এনডিটিভি, আরওয়াই নিউজ , নিউইয়র্ক টাইমস , বিবিসি: ভারত-শাসিত জম্মু-কাশ্মিরে হামলায় ২৬ জন নিহত হয়েছেন। উপত্যকাটির পেহেলগামে হামলার এই ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র সফর সংক্ষিপ্ত করেছেন ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। এছাড়া কাশ্মির ছাড়ার চেষ্টা করছেন পর্যটকরা। অন্যদিকে হামলার ঘটনায় কাশ্মির জুড়ে সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। সংবাদমাধ্যমটি বলছে, পেহেলগামে হামলার পর অনেক পর্যটকই এখন কাশ্মির ছাড়ার চেষ্টা করছেন। শ্রীনগর বিমানবন্দরের ট্যুর অপারেটররা জানিয়েছেন, পেহেলগাম হামলার পর দেশি পর্যটকরা কাশ্মির ছাড়ার জন্য তাড়াহুড়ো করছেন। অনেক গাড়ি এখন বিমানবন্দরের দিকে আসছে। সংবাদদাতা ইয়োগিতা লিমায়ি তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন, তিনি মুম্বাই থেকে আসার সময় ফ্লাইটে অনেক দেশি পর্যটকদের দেখেছেন, যারা তাদের কাশ্মিরে ঘোরার পরিকল্পনা বাতিল করেননি। অন্যদিকে, দিল্লী থেকে কাশ্মীরে যাওয়া বিবিসির অন্য সংবাদদাতারা জানিয়েছেন, তাদের ফ্লাইট বেশ ফাঁকা ছিল।

এদিকে মঙ্গলবার কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলার ঘটনার প্রতিবাদে কাশ্মির জুড়ে সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে ওই অঞ্চলের গণপরিবহন ব্যবস্থায়ও। পেহেলগামের ওই হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে। জানা গেছে, দেশটির ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির (এনআইএ) একটি দল ইতোমধ্যেই শ্রীনগরে পৌঁছেছে এবং আরও কয়েকটি টিমের সেখানে যাওয়ার কথা রয়েছে। পাশাপাশি, দেশটির শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তারাও পেহেলগাম পরিদর্শনে যাবেন।

কিন্তু তার ওই সফর সংক্ষিপ্ত করে তিনি শিগগিরই ভারতে ফিরবেন বলে জানা গেছে। এর আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও তার সৌদি আরব সফর সংক্ষিপ্ত করে বুধবার সকালে ভারতে ফিরে আসেন। এদিকে ভারতীয় সেনাবাহিনী দাবি করেছে, তারা বারামুল্লা জেলায় “সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের”দের একটি হামলা ঠেকিয়ে দিয়েছে। সেই সময় সেনাবাহিনীর সাথে বন্দুকযুদ্ধে দুইজন “সন্ত্রাসী” নিহত হয়েছে বলে তারা দাবি করেছে। গত মঙ্গলবার যেখানে বন্দুকধারীদের হামলার ঘটনা ঘটে, সেই পেহেলগাম থেকে ১৪০ কিলোমিটার দূরে বারমুল্লা অবস্থিত। ভারতীয় সেনাবাহিনীর দাবি, লাইন অব কন্ট্রোল বা সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ রেখার কাছাকাছি ওই গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এই নিয়ন্ত্রণে রেখা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মিরকে বিভক্ত করেছে। সেখান থেকে “বিপুল অস্ত্র, গোলাবারুদ” উদ্ধার করা হয়েছে বলেও ভারতীয় সেনাবাহিনী দাবি করেছে।

ভারত অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীরের (আইআইওজেকে) পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর হামলার ঘটনা ‘ফলস ফ্ল্যাগ’ বা সাজানো হামলা হতে পারে বলে মন্তব্য করেছে পাকিস্তানির সংবাদমাধ্যম আরওয়াই নিউজ। পর্যটকদের জনপ্রিয় গন্তব্য পাহাড়ি ও মনোরম এই এলাকায় এক মর্মান্তিক হামলায় কমপক্ষে ২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘বিশ্লেষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, এটি ‘ফলস ফ্ল্যাগ’ বা সাজানো হামলা হতে পারে। অতীতেও মোদি সরকার এমন হামলা ঘটিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব হামলা প্রায়ই দেশটির অভ্যন্তরীণ ব্যর্থতা আড়াল করতে এবং পাকিস্তানবিরোধী মনোভাব উস্কে দিতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে’।

