আল জাজিরা , এএফপি, বিবিসি ,রয়টার্স: কাশ্মীর ইস্যুকে একটি আন্তর্জাতিক বিরোধ হিসেবে উল্লেখ করে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বলেছে, এই বিষয়ে ভারত একতরফাভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। ইন্টার-সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশন্স (আইএসপিআর)-এর মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরীফ চৌধুরী কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, কাশ্মীর একটি ত্রিপাক্ষিক ইস্যু—যেখানে পাকিস্তান, ভারত এবং চীন প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। তাই এই সমস্যার সমাধান জাতিসংঘের প্রস্তাব এবং কাশ্মীরি জনগণের মতামতের ভিত্তিতেই হতে হবে। সাম্প্রতিক ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা নিয়ে তিনি বলেন, এটি শুধুমাত্র একটি সামরিক দ্বন্দ্ব নয়, বরং সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে একটি সংগ্রাম। তার ভাষায়, “এই বিজয় অস্ত্রের নয়, এটি আদর্শ ও সত্যের, আর সেই বিজয় আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে।”

তিনি ভারতের বিরুদ্ধে ভুয়া তথ্য প্রচার ও প্রপাগান্ডার অভিযোগ এনে বলেন, পুলওয়ামা হামলার পর ভারতীয় গণমাধ্যম একতরফা ও ভিত্তিহীন প্রচার চালিয়েছে। পাকিস্তান সবসময় নিরপেক্ষ তদন্ত এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণের দাবি জানালেও ভারত বিশেষ করে পেহেলগাম ঘটনার ক্ষেত্রে সেটিকে উপেক্ষা করেছে। গোল্ডেন টেম্পলে হামলা নিয়ে ভারতের মিডিয়ায় প্রচারিত দাবিকে “লজ্জাজনক মিথ্যা” বলে অভিহিত করেন আইএসপিআর-এর এই মুখপাত্র। তিনি আরও বলেন, পাকিস্তান সব ধর্মীয় স্থানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল—বিশেষ করে শিখ সম্প্রদায়ের জন্য পবিত্র স্থানসমূহ যেমন নানকানা সাহিব, পানজা সাহিব ও করতারপুরের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান দেখিয়ে থাকে।

এদিকে পাকিস্তান আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরিফ চৌধুরী মনে করেন, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধ হলে তা ‘বোকামি’ হবে। কারণ, এটা এমন একটা পথ, যা দুই দেশের জন্য ‘পারস্পরিক ধ্বংস’ ডেকে আনতে পারে। তাঁর মতে, ‘এটা (পারমাণবিক যুদ্ধ) একটা অভাবনীয় এবং অযৌক্তিক ধারণা।’ দুই দেশের মধ্যে সাম্প্রতিক উত্তেজনার পর সম্প্রতি বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শরিফ চৌধুরী এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, পাকিস্তান শান্তি চায়। কিন্তু যদি চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তাঁরা যুদ্ধের জন্য সব সময় প্রস্তুত। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্ভাব্য যুদ্ধ সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে শরিফ চৌধুরী অভিযোগ তুলেছেন, ভারত যেভাবে ‘ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছে’ এবং ‘ন্যারেটিভ’ (আখ্যান) ছড়াচ্ছে, তাতে বর্তমান আবহে ‘যেকোনো সময় স্ফুলিঙ্গ দেখা যেতে পারে।’

শরিফ চৌধুরীর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, বাস্তবে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে পরমাণু যুদ্ধের কোনো আশঙ্কা কি আছে? নাকি প্রতিরোধ গড়ে তুলতেই এই প্রসঙ্গ আনা হচ্ছে? ভারত যেভাবে ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছে এবং ন্যারেটিভ (আখ্যান) ছড়াচ্ছে, তাতে বর্তমান আবহে যেকোনো সময় স্ফুলিঙ্গ দেখা যেতে পারে। উত্তরে শরিফ চৌধুরী বলেন, ‘ভারত আগুন নিয়ে খেলছে।’ দুই দেশের সংঘর্ষের আবহে ভারতের তৈরি আখ্যানকেই এ জন্য দায়ী করেন তিনি।

