ভারতের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভার পর এবার উচ্চকক্ষ রাজ্যসভাতেও পাস হয়ে গেল ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল। রাজ্যসভার সদস্যদের মধ্যে বিলের পক্ষে ভোট দিয়েছেন ১২৮ জন, আর বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন ৯৫ জন সদস্য। গভীর রাতের এই ভোটভুটির মধ্যদিয়ে উচ্চকক্ষে পাস হলো বিতর্কিত এই সংশোধনী বিলটি। এখন কেবল ভারতের প্রেসিডেন্ট দ্রৌপদী মুর্মুর স্বাক্ষরের অপেক্ষা। তিনি সই করলেই ৭০ বছরের পুরোনো আইন বদলে কার্যকর হবে নতুন আইন। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম বলছে, লোকসভায় পাস হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই সংসদের উচ্চকক্ষেও ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল পাস হয়ে যাওয়ায় বিলটির আইনে পরিণত হওয়া শুধু এখন সময়ের অপেক্ষা। প্রেসিডেন্ট দ্রৌপদী মুর্মু সই করলেই বদলে যাবে ৭০ বছরের পুরনো আইন। এনডিটিভি।

১৯৫৪ সালের আইনকে সংশোধন করে ১৯৯৫ সালে ওয়াকফ বোর্ডের ক্ষমতা অনেকটাই বাড়িয়েছিল ভারত সরকার। কিন্তু ৩০ বছর পরে যে সংশোধনে অনুমোদন দিল ভারতীয় সংসদ, তাতে বোর্ডের ক্ষমতা এবং কার্যকারিতার সবই বদলে যেতে চলেছে। সব বিরোধী দলেরই দাবি, ওয়াকফ আইনের এই সংশোধন ওয়াকফ বোর্ডের ক্ষমতাকে নজিরবিহীনভাবে খর্ব করে দিচ্ছে। সমস্ত বিতর্ক এবং সংশোধনী নিয়ে ভোটাভুটি শেষে বৃহস্পতিবার গভীর রাত ২টা ১৯ মিনিটে “ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল, ২০২৫” পাস করানোর প্রস্তাব পেশ করেন সংসদীয় এবং সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী কিরেন রিজিজু। ধ্বনিভোটের ফলাফলে বিরোধী শিবির সন্তুষ্ট হয়নি। তারা বিভাজন (ডিভিশন) চায়। ভোটাভুটি শেষে রাত ২টা ৩৪ মিনিটে ফল ঘোষিত হয়। তাতে দেখা যায় বিলের পক্ষে পড়েছে ১২৮টি ভোট। আর বিপক্ষে পড়েছে ৯৫টি ভোট। ৩৩ ভোটের ব্যবধানে ওয়াকফ বিল রাজ্যসভায় পাস হয়ে যায়। বিতর্ক চলে ১২ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে।

এর আগে বৃহস্পতিবার দুপুর ১টার দিকে রাজ্যসভায় ওয়াকফ বিল নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। সংসদীয় বিষয়ক এবং সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী কিরেন রিজিজুর ভাষণের মাধ্যমেই আলোচনা তথা বিতর্কের সূত্রপাত। রিজিজুর দাবি, ওয়াকফ সম্পত্তির অন্যতম লক্ষ্য হলো সেই সম্পত্তির মাধ্যমে মুসলিম সমাজের গরিব, নারী ও এতিম শিশুদের উন্নয়ন। নতুন আইনে বিপুল রাজস্ব আদায় হবে বলেও রিজিজু সংসদে দাবি করেন।

তবে অধিকাংশ বিরোধী দল এই বিলের বিপক্ষে কথা বলেছে। বলা হয়েছে, এই বিলের মাধ্যমে মেরুকরণের রাজনীতি করছে বিজেপি। শুধু তা-ই নয়, এই বিল যেভাবে পাস করানো হয়েছে সেই কার্যপ্রণালী নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাত থেকেই দেশের একাধিক মুসলিম সংগঠন এই বিলের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছে।

বিরোধীদের বক্তব্য, সংসদের বাইরে এই বিলের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলবে। বিরোধী ইন্ডিয়া জোট এককাট্টা হয়ে এই বিলের বিরোধিতা করেছে। তারা সংশোধিত বিলটিকে “অসাংবিধানিক” আখ্যা দিয়েছে। তাদের বক্তব্য, জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটি বা জেপিসি বিরোধীদের মতামতে কর্ণপাত করেনি। কংগ্রেস জানিয়েছে, সরকার সংখ্যালঘুদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। এআইএমআইএম-এর আসাদউদ্দিন ওয়াইসি জানান, তিনি প্রতীকী পদক্ষেপে মহাত্মা গান্ধীর অনুসরণে এই আইন ছিঁড়ে প্রতিবাদ জানালেন। তিনি বলেন, “২০১৩ সালে যখন লালকৃষ্ণ আদভানি, সুষমা স্বরাজের উপস্থিতিতে সর্বসম্মতিক্রমে বিলের সংশোধনী পাস হয় তখন কোনও বিতর্ক হয়নি”। তার প্রশ্ন, “তারা কি ভুল ছিলেন?” অন্যদিকে, উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনার সংসদ সদস্য অরবিন্দ সাওয়ন্ত ওয়াকফ বোর্ডে অ-মুসলমান সদস্য এবং ওয়াকফ ট্রাইব্যুনালের সিইও পদে আমলা নিযুক্ত করার সমালোচনা করে বলেছেন, “সরকার কি মন্দির কমিটিতে অ-হিন্দুদের থাকার অনুমতি দেবে?”

