ইসরাইলের সাম্প্রতিক হামলায় গাজার আল-আহলি হাসপাতালে আহতদের চিকিৎসা দেওয়ার মতো আর কোনও জায়গা অবশিষ্ট নেই। শুক্রবার (৪ এপ্রিল) ভোর থেকে অন্তত ৩৮ জন ফিলিস্তিনী নিহত ও শতাধিক আহত হওয়ার পর হাসপাতালের পরিচালক এ কথা জানিয়েছেন। এদিকে ১৮ মার্চ যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করার পর থেকে গাজায় ইসরাইলী হামলায় প্রতিদিন কমপক্ষে ১০০ শিশু হতাহত হচ্ছে বলে দাবি করেছে জাতি সংঘ। জাতিসংঘের ফিলিস্তিনী শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনআরডব্লিউএ) প্রধান ফিলিপ লাজারিনি জানিয়েছেন, পরিস্থিতি ক্রমাগত অবনতির দিকে যাচ্ছে এবং মানবিক সংকট চরমে পৌঁছেছে। হাজার হাজার শিশু হাত-পা হারিয়েছে এবং তারা চরম মানসিক ট্রমার ভেতর দিয়ে দিন কাটাচ্ছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতালটিতে গত ২৪ ঘণ্টায় ৮৬ জন নিহত ও ২৮৭ জন আহত হন। আল-জাজিরা, আনাদুলো।
হামাস সতর্ক করে বলেছে, গাজায় অবশিষ্ট যে বন্দিরা রয়েছে তাদের অর্ধেকই এখন চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। কারণ তারা ইসরাইলী সেনাবাহিনীর নতুন জোরপূর্বক উৎখাত আদেশপ্রাপ্ত এলাকায় অবস্থান করছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরাইলের গাজা যুদ্ধের ফলে এখন পর্যন্ত অন্তত ৫০ হাজার ৬০৯ জন ফিলিস্তিনী নিহত এবং ১ লাখ ১৫ হাজার ০৬৩ জন আহত হয়েছে। সরকারি মিডিয়া অফিস, মৃতের সংখ্যা ৬১ হাজার ৭০০-এর বেশি বলে জানিয়েছে। ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে থাকা হাজার হাজার নিখোঁজকে মৃত ধরে নেওয়া হচ্ছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস নেতৃত্বাধীন হামলায় ইসরাইলে কমপক্ষে ১ হাজার ১৩৯ জন নিহত হন। ওই সময় ২০০ জনের বেশি মানুষকে জিম্মি করা হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় ওই দিনই গাজায় সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করে ইসরাইল।
গাজা যুদ্ধে ইসরাইল এ পর্যন্ত ২৩২ জন সাংবাদিককে হত্যা করেছে
সাংবাদিকদের জন্য বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহত পরিসংখ্যান এটি; ওয়াটসন ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড পাবলিক অ্যাফেয়ার্সের ‘কস্টস অফ ওয়ার’ প্রকল্পের প্রতিবেদনে ঘোষণা করা হয়েছে যে গাজার বিরুদ্ধে ইসরাইলের আগ্রাসনের সময় ২৩২ জন সাংবাদিক শহীদ হয়েছেন। প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে গাজা যুদ্ধে ইসরাইলী হামলায় এখন পর্যন্ত ২৩২ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, যা প্রতি সপ্তাহে গড়ে ১৩ জন। পার্সটুডে-র মতে, এই পরিসংখ্যান গাজা যুদ্ধকে মিডিয়া কর্মীদের জন্য ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক যুদ্ধে পরিণত করেছে।
গাজা যুদ্ধে প্রাণ হারানো সাংবাদিকের সংখ্যা দুটি বিশ্বযুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, যুগোস্লাভ যুদ্ধ এবং আফগানিস্তানে মার্কিন যুদ্ধে এই পেশায় নিহত সাংবাদিকদের সম্মিলিত সংখ্যার চেয়েও বেশি। এই যুদ্ধটি সাংবাদিকদের জন্য ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ সামরিক সংঘাত। