এএনআই, রয়টার্স : পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরকে মার্কিন সেনা বহরের ২৫০তম বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্ত কি ভারতের কূটনৈতিক ব্যর্থতার প্রতীক? সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পাকিস্তানকে ‘বড় অংশীদার’ হিসেবে গণ্য করে মার্কিন সেনা কর্তা জেনারেল মাইকেল কুরিল্লার মন্তব্যও কি সেই ব্যর্থতার আরেক নমুনা? ভারতের ক্ষমতার অলিন্দ ও বিরোধী রাজনৈতিক মহলে এই প্রশ্ন নিঃসন্দেহে নরেন্দ্র মোদি সরকারের অস্বস্তি বাড়িয়ে তুলেছে।

বেশ বোঝা যাচ্ছে, পেহেলগামকাণ্ড ও অপারেশন সিঁদুর নাম দিয়ে পাকিস্তানে হামলার পর কূটনৈতিক স্তরে ভারত এ যাবত যা কিছু করেছে, কোনোটাই সেভাবে ফল দিতে পারেনি। ৫৯ জনের সাতটি সর্বদলীয় প্রতিনিধিদল, যাঁদের মধ্যে সাবেক কূটনীতিকেরাও ছিলেন—এত দিন ধরে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পৃথিবীর ৩৩টি দেশ সফর করে ফিরে আসার পর আসিম মুনিরের আমন্ত্রণ পাওয়া বোঝাচ্ছে, সন্ত্রাসবাদ নিয়ে ভারতের ব্যাখ্যা যুক্তরাষ্ট্রকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। নইলে মার্কিন জেনারেল কুরিল্লা বলতেন না, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানকেও তাঁদের প্রয়োজন। আইসিস–খোরাসানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পাকিস্তানের সাহায্যের কথা উল্লেখ করে জেনারেল কুরিল্লা বলেছেন, ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পাকিস্তান বরাবরই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গী।’

অর্থাৎ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভারত ও পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্র একই পঙ্ক্তিতে রাখতে চায়। ভারতীয় আখ্যানকে ট্রাম্প প্রশাসন আমল দিতে নারাজ। লক্ষ্যণীয়, জেনারেল কুরিল্লার এই মন্তব্য সেই সময় এল, যখন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর সন্ত্রাসবাদ দমনে ভারত ও পাকিস্তানকে এক আসনে বসানোর বিরুদ্ধে পশ্চিমা দুনিয়ার সমালোচনা করে ব্রাসেলসে বলছেন, ‘এখনো যদি কেউ বিপদ না বোঝে, তা হলে একদিন তাদের পস্তাতে হবে। সন্ত্রাসের ছোবল তাদেরও খেতে হবে।’

এই প্রসঙ্গে পাকিস্তানকে টেনে জয়শঙ্কর বলেছিলেন, ‘ওসামা বিন লাদেনের কথা নিশ্চয় মনে আছে? ভেবে দেখেছেন, কেন তিনি বছরের পর বছর পাকিস্তানি সেনাছাউনির পাশে বসবাস করা নিরাপদ মনে করতেন?’ ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পশ্চিমা দুনিয়াকে মনে করিয়ে দেন, ‘এটা নিছক ভারত–পাকিস্তান দ্বন্দ্ব নয়। মূল বিষয় হলো সন্ত্রাসবাদ।’ প্রতিনিধিদলে অংশ নিলেও প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস তাই ওই পদক্ষেপকে ‘বিরাট ব্যর্থতা’ বলে জাহির করতে ছাড়ছে না। সরকারি নীতির সমালোচনা করে কংগ্রেস বলেছে, এত কিছু সত্ত্বেও পাকিস্তান আন্তর্জাতিক সংস্থায় প্রতিনিধিত্ব করছে। অবাধে আন্তর্জাতিক ঋণ পাচ্ছে। পেহেলগামে হামলার জন্য কোনো দেশই পাকিস্তানকে সরাসরি দায়ী করছে না। ভারতের পক্ষেও কেউ জোরালভাবে দাঁড়ায়নি। পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাতের পর ৩৩টি দেশে সর্বদলীয় প্রতিনিধিদল পাঠানোর মধ্য দিয়ে দেশীয় রাজনীতিতে মোদি সরকার যে বাহবা আদায় করতে চেয়েছে, রাজনৈতিক সাফল্য দাবি করে প্রচার তুঙ্গে তুলেছে, তা যে আদৌ আশানুরূপ ফল দেয়নি, এই ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে তা স্পষ্ট। প্রতিনিধিদলগুলোর প্রধান কাজই ছিল সন্ত্রাসবাদ নিয়ে পাকিস্তানকে নেতিবাচকভাবে তুলে ধরা। প্রতিনিধিদলে অংশ নিলেও প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস তাই ওই পদক্ষেপকে ‘বিরাট ব্যর্থতা’ বলে জাহির করতে ছাড়ছে না। সরকারি নীতির সমালোচনা করে কংগ্রেস বলেছে, এত কিছু সত্ত্বেও পাকিস্তান আন্তর্জাতিক সংস্থায় প্রতিনিধিত্ব করছে। অবাধে আন্তর্জাতিক ঋণ পাচ্ছে। পেহেলগামে হামলার জন্য কোনো দেশই পাকিস্তানকে সরাসরি দায়ী করছে না। ভারতের পক্ষেও কেউ জোরালোভাবে দাঁড়ায়নি। কংগ্রেস মুখপাত্র সুপ্রিয়া শ্রিনাতে এসব বিষয়ের উল্লেখ করে বলেছেন, ‘১১ বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে ক্ষমতায় রয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। ৯০টি দেশ সফর করেছেন। অথচ তাঁর ব্যর্থ কূটনীতির কারণে ভারত কিছুই আদায় করতে পারল না।’