বিলের প্রতিবাদে কলকাতা চেন্নাইতে বিক্ষোভ

সংগ্রাম ডেস্ক: ভারতের লোকসভায় বিতর্কিত মুসলিম ওয়াকফ সংশোধনী বিল পাসের প্রতিবাদে শুক্রবার কলকাতা, চেন্নাই ও আহমেদাবাদে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। জুমার নামায শেষে মুসলিম সম্প্রদায়ের হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। বিক্ষোভকারীরা জাতীয় পতাকা ও প্লাকার্ড নিয়ে ‘ওয়াকফ সংশোধনী বিল প্রত্যাখ্যান’ স্লোগান দেন। এএনআই, এনডিটিভি।

কলকাতায় ‘জয়েন্ট ফোরাম ফর ওয়াকফ প্রোটেকশন’-এর ডাকে বিক্ষোভ হয়। বার্তা সংস্থা -এর ভিডিওতে দেখা গেছে, বিক্ষোভস্থলে উন্মুক্ত স্থানে জমায়েত হয়ে বক্তারা বিলটির বিরোধিতা করেন। আহমেদাবাদে পরিস্থিতি বেশি উত্তপ্ত ছিল। পুলিশ সেখানে রাস্তায় অবস্থান নেওয়া বয়োজ্যেষ্ঠ বিক্ষোভকারীদের জোর করে সরানোর চেষ্টা করে। অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন (এআইএমআইএম)-এর গুজরাট শাখার প্রধানসহ ৪০ জনকে আটক করা হয়।

চেন্নাইতে অভিনেতা বিজয়ের তামিলাগা ভেট্রি কাজাগাম (টিভিকে) রাজ্যব্যাপী বিক্ষোভের ডাক দেয়। চেন্নাই, কোয়েম্বাটুর ও তিরুচিরাপল্লীতে টিভিকে কর্মীরা ‘ওয়াকফ বিল প্রত্যাখ্যান’ ও ‘মুসলিমদের অধিকার কেড়ো না’ স্লোগান দেন। আগামী বছর বিধানসভা নির্বাচনের আগে রাজনীতিতে ‘ডার্ক হর্স’ হিসেবে দেখা হচ্ছে বিজয়কে। তিনি এই বিলকে ‘গণতন্ত্রবিরোধী’ আখ্যা দিয়ে বলেছেন, এটি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ ভিত্তিকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। লখনউতেও উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়। ডেপুটি কমিশনার অব পুলিশ (সেন্ট্রাল লখনউ) আশীষ শ্রীবাস্তব বলেন, আমরা সবাইকে বিলটি ভালোভাবে পড়ে মতামত দিতে বলেছি। সোশ্যাল মিডিয়া নিয়মিত মনিটর করছি আমরা।

রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়াচ্ছে

পশ্চিমবঙ্গে আগামী বছর নির্বাচনের মুখে এই বিক্ষোভ পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করবে বলে মনে করা হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইতোমধ্যে বলেছেন, তিনি রাজ্যের মুসলিমদের জমি হারাতে দেবেন না। বিজেপিকে দেশ বিভক্ত করার চেষ্টার অভিযোগ এনে তিনি বলেছেন, নতুন অ-বিজেপি সরকার কেন্দ্রে গঠিত হলে এই বিল বাতিল করা হবে। বিক্ষোভকারীদের প্রধান উদ্বেগ, নতুন ওয়াকফ আইন প্রযোজ্য হলে তা বিদ্যমান সম্পত্তিগুলোকে প্রভাবিত করতে পারে। তবে কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী কিরেন রিজিজু পার্লামেন্টে বলেছেন, আইনটি ভবিষ্যতের জন্য প্রযোজ্য হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও তাকে সমর্থন জানিয়েছেন।

বিতর্কিত ওয়াকফ বিল

মুসলিমদের ধর্মীয় ও দাতব্য সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণকারী ওয়াকফ আইনে বড় ধরনের সংশোধনী এনেছে এই বিল। প্রায় ২০ ঘণ্টার তর্ক-বিতর্কের পর লোকসভায় এটি পাস হয়। বিরোধীরা এটিকে ‘মুসলিমবিরোধী’ আখ্যা দিলেও সরকারি দলগুলো একে ‘ঐতিহাসিক সংস্কার’ বলে অভিহিত করেছে। বিলটি লোকসভায় ২৮৮-২৩২ এবং রাজ্যসভায় ১২৮-৯৫ ভোটে পাস হয়েছে। এখন রাষ্ট্রপতির সম্মতি পেলেই এটি আইনে পরিণত হবে।

বিলের মূল পরিবর্তনগুলো

রাজ্য ওয়াকফ বোর্ড এবং কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিলে দুইজন অ-মুসলিম সদস্য নিয়োগ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। দানকারীদের কমপক্ষে পাঁচ বছর ধরে অনুশীলনকারী মুসলিম হওয়ার শংসাপত্র দিতে হবে। মুসলিম সম্প্রদায় ও বিরোধীদের আশঙ্কা, এই সংশোধনীর মাধ্যমে কেন্দ্র ওয়াকফ বোর্ডগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে। তবে রিজিজু এ অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন।

পার্লামেন্টে তীব্র বিতর্ক

কংগ্রেস সাংসদ সোনিয়া গান্ধী এই বিলকে সংবিধানের ওপর ‘স্পষ্ট আক্রমণ’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, বিজেপি সমাজকে ‘স্থায়ীভাবে বিভক্ত’ রাখতে চায়। বিজেপি তার এই মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানিয়েছে। পার্লামেন্টে এই বিল নিয়ে তীব্র বাকবিতণ্ডা হয়। রাজ্যসভায় রেকর্ড ১৭ ঘণ্টা ২ মিনিট এবং লোকসভায় ১২ ঘণ্টার বেশি আলোচনা হয়।