বিবিসি : ‘সবাই বলছে, রাবার বুলেট, রাবার বুলেট। এটা রাবার বুলেট ছিল না। আপনি যদি আমার ছেলেকে দেখতেন, ওর মাথায় গুলি লেগেছিল, সেখানে একটি গর্ত ছিল।’ এক দমে কথাগুলো বলে যান নরেন্দ্র শ্রেষ্ঠ। তাঁর ছেলে সুলভ রাজ শ্রেষ্ঠ গত সপ্তাহে নেপালে তরুণদের বিক্ষোভ চলাকালে নিহত হয়েছেন। ছেলে হত্যার দায় কে নেবেÑ প্রশ্ন এই হতভাগ্য বাবার। নরেন্দ্রর বয়স ৪৫ বছর। তিনি রাজধানীর ত্রিভুবন ইউনিভার্সিটি টিচিং হাসপাতালের মর্গের ফটকের বাইরে বসে আছেন। কিছুক্ষণ আগেই তিনি মর্গের ভেতরে গিয়ে ছেলের মরদেহ শনাক্ত করে এসেছেন। সুলভের বয়স ২১ বছর।
কান্নাচাপা গলায় নরেন্দ্র বলেন, ‘আমি এই দেশের কাছে জানতে চাই, যদি তারা বন্দুক চালাতে পারে, আমার ছেলেকে গুলি করতে পারে, তাহলে আমি আর ওর মা–ও একই কাতারে দাঁড়াব। এখন আমরা কার জন্য বেঁচে থাকব? আমরাও মরে যেতে চাই।’ নরেন্দ্রর পাশে তাঁর এক নারী স্বজন বসে ছিলেন। রোদ থেকে বাঁচাতে অন্য এক ব্যক্তি মাথায় ছাতা ধরে ছিলেন। নরেন্দ্রর বয়স ৪৫ বছর। তিনি রাজধানীর ত্রিভুবন ইউনিভার্সিটি টিচিং হাসপাতালের মর্গের ফটকের বাইরে বসে আছেন। কিছুক্ষণ আগেই তিনি মর্গের ভেতরে গিয়ে ছেলের মরদেহ শনাক্ত করে এসেছেন। সুলভের বয়স ২১ বছর।
অকালে স্বপ্নের মৃত্যু: মর্গের বাইরে আরও কয়েকটি পরিবার অপেক্ষা করছিল। তারাও প্রিয়জনদের মরদেহ শনাক্ত করতে এসেছে। মর্গে প্রাণহীন পড়ে থাকা এসব তরুণের কেউ বিচারক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন, কেউবা অন্যকিছু। অন্য একজন লেখাপড়ার পাশাপাশি কাঠমান্ডুর একটি হোটেলে কাজ করতেন, তৃতীয় আরেকজন ফরাসি ভাষা শিখতেন। গত সপ্তাহে নেপালে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ৭২ জন নিহত হন। নিহত এই তরুণেরা সেই দলের। দুই দিনের ওই বিক্ষোভে এক হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। নরেন্দ্র শ্রেষ্ঠ বলেন, তাঁর ছেলের মাথায় গুলি লেগেছে। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এখন কার জন্য বাঁচব?’ নেপালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞাই ছিল বিক্ষোভ শুরুর মূল কারণ। তবে তার আগের কয়েক সপ্তাহ ধরে সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমছিল। ৮ সেপ্টেম্বর নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে সকাল থেকেই তরুণেরা রাজপথে নেমে তীব্র বিক্ষোভ শুরু করেন। নিরাপত্তা বাহিনীকে মাঠে নামিয়ে সরকার প্রথমে বিক্ষোভ দমনের চেষ্টা করে। তাতে ব্যর্থ হয়ে গত সোমবার রাতেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। কিন্তু ততক্ষণে বিক্ষোভ বড় আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। তরুণেরা শাসকশ্রেণির প্রতি ক্ষোভে ফেটে পড়েন। বিক্ষুব্ধ জনতা রাজনীতিকদের বাড়ি ও সরকারি ভবনে ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেন। দুই দিনের সেই বিক্ষোভে কে পি শর্মা অলি সরকারের পতন হয়।
তদন্তের আশ্বাস: বিক্ষোভে যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। পুলিশের বিরুদ্ধে জনতাকে লক্ষ্য করে গুলি চালানোর অভিযোগ রয়েছে। তবে কিছু মানুষ আগুনে পুড়ে মারা গেছেন বা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন।
ধ্বংসস্তূপ সারিয়ে নেওয়া শুরুর পর নিহত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালানোর অভিযোগের জবাবে নেপাল পুলিশ বলেছে, দুই দিনের সহিংস বিক্ষোভ চলাকালে কী ঘটেছিল, তারা তা তদন্ত করে দেখবে। নিরাপত্তা বাহিনীকে গুলি চালানোর নির্দেশ কে দিয়েছিল, তা এখনো স্পষ্ট নয়। এদিকে নরেন্দ্র শ্রেষ্ঠর পরিবারের মতো আরও কয়েকটি পরিবার মর্গের বাইরে অপেক্ষা করছে, যেন নাম ডাকা হলে তারা মর্গের ভেতরে গিয়ে মরদেহ শনাক্ত করতে পারে।
