রয়টার্স , এএফপি: মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গাজা পরিকল্পনাকে অনুমোদন দিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে। কিন্তু এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে ফিলিস্তিনের গোষ্ঠী হামাস। গাজায় একটি আন্তর্জাতিক বাহিনী মোতায়েনের আহŸান জানানো হয়েছে ওই প্রস্তাবে। হামাস এক বিবৃতিতে বলেছে, এই প্রস্তাবে ফিলিস্তিনিদের অধিকার এবং দাবি পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। গাজা উপত্যকার অভ্যন্তরে আন্তর্জাতিক বাহিনীকে বিভিন্ন দায়িত্ব ও ভূমিকা দিয়ে, যার মধ্যে হামাসকে নিরস্ত্র করাও অন্তর্ভুক্ত, তাদের নিরপেক্ষতা কেড়ে নেয়া এবং দখলদারিত্বের পক্ষে সংঘাতের একটি পক্ষ হিসেবে পরিণত করার চেষ্টা চলছে। গত সোমবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গাজা শান্তি পরিকল্পনাকে শক্তিশালী করার জন্য মার্কিন-খসড়া প্রস্তাবের পক্ষে ভোট হয়েছে। প্রস্তাবে ফিলিস্তিনি উপত্যকার জন্য একটি আন্তর্জাতিক স্থিতিশীল বাহিনী গঠনের অনুমোদন দেয়া হয় এবং ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য একটি সম্ভাব্য পথ তৈরির কথা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

এই প্রস্তাবের পক্ষে ১৩ ভোট পড়ে। ওয়াশিংটন ভোটের পর একে ‘ঐতিহাসিক এবং গঠনমূলক’ বলে ঘোষণা করেছে। কোনও দেশ এর বিপক্ষে ভোট দেয়নি। রাশিয়া ও চীন ভোটদানে বিরত ছিল।

মার্কিন প্রস্তাবের অনুমোদনকে ‘ঐতিহাসিকমুহূর্ত’ বললেন ট্রাম্প : ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় যুদ্ধ শেষ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত পরিকল্পনাকে সমর্থন জানিয়ে ওয়াশিংটনের খসড়া প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। এতে উচ্ছ¡সিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করে বিশ্ববাসীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে গতকাল সোমবার ভোটাভুটি হয়। এতে ট্রাম্প-সমর্থিত খসড়া প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। এ প্রস্তাবে গাজা উপত্যকার জন্য একটি আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনী (ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যাবিলাইজেশন ফোর্স বা আইএসএফ) গঠনের অনুমোদনও দেওয়া হয়েছে।

এরপরই নিজের ট্রæথ সোশ্যালে পোস্ট করে ট্রাম্প একে ‘অভাবনীয় ভোট’ বলে মন্তব্য করেন। পোস্টে ট্রাম্প লেখেন, ‘কিছুক্ষণ আগে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে অভাবনীয় একটি ভোট হওয়ায় বিশ্ববাসীকে অভিনন্দন। এই ভোটের মাধ্যমে “বোর্ড অব পিস”কে স্বীকৃতি ও সমর্থন জানানো হয়েছে। এর (বোর্ড অব পিস) চেয়ারম্যান হব আমি নিজেই। সঙ্গে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ও মর্যাদাবান নেতারাও যুক্ত হবেন।’ জাতিসংঘের ইতিহাসে এটি ‘সবচেয়ে বড় অনুমোদনের একটি’ হিসেবে বিবেচিত হবে বলে মন্তব্য করেন ট্রাম্প। তিনি লেখেন, ‘বিশ্বজুড়ে এটি শান্তি প্রতিষ্ঠায় নতুন পথ দেখাবেÍএটি এক সত্যিকারের ঐতিহাসিক মুহূর্ত।’

ট্রাম্প জাতিসংঘ ও নিরাপত্তা পরিষদকে ধন্যবাদ জানান। পোস্টে তিনি নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদেশ চীন, রাশিয়া, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, আলজেরিয়া, ডেনমার্ক, গ্রিস, গায়ানা, দক্ষিণ কোরিয়া, পাকিস্তান, পানামা, সিয়েরা লিয়ন, ¯েøাভেনিয়া ও সোমালিয়ার নাম উল্লেখ করে ধন্যবাদ জানান। নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য না হয়েও খসড়া প্রস্তাবটির পক্ষে জোরালো সমর্থন জানানোয় কাতার, মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক ও জর্ডানের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানান ট্রাম্প। তিনি লেখেন, ‘বোর্ড সদস্যদের নাম এবং আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা কয়েক সপ্তাহের মধ্যে জানানো হবে।’

গাজা নিয়ে ট্রাম্পের ২০ দফা পরিকল্পনার প্রথম ধাপ কার্যকর করতে গত মাসে সম্মত হয়েছে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। এ ধাপে দুই বছর ধরে চলা যুদ্ধ স্থায়ীভাবে অবসানের লক্ষ্যে একটি যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠা করা এবং ইসরায়েলি জিম্মি ও ফিলিস্তিনি বন্দিবিনিময়ের কথা রয়েছে। এখন গাজায় একটি অন্তর্র্বতী প্রশাসন গঠনকে বৈধতা দেওয়া এবং যেসব দেশ সেখানে সেনা পাঠানোর কথা ভাবছে, তাদের আশ্বস্ত করতে নিরাপত্তা পরিষদের এ প্রস্তাব গ্রহণকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

