বিশ্বজুড়ে ইতিহাস সাক্ষী-যতই ক্ষমতাবান হোন না কেন, গণআন্দোলন, সামরিক অভ্যুত্থান বা জনরোষের মুখে বহু শাসক শেষ পর্যন্ত পালিয়ে বাঁচতে বাধ্য হয়েছেন। কেউ নির্বাসনে গেছেন, কেউ প্রাণ হারিয়েছেন, কেউ আবার বিদেশে লুকিয়ে আছেন।
সর্বশেষ এমন ঘটনাটি ঘটেছে মাদাগাস্কারে, যেখানে দেশটির প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রি রাজোয়েলিনা সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। সপ্তাহজুড়ে চলা তরুণ প্রজন্মের (Gen Z) আন্দোলনের পর এই পতন ঘটে। আন্দোলনের মূল ইস্যু ছিল অর্থনৈতিক সংকট, বিদ্যুৎ ঘাটতি ও বেকারত্ব।
নিচে এমন কিছু বিশ্বনেতার সংক্ষিপ্ত গল্প তুলে ধরা হলো, যারা একই ধরনের পরিণতির মুখোমুখি হয়েছেন...
বাশার আল-আসাদ (সিরিয়া)
২০২৪ সালে সিরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ বিদ্রোহীদের হাতে রাজধানী দামেস্ক পতনের মুখে রাশিয়ায় পালিয়ে যান। এর মাধ্যমে ৫১ বছরের আসাদ পরিবার শাসনের অবসান ঘটে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে আশ্রয় দেন এবং সিরিয়ায় ফেরত পাঠাতে অস্বীকৃতি জানান।
শেখ হাসিনা (বাংলাদেশ)
২০২৪ সালের আগস্টে টানা চার মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রনেতৃত্বাধীন বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করে দেশত্যাগে বাধ্য হন।
জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সরকারবিরোধী দমন-পীড়নে প্রায় ১,৪০০ জনের মৃত্যু হয়।
হাসিনা বর্তমানে ভারতে আছেন। তিনি ১৯৯৬ সালে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন এবং ২০০৮ সালে পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে ২০২৪ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান, যিনি ১৯৭৫ সালে নিহত হন।
গোটাবায়া রাজাপাকসে (শ্রীলঙ্কা)
ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট ও গণবিক্ষোভের মুখে ২০২২ সালের জুলাইয়ে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে দেশ ত্যাগ করে মালদ্বীপে পালিয়ে যান।
জনরোষে তিনি ও তাঁর পরিবার, যারা দীর্ঘদিন শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করেছেন-শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন।
ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ (ইউক্রেন)
২০১৪ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়েন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ, যা ব্যাপক জনবিক্ষোভের সূত্রপাত ঘটায়।
রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ডজনখানেক মানুষ নিহত হওয়ার পর তিনি গোপনে রাশিয়ায় পালিয়ে যান। ইউক্রেনের পার্লামেন্ট পরবর্তীতে তাঁকে ইমপিচমেন্ট করে।
মুয়াম্মার গাদ্দাফি (লিবিয়া)
২০১১ সালের আরব বসন্ত চলাকালে চার দশকের শাসনের অবসান ঘটে লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির। রাজধানী ত্রিপোলি পতনের পর তিনি নিজের জন্মস্থান সিরতে পালিয়ে লুকিয়ে ছিলেন। পরে ন্যাটোর বিমান হামলায় তাঁর কনভয় ধ্বংস হয় এবং বিদ্রোহীরা তাঁকে আটক করে হত্যা করে।
মার্ক রাভালোমানানা (মাদাগাস্কার)
২০০৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে মাদাগাস্কারের প্রেসিডেন্ট মার্ক রাভালোমানানা ক্ষমতাচ্যুত হন। irony হলো, তাঁর ক্ষমতাচ্যুতকারী ছিলেন অ্যান্ড্রি রাজোয়েলিনা, যিনি এবার নিজেই সামরিক অভ্যুত্থানে হটেছেন। রাভালোমানানা দক্ষিণ আফ্রিকায় পালিয়ে যান এবং পরে দেশে ফিরে জেলবন্দি হন।
জ্যঁ-বার্ত্রান্ড আরিস্তিদ (হাইতি)
হাইতির ইতিহাসে প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জ্যঁ-বার্ত্রান্ড আরিস্তিদ দু’বার সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন, প্রথমবার ১৯৯১ সালে, পরে ২০০৪ সালে।
দ্বিতীয়বার তিনি মার্কিন সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় দেশত্যাগ করে প্রথমে মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে, পরে দক্ষিণ আফ্রিকায় আশ্রয় নেন। ২০১১ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন।
বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাস প্রমাণ করে, ক্ষমতার মসনদ কখনো স্থায়ী নয়। জনগণের রোষ, দুর্নীতি, বা অন্যায়ের ভারে যে কোনো শাসকই একদিন হোঁচট খান-কেউ পালিয়ে বাঁচেন, কেউ ইতিহাসে হারিয়ে যান।
সূত্র: এনডিটিভি