সেখানে অপেক্ষায় থাকা ব্যক্তিদের একজন রাসিক কে সি। তিনি তাঁর ২২ বছর বয়সী ভাতিজা রাশিক খাতিওয়াডার মরদেহের অপেক্ষায় আছেন। রাশিকের বুকে দুবার গুলি লেগেছে। তাঁর চাচা বলেন, তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও দেখে ভাতিজা নিহত হওয়ার বিষয়টি জানতে পারেন। রাসিক কে সির বেদনা এখন ক্রোধে পরিণত হয়েছে। তিনি এখন সরকারের কাছে জবাব চাইছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা ন্যায়বিচার চাই।’
ভূমিকম্পের চেয়েও বিভীষিকাময়: ২১ বছরের সুবাস বোহোরার স্বজনেরা বলেন, সুবাসের স্বপ্ন ছিল বিচারক হওয়ার। নেপালের পার্লামেন্টের বাইরে বিক্ষোভের সময় ঘাড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে এই তরুণ নিহত হন। বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালানোর অভিযোগের জবাবে নেপাল পুলিশ বলেছে, দুই দিনের সহিংস বিক্ষোভ চলাকালে কী ঘটেছিল, তারা তা তদন্ত করে দেখবে। নিরাপত্তা বাহিনীকে গুলি চালানোর নির্দেশ কে দিয়েছিল, তা এখনো স্পষ্ট নয়। ১৯ বছরের আয়ুশ থাপা ফরাসি ভাষা শিখতেন। তাঁর পরিবার জানায়, তিনি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে কাজ করার স্বপ্ন দেখতেন। নেপালের রাজনীতিকদের তাঁর পছন্দ ছিল না। বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি নিহত হন। ২২ বছর বয়সী শিক্ষার্থী অভিষেক চৌলাগাইন রাজধানীর একটি হোটেলে কাজ করতেন। কপালে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি নিহত হন। কাঠমান্ডুর সিভিল সার্ভিস হাসপাতালের তথ্য কর্মকর্তা রঞ্জনা নেপাল বলেন, ‘আমরা কখনো এমন বিপর্যয়ের মুখোমুখি হইনি।’
সন্তোষ পাওদেল, চিকিৎসক: বিক্ষোভের সময় হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ৪৫০ জনের বেশি আহত ব্যক্তিকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে বলে জানান এই কর্মকর্তা। তাঁদের মধ্যে ছয়জন মারা গেছেন। রঞ্জনা বলেন, ‘১৭ বছর ধরে আমাদের হাসপাতালের কার্যক্রম চলছে। ভূমিকম্পের সময়ও আমরা রোগীদের সামাল দিয়েছি। এ পরিস্থিতি তার চেয়েও ভয়াবহ ছিল।’ বিক্ষোভের প্রথম রাতে চিকিৎসক সন্তোষ পাওদেল পার্লামেন্ট ভবনের কাছাকাছি বীর হাসপাতালে কাজ করছিলেন। তাঁর দল সেদিন ওই হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আসা ১৭৩ জন রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছে। তাঁদের মধ্যে পাঁচজন মারা গেছেন, চারজনের অবস্থা এখনো গুরুতর।
চিকিৎসক পাওদেল বলেন, সেদিন তিনি রোগীদের শরীরে রাবার বুলেটের পাশাপাশি রাইফেলের গুলির গভীর ক্ষত দেখেছেন, যা তাঁকে অবাক করেছে। এই চিকিৎসক আরও বলেন, ‘আমরা পরিষ্কারভাবে (দুই ধরনের গুলি) দেখেছি, একটি লম্বা, যেটি শটগান থেকে ছোড়া হয়েছে। অন্যটি ছোট ধারালো প্রান্তযুক্ত, যেগুলো রাইফেল থেকে ছোড়া হয়েছে।’ দিনের শেষ দিকে যেসব আহত বিক্ষোভকারীকে তাঁর হাসপাতালে আনা হয়েছে, তাঁদের কারও কারও শরীরে একাধিক গুলির চিহ্ন ছিল বলেও জানান পাওদেল। বিক্ষোভে আহত হয়েছেন ২২ বছরের অভিষেক শ্রেষ্ঠ। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী তাদের গুলি চালানোর অনুমতি নেই।’ অভিষেকের ডান পায়ে গুলি লেগেছে। আগামী অন্তত এক মাস তাঁকে হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা নিতে হবে।
অভিষেক শ্রেষ্ঠ, বিক্ষোভে আহত তরুণ: অভিষেক বলেন, ‘আমি নেপালি, আমাকে গুলি করার অধিকার তাদের নেই, তবু তারা আমাকে গুলি করেছে। এসবই হয়েছে সরকার, পুলিশ ও নিয়মকানুনের কারণে। আমাদের এটা পরিবর্তন করতে হবে।’ ছেলের মৃত্যুশোকে ভেঙে পড়া নরেন্দ্রর কাছে পুলিশের তদন্তের খবর খুব একটা স্বস্তি নিয়ে আসেনি। নরেন্দ্র বলছিলেন, রাজনীতিকেরা দুঃখ প্রকাশ করবেন। তাঁদের এই দুঃখ প্রকাশ তো তাঁর মৃত ছেলেকে জীবিত করতে পারবে না।