এনডিটিভি, ইন্ডিয়া টুডে, ডন, ওয়েবসাইট : পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সংলাপের জন্য সৌদি আরব একটি ‘নিরপেক্ষ’ স্থান হতে পারে। গত বুধবার সাংবাদিকদের এমনটাই বলেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে একদল টেলিভিশন সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে সংলাপে কাশ্মীর, পানি, বাণিজ্য ও সন্ত্রাসবাদ হবে মূল আলোচ্য বিষয়। পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম এ খবর জানিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতার প্রস্তাবের আলোকে যদি কোনও তৃতীয় স্থানে সংলাপের সম্ভাবনা থাকে—এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী চীনকে নিরপেক্ষ ভেন্যু হিসেবে প্রত্যাখ্যান করেন। বলেন, ভারত কখনোই তাতে রাজি হবে না। তবে প্রধানমন্ত্রী আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, সৌদি আরব এমন একটি তৃতীয় দেশ হতে পারে, যেখানে উভয় পক্ষ আলোচনা করতে রাজি হতে পারে। ভারত সংলাপে সন্ত্রাসবাদ নিয়ে আলোচনা করতে চায়, আর পাকিস্তান চায় কাশ্মীরকে প্রাধান্য দিতে। এমন বিষয় নিয়ে শাহবাজ শরিফ আবারও জোর দিয়ে বলেন, ‘কাশ্মীর, পানি, বাণিজ্য ও সন্ত্রাসবাদ—এই চারটি বিষয়ই পাকিস্তান-ভারত সংলাপের মূল পয়েন্ট হবে।’

পিটিআই নেতৃত্বাধীন খাইবার পাখতুনখোয়া (কেপি) সরকার সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কেন্দ্র থেকে সহযোগিতা পাচ্ছে কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কেন্দ্র ইতোমধ্যেই সহায়তা দিচ্ছে এবং পাবলিক সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের (পিএসডিপি) অধীনে কেপি সরকারকে ৬০০ বিলিয়ন রুপি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে উত্তেজনা কমছে, কারণ উভয় দেশের ডিজিএমও (সামরিক কার্যক্রমের মহাপরিচালক) একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।

তিনি জানান, যদি দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দেশের মধ্যে সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নেতৃত্ব দেবেন।

ট্রাম্পের মধ্যস্থতার দাবি উড়িয়ে দিল ভারত: ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতার কথা উড়িয়ে দিল ভারত। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণভাবে দ্বিপাক্ষিক সমঝোতার মাধ্যমে হয়েছে। কোনও আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার কারণে নয়। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের কোনও হস্তক্ষেপ এতে ছিল না। নেদারল্যান্ডসভিত্তিক সম্প্রচার সংস্থা এনওএস’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।

জয়শঙ্কর আরও বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় নীতির অংশ হিসেবে সন্ত্রাসবাদ ব্যবহারের বিরুদ্ধে ভারতের দীর্ঘদিনের উদ্বেগ রয়েছে এবং ভারত এই ধরনের হুমকির জবাবে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার অধিকার রাখে। ২২ এপ্রিল জম্মু ও কাশ্মীরের পেহেলগাঁওয়ে এক হামলায় ২৬ জন নিহত হয়। এ ঘটনায় পাকিস্তানের মদত রয়েছে বলে অভিযোগ করে ভারত। তবে পাকিস্তান সেই অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করেছে। এরপরও পাকিস্তান ও পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরের নয়টি স্থান লক্ষ্য করে হামলা চালায় ভারত। এই অভিযানের নাম দেওয়া হয় অপারেশন সিঁদুর। এতে বেশ কিছু মানুষ হতাহত হয়।

ওই অভিযান নিয়ে জয়শঙ্কর বলেন, অপারেশন সিঁদুর চলমান রয়েছে। কারণ এর মাধ্যমে একটি স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হচ্ছে। তা হলো ২২ এপ্রিলের মতো ঘটনা ঘটলে জবাব দেওয়া হবেই। আমরা সন্ত্রাসীদের লক্ষ্য করব। তারা যদি পাকিস্তানে থাকে, সেখানেই তাদের আঘাত করা হবে। তবে তিনি স্পষ্ট করেন, এই চলমান অপারেশন মানেই সরাসরি যুদ্ধ নয়। অপারেশন সক্রিয় থাকা মানে দু’পক্ষ যুদ্ধ করছে এমন নয়। বর্তমানে একটি যুদ্ধবিরতি ও সামরিক কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। সুতরাং এটি এখন নিষ্ক্রিয় পর্যায়ে রয়েছে।