‘এই হামলার পরপরই ভারতের গণমাধ্যম ও রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং (র) এর সঙ্গে যুক্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অ্যাকাউন্টগুলো পাকিস্তানকে লক্ষ্য করে ভিত্তিহীন অভিযোগ ছড়াতে শুরু করে’। এতে আরও বলা হয়, ‘এমনকি হামলাকে ধর্মীয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিসেবে তুলে ধরার অপচেষ্টা চালানো হয়, যেখানে দাবি করা হয়েছেÍঅমুসলিম পর্যটকদের টার্গেট করে হামলা চালানো হয়েছে’। ‘আগের মতোই ভারতের মূলধারার সংবাদমাধ্যম ভিত্তিহীন প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে, যা আবারও সরকারিভাবে প্রচারিত বিবৃতির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে’। প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়, ‘২০১৯ সালে ভারত সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার করে নেয় এবং জম্মু ও কাশ্মীর ও লাদাখÍএই দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিভক্ত করে। এর ফলে অঞ্চলটি সম্পূর্ণরূপে দখলে চলে যায়। একই সঙ্গে বহিরাগতদের বসবাসের অধিকার দেওয়ার পথ সুগম হয়, যা কাশ্মীরে ব্যাপক ক্ষোভ ও প্রতিবাদের জন্ম দেয়’।

মোদিকে গিয়ে সব জানাও : কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলায় চোখের সামনে স্বামীকে মারা যেতে দেখেন পল্লবী। শোকে মুহ্যমান অবস্থায় এক হামলাকারীর মুখোমুখি হয়ে বলেন, স্বামীর সঙ্গে তাকেও মেরে ফেলা হোক। তবে ওই সন্ত্রাসী জবাব দেয়, পল্লবী ও তার ছেলের কোনও ক্ষতি করা হবে না, তারা যেন বরং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে ঘটনার আদ্যোপান্ত প্রকাশ করেন।

স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে তিনি ফোনে বলেন, আমরা ঘোড়ায় চড়ে পাহেলগামে গিয়েছিলাম। আমাদের ছেলে সকাল থেকে কিছু খায়নি। তাই আমার স্বামী কিছু খাবার আনতে গিয়েছিল। এরপরই আমি হঠাৎ গুলীর আওয়াজ শুনি। প্রথমে ভেবেছিলাম সেনাবাহিনী ফাঁকা গুলী করেছে। পরে দেখি ভীতসন্ত্রস্ত লোকজন ছোটাছুটি করছে। স্বামী মঞ্জুনাথ এবং ১৮ বছর বয়সী ছেলে অভিজেয়াকে নিয়ে কর্ণাটক রাজ্যের শিভামোজ্ঞাতে বাস করেন পল্লবী। তিনি একটি ব্যাংকে ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত আছেন। মঞ্জুনাথ ছিলেন একজন আবাসন ব্যবসায়ী। ১৯ এপ্রিল কাশ্মীর পৌঁছান তারা। ২৪ তারিখ ঘরে ফেরার কথা ছিল।

গত মঙ্গলবার দক্ষিণ কাশ্মীরের জনপ্রিয় পর্যটন এলাকা পাহালগামে সন্ত্রাসী হামলায় অন্তত ২৬ নিহত এবং ১৭ জন আহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে একজন সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং একজন নেপালের নাগরিক ছিলেন। মঞ্জুনাথের মরদেহ দেখার কথা স্মরণ করে পল্লবী বলেন, আমি তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকতে দেখি। সেখানে তিন কি চারজন বন্দুকধারীকে আমি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। তাদের একজনের মুখোমুখি হয়ে আমি বলি, আমার স্বামীকে তো মেরেই ফেললে, এখন আমাকেও মারো।

তাদের সন্তান অভিজেয়াও সন্ত্রাসীদের প্রতি মারমুখী হয়ে এগিয়ে যায় বলে উল্লেখ করেন পল্লবী। তিনি বলেন, অভিজেয়া এগিয়ে এসে বলে, কুকুরের দল, আমার বাবাকে তো মেরেই ফেললি। আমাদের বাঁচিয়ে রাখবি কেন। মার, আমাদেরও মার! তবে ওই ব্যক্তি তাদের হত্যা করতে অস্বীকৃতি জানায়। সে বলে, তোমাদের মারবো না। যাও, মোদিকে জানাও গিয়ে (এখানে কী হয়েছে)। সন্ত্রাসীরা প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের হত্যা করছিল বলে উল্লেখ করেন পল্লবী। তিনি বলেন, সেদিন প্রায় পাঁচশর মতো পর্যটক ছিলেন। তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন নবদম্পতি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কেবল স্বামীদের হত্যা করা হয়েছে। বন্দুকধারীদের পরনে কোনও ইউনিফর্ম ছিল না। মঞ্জুনাথের মরদেহ নিয়ে ঘরে ফেরার অপেক্ষা করছেন পল্লবী। তিনি বলেছেন, আমি ঘরে ফিরতে চাই। স্বামীর মরদেহ বুঝে পেলেই কেবল আমি ফিরব। আমরা তিনজন একসঙ্গেই বাড়ি যাব। আমি চাই, কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিক। মঞ্জুনাথের মৃত্যুর খবরে তার বাড়ির সবাই ভেঙে পড়েছেন। অথচ তার মা জানেন, ছেলে কিছুটা ব্যথা পেয়েছেন। ছেলের সুস্থভাবে ফিরে আসার অপেক্ষা করছেন মঞ্জুনাথের বৃদ্ধ জননী।