বিবিসি, রয়টার্স , আল জাজিরা : গাজা উপত্যকাজুড়ে ইসরাইলী বাহিনীর হামলায় গত মঙ্গলবার ভোর থেকে এখন পর্যন্ত ৭০ জনের বেশি ফিলিস্তিনী নিহত হয়েছেন। গতকাল বুধবারই নিহত হয়েছেন ৩৫ জন। আহত হয়েছেন দুই শতাধিক। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম তাদের এক প্রতিবেদনে এ খবর জানিয়েছে। খবরে বলা হয়, নিহতদের মধ্যে খাদ্যের খোঁজে আসা ক্ষুধার্ত মানুষও রয়েছেন। জাতিসংঘের মতে, গাজার পুরো জনগোষ্ঠী চরম দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি। গত মঙ্গলবার আবারও গাজার কেন্দ্রীয় অংশে ইসরাইল-নিয়ন্ত্রিত নেতসারিম করিডরের কাছে সামান্য খাবার সংগ্রহে আসা মানুষের ওপর গুলী চালায় ইসরাইলী সেনারা। গাজা সরকারের তথ্য অফিস জানায়, এতে অন্তত ২০ জন নিহত হন, যাদের মধ্যে ১২ বছরের এক শিশুও রয়েছে। শিশুটির নাম মোহাম্মদ খলিল আল-আথামনেহ বলে নিশ্চিত করা হয়েছে। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ২০০ জন।
এই ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রগুলো পরিচালনা করছে ‘গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন’ (জিএইচএফ) নামের একটি বিতর্কিত সংস্থা, যার কার্যক্রম ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে চলছে এবং এটি ইসরাইলী সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রিত এলাকায় কাজ করছে। ফিলিস্তিনী কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয় জনগণ এই বিতরণ কেন্দ্রগুলোকে ‘মানব কসাইখানা’ বলে অভিহিত করেছেন। কারণ গত ২৭ মে থেকে সংস্থাটি ত্রাণ কার্যক্রম শুরুর পর থেকেই ১৫০ জনেরও বেশি মানুষ সেখানে প্রাণ হারিয়েছেন, আর আহত হয়েছেন প্রায় ১৫০০ জন। গাজা সরকারের তথ্য অফিস এক বিবৃতিতে অভিযোগ করেছে, জিএইচএফ কার্যত একটি ‘মরণ ফাঁদে’ পরিণত হয়েছে, যেখানে ত্রাণের প্রলোভনে ক্ষুধার্ত মানুষদের টেনে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে।
তাদের ভাষায়, “জিএইচএফ এখন ইসরাইলী সেনাবাহিনীর হাতে এক ভয়ঙ্কর হাতিয়ার হয়ে উঠেছে, যারা ত্রাণ দেওয়ার নামে নিরস্ত্র ও ক্ষুধার্ত মানুষদের মৃত্যুফাঁদে ডেকে নিচ্ছে।” সাংবাদিক তারেক আবু আজ্জুম গাজার দেইর আল-বালাহ থেকে জানিয়েছেন, জিএইচএফ-এর এসব ত্রাণকেন্দ্র এখন যেন “পুনরাবৃত্ত রক্তপাতের মঞ্চ” হয়ে উঠেছে, যেখানে পরিকল্পিতভাবে সাধারণ মানুষদের ওপর হামলা চালানো হচ্ছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, এসব হামলা চালানো হয়েছে বিভিন্ন দিক থেকে। ড্রোন, ট্যাংক ও স্নাইপার ব্যবহার করে এসব বিচ্ছিন্ন ত্রাণকেন্দ্রে অভিযান চালাচ্ছে ইসরাইলী সেনারা। আজ্জুম বলেন, “যা হচ্ছে, তা মূলত মানবিক সহায়তা ব্যবস্থাকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার এক প্রক্রিয়া।
গাজার দক্ষিণাঞ্চলের খান ইউনিসে পৃথক ইসরাইলী হামলায় অন্তত ১০ জন মানুষ মারা গেছেন বলেও জানিয়েছে ওই স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। হামলার বিষয়ে ইসরাইলী সেনাবাহিনীর কাছ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। আগেরদিন রাফায় আরেকটি ত্রাণকেন্দ্রের কাছে ইসরাইলী হামলায় ১৭ জন নিহত হয়েছেন বলে গাজা স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা অভিযোগ করেন। তাদের অভিযোগের জবাবে ইসরাইলী বাহিনীর দাবি, তাদের দিকে আগুয়ান সন্দেহভাজনদের সতর্ক করতে ফাঁকা গুলি ছোড়া হয়েছিল। একইদিন ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দাবি করেন, গাজায় আটক থাকা বাকি জিম্মিদের ছাড়িয়ে আনতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। তবে চূড়ান্ত চুক্তির বিষয়ে এখনই আশাবাদী না হতেও পরামর্শ দেন তিনি। মিসর, কাতার ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও গাজায় যুদ্ধবিরতি পুনর্বহালে ইসরাইল বা হামাস কেউই একচুল পরিমাণ ছাড় দিতে সম্মত নয়। উভয়েই চুক্তি না হওয়ার জন্য অন্য পক্ষকে দায়ী করে আসছে।