শরিফ চৌধুরী জানিয়েছেন, পাকিস্তান ও ভারত দুই দেশই পরমাণু শক্তিধর দেশ। তাদের মধ্যে সামরিক সংঘাত একেবারে বোকামি। এটা অকল্পনীয়। এটা একটা অযৌক্তিক ধারণা। কিন্তু আপনারা দেখছেন, বেশ কিছুদিন ধরেই ভারত এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করার চেষ্টা করছে, যেখানে সামরিক সংঘাতের সুযোগ তৈরি হয়। ভারতের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ তুলেছেন শরিফ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি, কয়েক বছর পরপর (ভারতের পক্ষ থেকে) মিথ্যা আখ্যান তৈরি করা হচ্ছে এবং সেই আখ্যানও সেকেলে। গোটা পৃথিবী এখন জানতে পেরেছে, প্রথম দিন থেকেই ভারতের যে অবস্থান ছিল, তা ভিত্তিহীন। এমনটা কয়েক বছর অন্তর অন্তর পুনরাবৃত্তি করা হয়। আসল কথা হলো, ওরা (ভারত) আগুন নিয়ে খেলছে।’

পাকিস্তানের আইএসপিআরের মহাপরিচালক বলেন, সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে পাকিস্তান ‘অত্যন্ত পরিপক্বতা’র সঙ্গে নিজেদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে এবং উত্তেজনা বৃদ্ধি রোধ করেছে। ভারতে ঘটা কোনো ‘চরমপন্থী’ ঘটনায় যদি পাকিস্তানের কোনো নাগরিকের জড়িত থাকার প্রমাণ থাকে, ‘আমাদের সেই প্রমাণ দেওয়া উচিত। আমরা নিজেরাই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’

ভারত-শাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামে হামলার পর চলতি মাসের ছয় ও সাত তারিখের মধ্যবর্তী রাতে ভারতের দিক থেকে পাকিস্তানের কয়েকটা এলাকায় বিমান হামলা চালানো হয়। যে লক্ষ্যবস্তুগুলোকে নিশানা করা হয়েছিল, সেগুলো ‘সন্ত্রাসী ঘাঁটি’ বলে জানিয়েছিল ভারত। এরপর পাকিস্তানও পাল্টা বিমান হামলা চালায় এবং শেষ পর্যন্ত দুই দেশ যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়। শরিফ চৌধুরী বিবিসিকে বলেন, ‘আমরা শান্তিকে অগ্রাধিকার দিই, আমরা শান্তি ভালোবাসি। এখন পাকিস্তানে আমরা শান্তি উদ্যাপন করছি; কিন্তু আমরা সব সময় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত..। যদি যুদ্ধই প্রয়োজন হয়, তাহলে যুদ্ধই হবে।’ বর্তমান আবহে যুদ্ধ এখনো বিকল্প কি না, জানতে চাইলে শরিফ চৌধুরী বলেন, প্রকৃত সংঘাত এখনো রয়ে গেছে। এতে যেকোনো সময় স্ফুলিঙ্গ যোগ করা যেতে পারে। পরিস্থিতির দিকে একবার লক্ষ্য করে দেখুন, ১০ মের পর থেকে অনেকগুলো দিন কেটে গেছে; কিন্তু ভারতে যে আখ্যানের প্রচার করা শুরু করেছিল, তা এখনো চলছে।

ভারতের ‘অভ্যন্তরীণ রাজনীতি’র দিকে আঙুল তুলে শরিফ চৌধুরী বলেন, ‘ভারত যেভাবে দর–কষাকষি করছে, সেটা মূলত তাদের দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির উন্নতির একটা প্রচেষ্টা বলেই মনে হচ্ছে। সেখানে দায়িত্বশীল রাজনৈতিক নেতৃত্বের আভাস খেয়াল করেছেন কি? তাঁরা বলছেন, তাঁদের দেশ সন্ত্রাস ও একটা সন্ত্রাসী ঘটনার হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে।’ পাকিস্তান ভারতের ছয়টি সামরিক উড়োজাহাজ ভূপাতিত করেছে বলে দাবি করেছেন শরিফ চৌধুরী। দেশটি চাইলে ভারতের আরও সামরিক উড়োজাহাজ ভূপাতিত করতে পারত; কিন্তু দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে তা করেনি বলে দাবি করেন দেশটির এই সামরিক কর্মকর্তা।