জয়শঙ্কর জানান, ১০ মে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী হটলাইন মারফত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয় এবং ভারত তাতে সম্মত হয়। তিনি বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রথমে জানায় তারা গোলাগুলি বন্ধ করতে প্রস্তুত এবং আমরা সাড়া দিই। অন্যান্য দেশ- যেমন যুক্তরাষ্ট্র এই পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল এবং উভয়পক্ষকে ফোন করেছিল, তবে যুদ্ধবিরতি সম্পূর্ণভাবে দিল্লি ও ইসলামাবাদের মধ্যকার বিষয় বলেই জয়শঙ্কর দৃঢ়তার সঙ্গে জানান।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ছিল যুক্তরাষ্ট্রেই। এটা দিয়ে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, ওয়াশিংটনের কোনও সক্রিয় ভূমিকা ছিল না। তিনি নিশ্চিত করেন যে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও তাকে ফোন করেছিলেন। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ফোন করেছিলেন। কিন্তু এই ফোনকল ছিল শুধুই উদ্বেগ জানাতে। জয়শঙ্কর বলেন, আমরা সবার কাছে, শুধু আমেরিকার নয়, সবাইকে স্পষ্ট করে বলেছি- পাকিস্তান যদি যুদ্ধ বন্ধ করতে চায়, তাহলে তারা আমাদের জানাক। আমরা এটা তাদের সেনাপতির মুখে শুনতে চাই। আর সেটাই ঘটেছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সেই বহুল আলোচিত দাবি- তিনি এই যুদ্ধবিরতির মধ্যস্থতা করেছেন এবং ‘হাজার বছরের পুরোনো দ্বন্দ্ব’ সমাধানের প্রস্তাব দিয়েছেন, এটা একেবারে উড়িয়ে দেন জয়শঙ্কর। তিনি বলেন, এটি আমাদের ও পাকিস্তানের মধ্যকার বিষয়। আমরা একে দ্বিপাক্ষিকভাবে মীমাংসা করব।

অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করে ভারতীয় কূটনীতিককে দেশত্যাগের নির্দেশ পাকিস্তানের: পাকিস্তানে নিযুক্ত এক ভারতীয় কূটনীতিককে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দেশত্যাগের নির্দেশ দিয়েছে ইসলামাবাদ। তার বিরুদ্ধে ‘কূটনৈতিক মর্যাদার পরিপন্থী কর্মকা-ে’ জড়িত থাকার অভিযোগ এনেছে পাকিস্তান। এ পদক্ষেপটি এসেছে নয়াদিল্লিতে নিযুক্ত এক পাকিস্তানি কূটনীতিককে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায়, যা দক্ষিণ এশিয়ার দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দেশের মধ্যে কূটনৈতিক উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম সামা টিভির বরাতে জানা গেছে, ইসলামাবাদে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনের ওই কর্মকর্তাকে গতকাল বৃহস্পতিবার পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে এনে এই সিদ্ধান্ত জানানো হয়। পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জানান, ভারতীয় চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সকে ডেকে জানানো হয়েছে যে, কোনো কূটনীতিক যেন তাদের মর্যাদা ও কূটনৈতিক সুবিধার অপব্যবহার না করেন—এ বিষয়ে পাকিস্তান কঠোর অবস্থানে রয়েছে।

পাল্টা বহিষ্কার: এর আগে, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, পাকিস্তানি হাইকমিশনের একজন কর্মকর্তার কার্যক্রম ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশনের পরিপন্থী ছিল। ফলে তাকে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করে বহিষ্কার করা হয়। সরকারিভাবে তার পরিচয় প্রকাশ না করা হলেও, ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানায়, তিনি পাকিস্তান হাইকমিশনের গোয়েন্দা শাখার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

উত্তেজনা ক্রমশ বাড়ছে: মাত্র আট দিন আগেও একই ধরনের অভিযোগে নয়াদিল্লি থেকে এক পাকিস্তানি কূটনীতিককে বহিষ্কার করা হয়েছিল। এখন পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ভারতীয় কূটনীতিককে বহিষ্কার করায় বোঝা যাচ্ছে, দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি আরও তীব্র হচ্ছে।