আল-জাজিরা : শীতের সকাল। সাদা তুষারে ঢাকা মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে আছেন মালিক হারুন। কাঠবাদামের একটি গাছের ছালে আঙুল বুলিয়ে দেখছেন ছত্রাকের কোনো দাগ আছে কিনা। ‘সব ঠিক আছে,’ হাসি মুখে বললেন ২৭ বছর বয়সি হারুন। তবে তার সেই হাসিমাখা মুখেও কেমন যেন এক আতঙ্কের ছাপ। হয়তো হারানোর ভয়! ভারতশাসিত কাশ্মীরের পুলওয়ামা জেলায় রুমশি নাল্লা নদীর ধারে তার ১.২৫ একরের (০.৫ হেক্টর) বাগান। প্রতিবছর প্রায় ৩০ টনের আপেল, নাশপাতি, বরই ও কাঠবাদাম ফলায়। কিন্তু ভারত সরকারের সিদ্ধান্ত- এই জমিতেই একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ নির্মাণ করা হবে। এই সিদ্ধান্ত শুধু হারুনের নয়, বরং হাজারো চাষির জীবিকার পথ ধ্বংস করে দেবে। এই জমি প্রায় ৪০ লাখ মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস। ২০১৯ সারের ৫ আগস্ট কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদার ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল ও স্বায়ত্তশাসন রদের পর থেকেই উন্নয়নের আড়ালে এভাবেই দখল হচ্ছে কাশ্মীর ভূখণ্ড। মোদি সরকারের এই নীরব দখল নিয়েই জম্মু ও কাশ্মীরের মাটি আজ এক অদৃশ্য টানাপোড়েনের ক্ষেত্র। গত কয়েক বছরে কেন্দ্রশাসিত এই অঞ্চলে উন্নয়ন প্রকল্পের নামে জমি অধিগ্রহণের গতি বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে ক্ষোভ ছড়িয়েছে। রেললাইন, জাতীয় সড়ক, পর্যটন কেন্দ্র বা সামরিক অবকাঠামো নির্মাণ, যে কারণই দেখানো হোক না কেন, স্থানীয়দের অভিযোগ, এসব কিছুর আড়ালে বহু প্রজন্ম ধরে চাষাবাদ ও বসবাসের জমি ‘রাষ্ট্রীয়’ বলে ঘোষণা করে দখল করে নিচ্ছে প্রশাসন। রাস্তা, রেললাইন, টানেল ও আবাসন প্রকল্পের ঝড়ে হারিয়ে যাচ্ছে উর্বর জমি তথা কৃষকের জীবিকা। নষ্ট হচ্ছে ফলের বাগান ও চারণভূমি। নরেন্দ্র মোদির সরকার অবশ্য বলছে, কেবল উন্নয়নের জন্যই এসব প্রকল্প। কিন্তু কাশ্মীরিদের চোখে এগুলো এক নীরব দখল অভিযান। নতুন নতুন বসতি স্থাপনের ছল। যা বদলে দিচ্ছে জমির মানচিত্র, জনবিন্যাস আর ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা। কেন্দ্র বলছে, এগুলো কেবলমাত্র উন্নয়নমূলক উদ্যোগ। কিন্তু স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে যে প্রশ্ন জোরালো হচ্ছে- উন্নয়ন কি সত্যিই উন্নয়ন, নাকি জনসংখ্যাগত রূপান্তরের একটি নীরব কৌশল? উপত্যকার পাহাড়ি হাওয়া এই প্রশ্নের উত্তর এখনো বহন করছে তা অমীমাংসিত। অথচ গভীরভাবে রাজনৈতিক। ‘শুধু এই ফলনের মাধ্যমেই আমি বছরে গড়ে ১১,০০০ ডলার আয় করি। ২০১৯ সালের পর থেকে এই আয় আমার চার সদস্যের পরিবারকে অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও বেকারত্বের সংকট থেকে রক্ষা করেছে।’ সে বছর (২০১৯) ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে। এই মর্যাদা কাশ্মীরের নিজস্ব আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দিয়েছিল। আর বাইরের মানুষদের সরকারি চাকরি ও সম্পত্তি কেনা থেকে বিরত রাখত। যাতে স্থানীয়দের অধিকার সুরক্ষিত থাকে। কিন্তু বিশেষ এই মর্যাদা বাতিলের পর মোদি সরকার অঞ্চলটিকে ভেঙে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে রূপান্তরিত করে- জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখ। এরপর থেকেই কেন্দ্র সরকার বহু অবকাঠামো প্রকল্প ঘোষণা করে আসছে।