এছাড়া প্রস্তাব গ্রহণের পর টেলিগ্রামে দেওয়া বার্তায় হামাস বলেছে, পরিকল্পনাটি গাজা উপত্যকার ওপর আন্তর্জাতিক অভিভাবকত্ব চাপিয়ে দিচ্ছে, যা আমাদের জনগণ ও প্রতিরোধ আন্দোলন প্রত্যাখ্যান করে।

হামাস আরও বলেছে, আন্তর্জাতিক বাহিনীকে গাজায় দায়িত্ব দেওয়া বিশেষ করে প্রতিরোধ বাহিনীকে নিরস্ত্র করার মতো ভূমিকা তাদের নিরপেক্ষতা নষ্ট করে এবং দখলদারদের পক্ষ নেওয়ার মতো পক্ষপাতমূলক অবস্থানে দাঁড় করায়। প্রস্তাব অনুযায়ী, সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং হামাসসহ সব অ-রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীকে স্থায়ীভাবে নিরস্ত্র করার প্রক্রিয়ায় সহায়তা করার জন্য আইএসএফ ইসরায়েল, মিসর এবং নতুনভাবে প্রশিক্ষিত ও যাচাইকৃত ফিলিস্তিনি পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে কাজ করবে। এখন পর্যন্ত গাজায় পুলিশ বাহিনী হামাসের কর্তৃত্বের অধীনেই পরিচালিত হতো।

জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইক ওয়াল্টজ পরিষদকে বলেন, আইএসএফ-এর দায়িত্ব হবে এলাকা সুরক্ষিত করা, গাজাকে নিরস্ত্রীকরণে সহায়তা করা, সন্ত্রাসী অবকাঠামো গুঁড়িয়ে দেওয়া, অস্ত্র অপসারণ এবং ফিলিস্তিনি নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। নিরাপত্তা পরিষদ আরও একটি অন্তর্র্বতীকালীন শাসন কাঠামো গঠনের অনুমোদন দিয়েছে, যার নাম বোর্ড অফ পিস (বিওপি)। এই সংস্থা একটি প্রযুক্তিনির্ভর, অরাজনৈতিক ফিলিস্তিনি কমিটির তত্ত¡াবধান করবে এবং গাজার পুনর্গঠন ও মানবিক সহায়তার কার্যক্রম পরিচালনা করবে। গাজা পুনর্গঠনের অর্থায়ন বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় গঠিত একটি ট্রাস্ট ফান্ড থেকে আসবে বলে প্রস্তাবে উল্লেখ আছে।

প্রস্তাব অনুযায়ী, আইএসএফ ও বিওপি দুটিই ফিলিস্তিনি কমিটি এবং পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করবে। ট্রাম্প নিরাপত্তা পরিষদের ভোটকে ঐতিহাসিক বলে মন্তব্য করেছেন এবং বলেছেন এটি বিওপিকে স্বীকৃতি ও অনুমোদন দেওয়ার একটি পথ। বোর্ডের চূড়ান্ত সদস্যদের নাম শিগগিরই ঘোষণা করা হবে বলে তিনি জানান। তিনি নিজের ট্রæথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে লেখেন, “এটি জাতিসংঘের ইতিহাসে অন্যতম বড় অনুমোদন হিসেবে বিবেচিত হবে, সারা বিশ্বে আরও শান্তির পথ খুলে দেবে এবং সত্যিকার অর্থে একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত!” আগের খসড়া থেকে ভিন্নভাবে, এই প্রস্তাবে ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিশ্বাসযোগ্য পথের উল্লেখ রয়েছে যা পরিষদের কয়েক সদস্য জোর দিয়ে দাবি করেছিলেন। ইসরায়েল একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের কঠোর বিরোধী, যা ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে বড় বাধা। আরব দেশগুলোর চাপেই আত্মনিয়ন্ত্রণের বিষয়টি এনে প্রস্তাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র জোর দিয়ে বলেছেন, প্রস্তাবটি অবশ্যই স্থলে দ্রæত বাস্তবায়নে রূপ নিতে হবে এবং দুই-রাষ্ট্র সমাধানের লক্ষ্যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ) এবং মিসর, সৌদি আরব, তুরকি সহ কয়েকটি আরব ও মুসলিম-অধ্যুষিত দেশ দ্রæত প্রস্তাবটি গ্রহণের আহŸান জানিয়েছিল। পিএ এক বিবৃতিতে বলেছে, প্রস্তাবের শর্তগুলো তাৎক্ষণিকভাবে এবং জরুরি ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করতে হবে। রাশিয়া ও চীন ভেটো প্রয়োগ না করলেও তারা বিরত থেকে প্রস্তাবটি পাস হতে দিয়েছেÍমূলত পিএ এবং আরও আটটি আরব ও মুসলিম রাষ্ট্রের সমর্থনের কারণে। তবে মস্কো ও বেইজিং প্রস্তাবটির সমালোচনা করেছে। তাদের অভিযোগÍমূল কাঠামোগুলোর গঠন সম্পর্কে স্পষ্ট তথ্য নেই, জাতিসংঘের অংশগ্রহণ নিশ্চিত নয়, এবং দুই-রাষ্ট্র সমাধানের প্রতি দৃঢ় প্রতিশ্রæতিও স্পষ্টভাবে পুনর্ব্যক্ত করা হয়নি। পরিকল্পনার প্রাথমিক ধাপ ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মি ও আটক ব্যক্তিদের হস্তান্তর ১০ অক্টোবর কার্যকর হয়।