এএফপি : মাদাগাস্কারে এখনো বর্ষা মৌসুম শুরু হয়নি, তবুও সেখানকার আন্তানানারিভো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসের করিডরে পানি জমেছে। দুই বছর আগে ছাত্রাবাসটি তৈরি হয়। শিক্ষার্থী উলরিক সাম্বিজাফি এএফপির সংবাদকর্মীদের ছাত্রাবাসের অবস্থা দেখানোর জন্য ডাকেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের থাকার জায়গাগুলো দেখে যান।’ গত ২৫ সেপ্টেম্বর মাদাগাস্কারে শুরু হওয়া যে বিক্ষোভ ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রটিকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল, তাতে অংশ নেন এই শিক্ষার্থীও। সাম্বিজাফির থাকার কক্ষের পেছনের দরজায় গিয়ে দেখা গেল, মাত্র দুই মিটার (৬ দশমিক ৫ ফুট) দূরের একটি খোলা নর্দমা দিয়ে আবর্জনা ভেসে যাচ্ছে। ২৪ বছর বয়সী সাম্বিজাফি নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিষয়ে স্নাতকোত্তর করছেন। এএফপিকে তিনি তাঁর পায়ের গোড়ালি ও হাঁটুর মাঝ বরাবর দেখিয়ে বলেন, ‘বর্ষায় নর্দমার পানি এই পর্যন্ত উঠে আসে। এগুলোই প্রমাণ করে যে আমাদের বিদ্রোহ ন্যায্য।’
সাম্বিজাফির বাড়ি মাদাগাস্কারের পূর্বাঞ্চলে। তিনি দেশটির সেসব শিক্ষিত তরুণের একজন; যাঁরা দেশটিতে সাম্প্রতিক সরকারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। বিভিন্ন দেশে হওয়া ‘জেন–জি’ আন্দোলনের অনুপ্রেরণায় এ বিক্ষোভের আয়োজন করা হয়। সাম্বিজাফির বাড়ি মাদাগাস্কারের পূর্বাঞ্চলে। সাম্বিজাফি সেসব শিক্ষিত তরুণের একজন; যাঁরা দেশটির সরকারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। বিভিন্ন দেশে হওয়া ‘জেন–জি’ আন্দোলনের অনুপ্রেরণায় দেশটিতে বিক্ষোভের আয়োজন করা হয়। বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে গতকাল মঙ্গলবার মাদাগাস্কারের পার্লামেন্টে ভোটাভুটি হয়েছে। এতে প্রেসিডেন্ট আন্দ্রি রাজোয়েলিনা অভিশংসিত হয়েছেন। এরপর সেনাবাহিনীর একটি বিশেষ ইউনিট রাষ্ট্রক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। রাজধানী আন্তানানারিভোর আঙ্কাতসো এলাকায় অবস্থিত এ ভবনটি ২০২৩ সালে চালু হয়েছে। তবে এখনই সেখানে ফাটল দেখা দেওয়ায় বোঝা যাচ্ছে, এটির নির্মাণে বড় ত্রুটি রয়েছে।
‘তাঁরা তরুণদের কথা ভাবেননি’: সাম্বিজাফি বলেন, ‘মাদাগাস্কারের তরুণদের কথা কেউ ভাবেন না। কারণ, এই দেশের নেতাদের সন্তানেরা আন্তানানারিভো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন না। তাঁরা বর্দো, এমআইটি, হার্ভার্ড ও অন্যান্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়েন।’ বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ মাদাগাস্কারে বিদ্যুৎ ও পানির সংকটকে কেন্দ্র করে এ বিক্ষোভের সূচনা হয়েছিল। পরে তা সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়।
বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে গতকাল মঙ্গলবার মাদাগাস্কারের পার্লামেন্টে হওয়া ভোটাভুটির মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট আন্দ্রি রাজোয়েলিনা অভিশংসিত হয়েছেন। এরপর সেনাবাহিনী রাষ্ট্রক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। গত সপ্তাহে রাজোয়েলিনা তাঁর দেশের তরুণ, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ও তাঁদের আবাসন পরিস্থিতির দিকে গভীরভাবে নজর দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সম্প্রতি নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেজর জেনারেল রুফিন ফরচুনাত দিম্বিসোয়া জাফিসাম্বোর নাম ঘোষণা করা হয়েছে। নতুন প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ করবেন, যা সব শিক্ষার্থীর চাহিদা পূরণ করবে। এ নিয়ে সাম্বিজাফি তাচ্ছিল্যের হাসি হাসেন। তিনি বলেন, মাদাগাস্কারে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে যে, ‘নিজের থালার খাবার শেষ হওয়ার খবর নেই, পাত্রে কী রাখা আছে তার খোঁজ’। ছাত্রাবাসের এ ভবন ও কক্ষগুলোই যে আঙ্কাতসো এলাকায় শিক্ষার্থীদের থাকার সবচেয়ে খারাপ জায়গা, তা নয়। পাশের হলুদ চারতলা ভবনেরও একই দশা। ৪০০ জনকে রাখার উপযোগী করে এটি বানানো হয়েছে। তবে সেখানে অনেক বেশি শিক্ষার্থী গাদাগাদি করে থাকেন। প্রায় ১০ বছর আগে ভবনটিতে শিক্ষার্থীরা থাকতে শুরু করেন। পুরোনো বাসিন্দাদের কেউই মনে করতে পারেন না যে কমিউনিটি কিচেনের প্লাগ বা নল কখনো কাজ করত কি না।
৩০ বছর বয়সী শিক্ষার্থী ইয়ানদোহারিলালা রাকোতন্দ্রিনা নিচতলার একটি কক্ষে রাখা দুটি দুই চাকার যান দেখিয়ে বলেন, এটি স্কুটারের জন্য গ্যারেজ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। তৃতীয় তলার বাথরুম ও লন্ড্রিতে দেখা গেল ট্যাপ থেকে অল্প অল্প করে পানি পড়ছে। পানির চাপ নেই সেখানে। দেয়ালে একটি কাগজ সাঁটানো। কোন শিক্ষার্থী কোন দিন এগুলো পরিষ্কার করবেন, তার রুটিন দেওয়া। তবে কিছু শৌচাগারের অবস্থা এতটাই খারাপ যে তার স্বাভাবিক রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব নয়। পানির সংকটের কারণে এগুলো আরও দ্রুত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। রাকোতন্দ্রিনা বলেন, ‘আমরা আক্ষরিক অর্থে আবর্জনার মধ্যে বসবাস করছি।’ তিনি যখন কথা বলছিলেন, তখন আশপাশ থেকে প্রস্রাবের তীব্র দুর্গন্ধ আসছিল।
মেঝেতে বিছানা: ইজেকিয়েল লেডি নামের ওই ছাত্রাবাসে রাজধানীর বাইরে থেকে পড়তে আসা ছাত্রছাত্রীদের থাকার জন্য পর্যাপ্ত কক্ষ নেই। চারজনের জন্য তৈরি কক্ষে ছয়জনকে থাকতে হচ্ছে। ১৮ বর্গমিটার (১৯৪ বর্গফুট) মাপের ছোট কক্ষে ছাত্রদের কয়েকজনকে মিলে এক বিছানায় বা মেঝেতে তোশক বিছিয়ে ঘুমাতে দেখা যায়। এক শিক্ষার্থীকে দেখা গেল ভাঙা আয়নার সামনে চুল কাটার সেবা দিচ্ছেন। চুল কাটার জন্য প্রতিজনের কাছ থেকে দুই হাজার আরিয়ারি (দশমিক ৪০ ইউরোর কম) নিচ্ছেন তিনি, যা শহরে চুল কাটার খরচের অর্ধেক। লেডি নামে এক স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী বলেন, ‘মাদাগাস্কারের তরুণেরা সব পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে পারদর্শী। সম্ভবত এ জন্যই নেতারা মনে করেন, তাঁদের সাহায্য করার প্রয়োজন নেই।’