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে গাজার কতজন ফিলিস্তিনী সাংবাদিক সরাসরি ইসরাইলী আগ্রাসনের শিকার হয়েছে এবং তাদের মধ্যে কতজন হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিকের মতো ইসরাইলী বোমা হামলার শিকার হয়েছেন এবং নিহত হয়েছেন তা স্পষ্ট নয়। তবে, প্রতিবেদনে প্যারিস-ভিত্তিক সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ ৩৫টি ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়েছে যেখানে দখলদার বাহিনী সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করে হত্যা করেছে, সম্ভবত তাদের পেশাগত কাজের কারণে। কস্টস অফ ওয়ার প্রকল্পের প্রতিবেদন অনুসারে, গাজায় সাংবাদিকদের উপর হামলা, যেখানে প্রায় কোনও বিদেশী সাংবাদিককে প্রবেশের অনুমতি নেই। এসব সাংবাদিক যাদের বেশিরভাগই কম বেতন পায়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: ‘সাংবাদিকদের হত্যা এবং সংবাদ পরিবেশনে সেন্সরশিপ আরোপের সবচেয়ে স্পষ্ট উদাহরণ হল গাজা।’
ইসরাইলের বিমান হামলায় একদিনে নিহত ৮৬
ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) বিমান অভিযানে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় নিহত হয়েছেন ৮৬ জন ফিলিস্তিনী এবং আহত হয়েছেন আরও অন্তত ২৮৭ জন। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে নিশ্চিত করেছে এ তথ্য।
২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় অভিযান শুরু করে আইডিএফ। শুক্রবারের অভিযানের পর গত দেড় বছরে উপত্যকায় মোট নিহত ও আহতের সংখ্যা পৌঁছেছে যথাক্রমে ৫০ হাজার ৬০৯ জন এবং ১ লাখ ১৫ হাজার ৬৩ জনে। এই নিহত এবং আহতদের ৫৬ শতাংশই নারী ও শিশু। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইলের ভূখণ্ডে ঢুকে অতর্কিত হামলা চালায় গাজা উপত্যকা নিয়ন্ত্রণকারী সশস্ত্র রাজনৈতিক গোষ্ঠী হামাসের যোদ্ধারা। এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে ১ হাজার ২০০ জনকে হত্যার পাশাপাশি ২৫১ জনকে জিম্মি হিসেবে ধরে নিয়ে যায় তারা।
জিম্মিদের মুক্ত করতে ওই দিন থেকেই গাজায় অভিযান শুরু করে ইসরাইলী বাহিনী। ১৫ মাসেরও বেশি সময় ধরে টানা অভিযান চালানোর পর যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যস্থতাকারী অন্যান্য দেশগুলোর চাপে বাধ্য হয়ে গত ১৯ জানুয়ারি গাজায় যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে ইসরাইল। কিন্তু বিরতির দু’মাস শেষ হওয়ার আগেই গত ১৮ মার্চ থেকে ফের গাজায় সামরিক অভিযান শুরু করে আইডিএফ। দ্বিতীয় দফার এ অভিযানে গত ১৫ দিনে গাজায় নিহত হয়েছেন ১ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনী। যে ২৫১ জন জিম্মিকে হামাসের যোদ্ধারা ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তাদের মধ্যে এখনও অন্তত ৩৫ জন জীবিত রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আইডিএফ ঘোষণা দিয়েছে যে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে তাদের উদ্ধার করা হবে।
জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার গাজায় সামরিক অভিযান বন্ধের জন্য ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে আহ্বান জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে জাতিসংঘের আদালত নামে পরিচিত ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে (আইসিজে) ইসরাইলের বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলাও দায়ের করা হয়েছে। তবে নেতানিয়াহু স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, হামাসকে পুরোপুরি দুর্বল ও অকার্যকর করা এবং জিম্মিদের মুক্ত করা এই অভিযানের লক্ষ্য এবং লক্ষ্য পূরণ না হওয়া পর্যন্ত অভিযান চলবে গাজায়।