবস্থান। তবে ঠিক কোন রাজ্য এই শহরকে রাজধানী হিসেবে ব্যবহার করেছিল, তা নিশ্চিত করে জানা যায়নি। শহরটির চারদিকে পাথরের ধ্বংসাবশেষগুলো ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে। এই শহরের নাম থেকেই বর্তমান দেশ ‘জিম্বাবুয়ে’-এর নামকরণ হয়েছে। স্থানীয় বান্টু জনগোষ্ঠীর মানুষেরা ১১ থেকে ১৫ শতকের মধ্যে এই শহর গড়ে তোলে। শহরটি প্রায় ৭ দশমিক ২২ বর্গকিলোমিটার জায়গাজুড়ে বিস্তৃত ছিল। শহরটিতে প্রায় ১৮ হাজার মানুষ বসবাস করতেন। রাজনৈতিক অস্থিরতা, পানির সংকট ও বাণিজ্য কমে যাওয়ার কারণে শহরটি পরিত্যক্ত হয়ে থাকতে পারে।

কারাকোরাম, মঙ্গোলিয়া

কারাকোরাম মঙ্গোলিয়ার একটি প্রাচীন শহর। মঙ্গোলিয়ার ওভোরখাংগাই প্রদেশে এর অবস্থান। ত্রয়োদশ থেকে পঞ্চদশ শতকের মধ্যে এর অস্তিত্ব ছিল এবং তা মঙ্গোলীয় সাম্রাজ্য ও উত্তরাঞ্চলীয় ইউয়ানের রাজধানী হিসেবে কাজ করেছিল। একসময়ের প্রাণচঞ্চল এই শহরের ধ্বংসাবশেষ এখন খারখোরিন এলাকার কাছে ছড়িয়ে আছে। ধারণা করা হয়, ১২২০ সালে শহরটির নির্মাণ শুরু হয়েছিল। তবে ১২৩৫ সাল পর্যন্ত এটি একটি ছোট শহরই ছিল। তবে ওগেদেই খান ও তাঁর উত্তরসূরিদের শাসনামলে কারাকোরাম একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর ও রাজনৈতিক কেন্দ্র হয়ে ওঠে। ১৩৮৮ সালে মিং সেনাদের আক্রমণের পর থেকে কারাকোরামের পতন শুরু হয়। পরে ষোড়শ শতকে শহরটি পুরোপুরি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে।

অ্যাংকর, কম্বোডিয়া

অ্যাংকর ছিল খেমার সাম্রাজ্যের রাজধানী। একসময় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বড় একটি অংশ খেমার সাম্রাজ্যের শাসনাধীন ছিল। শত শত বছর আগে খেমার সাম্রাজ্যের পতনের পর অ্যাংকর শহরটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে এবং ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়। বর্তমান কম্বোডিয়ার টোনলে সাপ হ্রদের উত্তর দিকে বন ও কৃষিজমির মধ্যে প্রাচীন শহরটির ধ্বংসাবশেষ অবস্থিত। এটি এখন একটি জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র। এখানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মন্দির কমপ্লেক্সের অবস্থান।