সরকার বলছে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও যোগাযোগ বাড়াতেই এই পরিকল্পনাগুলো করা হচ্ছে। কিন্তু স্থানীয়দের আশঙ্কা- এই প্রকল্পগুলো আসলে নয়াদিল্লির নিয়ন্ত্রণ শক্ত করা, বাইরের মানুষ দিয়ে বসতি স্থাপনের মাধ্যমে জনবিন্যাস পরিবর্তন করা এবং চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের উত্তেজনাপূর্ণ সীমান্ত এলাকায় প্রবেশাধিকার বাড়ানোর কৌশল।

লিগ্যাল ফোরাম ফর কাশ্মীর-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, শুধুমাত্র গত বছরেই ‘অ্যান্টি-এনক্রোচমেন্ট’ অভিযানের নামে উপত্যকায় ১ লাখ ৭৮ হাজার একরেরও বেশি জমি এবং জম্মুতে ২৫ হাজার একরের বেশি জমি সরকারের হাতে চলে গেছে। সংগঠনটির দাবি, এই জমিগুলোর বড় অংশ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কৃষিজমি হিসাবে ব্যবহার হলেও হঠাৎ করে ‘রাষ্ট্রীয় জমি’ বলে চিহ্নিত করা হয়। সংগঠনটির দাবি, এই জমিগুলোর বড় অংশ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কৃষিজমি হিসাবে ব্যবহার হলেও হঠাৎ করে ‘রাষ্ট্রীয় জমি’ বলে চিহ্নিত করা হয়। প্রশাসনের যুক্তি আলাদা। জম্মু ও কাশ্মীরের এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, ‘উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও পর্যটনের বৃদ্ধির জন্য এই প্রকল্প অপরিহার্য। ক্ষতিপূরণ আইন মেনেই দেওয়া হচ্ছে।’ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার করতে কিছু এলাকায় জমি অধিগ্রহণ হয়েছে, যা সম্পূর্ণ বৈধ ও প্রয়োজনীয়।

তবে মাটির মালিকদের ক্ষোভ ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। শ্রীনগরের এক বৃদ্ধ কৃষক বললেন, ‘আজ জমি নিচ্ছে উন্নয়নের নামে, কাল বাইরের লোক এসে এখানে বসবাস শুরু করবে। আমাদের ভবিষ্যৎ কোথায়?’

পুলওয়ামায় এনআইটি প্রকল্প: সবচেয়ে বেশি বিতর্ক তৈরি করেছে পুলওয়ামায় একটি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এনআইটি) প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা। সরকারি বিজ্ঞপ্তি (২৪ ডিসেম্বর) অনুসারে, ৬০০ একর (২৪৩ হেক্টর) জমি অধিগ্রহণ করা হবে। যার বেশিরভাগই কৃষি, বাগান ও গবাদিপশুর চরানোর মাঠ। প্রকল্পটি ১০টি গ্রামের জমির ওপর প্রভাব ফেলবে।

নতুন রেললাইন: ২০১৯ সালের পর থেকে কাশ্মীরে কলেজ ছাড়াও সড়ক, টানেল, রেললাইন ও আবাসিক প্রকল্পসহ বহু মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে ভারত সরকার। আনন্তনাগ জেলার দিরহামা গ্রামের ৬৫ বছরের গুলাম মোহাম্মদ তন্ত্রে জানিয়েছেন, তার ১.২৫ একর জমির বার্ষিক আয় প্রায় ১৩ হাজার ডলার। কিন্তু এক বছর আগে রেলওয়ে জরিপ শুরু হয়। জানা গেছে, পাঁচটি নতুন রেলপথ হবে। যার একটি সরাসরি দিরহামা দিয়ে যাবে এবং সেখানে একটি রেলস্টেশনও হবে। এতে দিরহামার ১৫০ পরিবারের মধ্যে অন্তত ৮০টি পরিবারের আয়ের মূল উৎস হারানোর শঙ্কা রয়েছে।