ফিল্ড মার্শাল মুনিরকে যুক্তরাষ্ট্রের আমন্ত্রণের খবর পাওয়ার পর কংগ্রেসের আরেক মুখপাত্র জয়রাম রমেশও সরব। ‘এক্স’ হ্যান্ডেলে তিনি লিখেছেন, ‘এই ব্যক্তিই পেহেলগাম হামলার আগে উসকানিমূলক বক্তব্য রেখেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র কী করতে চাইছে। এটা ভারতের এক বিরাট কূটনৈতিক পরাজয়।’ মোদি সরকারের যাবতীয় উদ্যোগ কেন কূটনৈতিক পরাজয় হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে? বিরোধী মহলের মতে—প্রথমত, বিশ্বজুড়ে ভারতের কূটনৈতিক দৌত্যের মধ্যেই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের তালেবান নিষেধাজ্ঞা কমিটির চেয়ারম্যান ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা কমিটির ভাইস চেয়ারম্যানের পদ পেয়েছে পাকিস্তান। দুটি ক্ষেত্রেই ভারতের আপত্তি ছিল তীব্র। কিন্তু আপত্তি ধোপে না টেকা অবশ্যই ভারতীয় কূটনৈতিক ব্যর্থতা। কারণ, ভারত এমন বয়ান তৈরি করতে চেয়েছে, সন্ত্রাসবাদ ও পাকিস্তান সমার্থক এবং পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদের আঁতুর ঘর। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত বুঝিয়ে দিচ্ছে, বৈশ্বিক–দুনিয়া তা গ্রহণ করেনি। এর ফলে আফগানিস্তান ও সন্ত্রাসবাদ নিয়ে পাকিস্তানের মনোভাব প্রতিষ্ঠা সহজতর হবে, যা ভারতের স্বার্থবিরোধী। দ্বিতীয়ত, পেহেলগামকাণ্ড ও দুই দেশের সংঘাতের সময়েই পাকিস্তান পর পর তিন তিনটি আন্তর্জাতিক ঋণ পেয়েছে। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) ঋণ দিয়েছে ১০০ কোটি ডলার, বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে বিপুল অঙ্কের পার্টনারশিপ ফ্রেমওয়ার্ক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ৮০ কোটি কোটি ডলারের ঋণ। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঋণের বিরুদ্ধে ভারত জনমত গঠনের চেষ্টা করেছিল। বারবার আশঙ্কার কথা জানিয়েছে। বলেছে, ঋণের শর্ত মেনে তারা সংস্কারের পথে হাঁটে না। বরং ঋণের টাকা সন্ত্রাসবাদের উসকানিতে ব্যবহার করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও পাকিস্তানের ঋণ প্রাপ্তি বুঝিয়ে দেয়, ভারতের কূটনৈতিক দৌত্যের সীমাবদ্ধতা।

বিশ্বজুড়ে ভারতের কূটনৈতিক দৌত্যের মধ্যেই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের তালেবান নিষেধাজ্ঞা কমিটির চেয়ারম্যান ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা কমিটির ভাইস চেয়ারম্যানের পদ পেয়েছে পাকিস্তান। দুটি ক্ষেত্রেই ভারতের আপত্তি ছিল তীব্র। কিন্তু আপত্তি ধোপে না টেকা অবশ্যই ভারতীয় কূটনৈতিক ব্যর্থতা। তৃতীয়ত, ক্রমাগত দৌত্য সত্ত্বেও নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের অথবা অন্য গুরুত্বপূর্ণ দেশকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে দাঁড় করাতে ভারত ব্যর্থ হয়েছে। বরং চীন, তুরস্ক ও আজারবাইজান জোরালোভাবে সমর্থন করেছে পাকিস্তানকে। দুই দেশের সংঘাতের পর ভারতের আত্মরক্ষার অধিকারকে সমর্থন করেছিল ইসরাইল ও ফ্রান্স। কিন্তু সেই সঙ্গে তারা সংযম ও উত্তেজনা প্রশমনের কথাও বলেছিল।