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জন্য মুসলিম দেশগুলোর ভূমি ছাড়া উচিত: এদিকে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন করতে চাইলে মুসলিম দেশগুলোর কিছু পরিমাণ করে ভূমি ছেড়ে দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন ইসরাইলে কর্মরত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইক হুকাবিই। বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এই কথা বলেন। হুকাবিইর দাবি, ইসরাইল নিয়ন্ত্রিত ভূমির চেয়ে ৬৪৪ গুণ বেশি ভূমি রয়েছে মুসলিম দেশগুলোর কাছে। তো, তাদের যদি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র নিয়ে এতোই খায়েশ থাকে, তবে কারও সামনে এসে দায়িত্ব নেওয়া উচিত। ইসরাইল-ফিলিস্তিনের দীর্ঘদিনের সংকট নিরসনে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান সম্পর্কে তিনি বলেন, এটি কেবল আকাঙ্ক্ষিত একটি লক্ষ্য। যদিও এই সমাধান প্রস্তাবটি দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিকভাবে সমর্থন পেয়ে এসেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক প্রশাসনও এটিকে সমর্থন করেছে। এই প্রস্তাব অনুযায়ী, পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকায় একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনী রাষ্ট্র গঠিত হবে যার রাজধানী হবে পূর্ব জেরুজালেম। ইসরাইল ও ফিলিস্তিন পাশাপাশি টিকে থাকবে।
সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গকে দেওয়া পৃথক এক সাক্ষাৎকারে তিনি দাবি করেন, স্বাধীন ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র আর চেষ্টা করছে না। অবশ্য তার এই বক্তব্যে সরাসরি সায় দেয়নি ওয়াশিংটন। হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস বলেছেন, রাষ্ট্রদূত হুকাবিইর কথা তার একান্তই নিজস্ব মত। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতি নির্ধারণের অধিকার একমাত্র প্রেসিডেন্টের হাতেই রয়েছে।
চলতি মাসের শেষদিকে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ কার্যালয়ে ফ্রান্স ও সৌদি আরবের উদ্যোগে একটি সম্মেলন আয়োজন হতে পারে। সেখানে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের জন্য একটি রোডম্যাপ তুলে ধরার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে হুকাবিই সম্মেলনটি সময়োপযোগী নয় বলে মন্তব্য করেছেন। দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান বরাবরই খারিজ করে এসেছে ইসরাইল। তাদের দাবি, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত দিয়ে কোনও আলোচনা হতে পারে না। যে কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত ফিলিস্তিনীদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে। হুকাবিই বরাবর অধিকৃত ফিলিস্তিনী ভূমিতে বৃহত্তর ইসরাইল প্রতিষ্ঠার সমর্থক। তিনি পশ্চিম তীরের জন্য বাইবেলের শব্দবন্ধ ‘জুডেয়া অ্যান্ড সামারিয়া’ ব্যবহার করে থাকেন। হুকাবিইর সঙ্গে ইসরাইলী জাতীয়তাবাদী চরমপন্থিদের বক্তব্যের মিল রয়েছে। এই গোষ্ঠীর কিছু সদস্য, এমনকি বর্তমান সরকারে থাকা চরম-ডানপন্থি মন্ত্রীরাও দাবি করেছেন, ফিলিস্তিনীদের পশ্চিম তীর ও গাজা থেকে বহিষ্কার করে অন্য কোনও আরব বা মুসলিম দেশে তাদের জন্য রাষ্ট্র গড়া যেতে পারে। এই ধরনের নীতিকে কার্যকর করা হলে তা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের স্পষ্ট উদাহরণ হবে বলে সতর্ক করেছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।