চারদিনের যুদ্ধে চীনের যুদ্ধবিমান ও ক্ষেপনাস্ত্র এবং তুরস্কের ড্রোন ব্যবহার করেছে পাকিস্তান। জি২০–র সাফল্য প্রচার সত্ত্বেও ‘পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসবাদ দমনে’ ভারত কেন ‘নির্বান্ধব’ সেই প্রশ্ন উঠে গেছে। যদিও উত্তর দেওয়ার বাধ্যবাধকতার মধ্য দিয়ে মোদি সরকার হাঁটছে না। পেহেলগাম ও পাকিস্তানে হামলা নিয়ে সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডাকার বিরোধী দাবি এখনো অরণ্যে রোদনের শামিল।

চতুর্থত, ভারতের সর্বদলীয় প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাতের ২৪ ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই কুয়েত সরকার পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য সে দেশে আসার ওপর থাকা ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। ১৯ বছর ধরে পাকিস্তানিরা কুয়েতে যেতে পারতেন না। এই সিদ্ধান্তের ফলে সে দেশের কাজের বাজার পাকিস্তানিদের জন্য উন্মুক্ত হয়ে গেল। কুয়েতের দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিক বাজারে এবার থেকে ভারতীয়দের প্রতিযোগিতার মুখে ফেলবে পাকিস্তান। বিরোধীদের দাবি, অতীতে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি পুরোপুরি সফল ছিল, বলা যাবে না। ত্রটি–বিচ্যুতি থাকত, তা শোধরানোও হতো। কিন্তু গোটা বিশ্ব এখন জেনে গেছে, ‘হিন্দুত্ববাদী’ মোদি সরকার রাজনৈতিক স্বার্থে দেশের পররাষ্ট্রনীতিকে ব্যবহার করছে। ফলে সেই বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে গেছে। সন্ত্রাসবাদ দমনে ভারত ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ব্যবহার করছে, পাকিস্তানকেন্দ্রিক এই আখ্যান পশ্চিমা দুনিয়া আর গ্রহণ করছে না।

ভারতের সর্বদলীয় প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাতের ২৪ ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই কুয়েত সরকার পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য সে দেশে আসার ওপর থাকা ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। ১৯ বছর ধরে পাকিস্তানিরা কুয়েতে যেতে পারতেন না। ভারত যতই দাবি করুক, তৃতীয় কোনো দেশের হস্তক্ষেপে যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি, পাকিস্তানের পীড়াপীড়িতেই ভারত সাড়া দিয়েছে, এখনো তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। ১২ মে থেকে ৫ জুন—এই ২৫ দিনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ৯ বার বলেছেন, তাঁর হুমকিতেই যুদ্ধবিরতি। দুই দেশকে তিনিই বলেছেন, যুদ্ধ বন্ধ করলে দুই দেশের সঙ্গে তাঁরা বাণিজ্য চুক্তি করবেন।

ট্রাম্পের এই দাবি যে পুরোপুরি অসত্য, নরেন্দ্র মোদি এখনো একবারের জন্যও তা বলেননি। বরং তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপেই যে যুদ্ধবিরতি, ভারতের সর্বঋতুর মিত্র রাশিয়ার প্রসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তা স্বীকার করেছেন। পুতিনের ঘনিষ্ট সহযোগী সাবেক কূটনীতিক উরি ঊষাকভ নিজেই সে কথা জানিয়ে বলেছেন, ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলার সময় পুতিন এই জন্য তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এটাও মোদি সরকারের পক্ষে কম বিড়ম্বনার নয়। কারণ, ভারত–পাকিস্তান দ্বন্দ্বের অবসানে তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপের তীব্র বিরোধিতা ভারত বরাবর করে আসছে। মোদি সরকারের এসব অস্বস্তি রাজনৈতিক দিক থেকে বিরোধীরা কতটা কাজে লাগাতে পারবে, সেটা পরের কথা। যদিও সন্দেহাতীতভাবে ভারতের কূটনৈতিক তৎপরতা ঘিরে বহু প্রশ্নের জন্ম হয়েছে, যার উত্তর সরকার এখনো দেয়নি।