ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডে ইসরাইলী হামলায় আরও ১১২ ফিলিস্তিনী নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও শতাধিক মানুষ। এর ফলে অবরুদ্ধ এই উপত্যকাটিতে নিহতের মোট সংখ্যা ৫০ হাজার ৫০০ ছাড়িয়ে গেছে। গত ১৮ মার্চ থেকে গাজায় নতুন করে ইসরাইলী হামলা শুরু হওয়ার পর থেকে ১১৫০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনী নিহত হয়েছেন।
২৪ ঘণ্টায় গাজা উপত্যকায় ইসরাইলী হামলায় কমপক্ষে আরও ১১২ ফিলিস্তিনী নিহত হয়েছেন। যার ফলে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরাইলের গণহত্যামূলক আগ্রাসনে ভূখণ্ডটিতে মোট নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৫০ হাজার ৫২৩ জনে পৌঁছেছে বলে বৃহস্পতিবার গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরাইলী আক্রমণে আহত হওয়া আরও ১৩৮ জনকে গাজার বিভিন্ন হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। এর ফলে সংঘাতের শুরু থেকে আহতের সংখ্যা বেড়ে ১ লাখ ১৪ হাজার ৭৭৬ জনে পৌঁছেছে। অনেক মানুষ এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে এবং রাস্তায় পড়ে থাকলেও উদ্ধারকারীরা তাদের কাছে পৌঁছাতে পারেননি। আনাদুলো, আল-জাজিরা, দৈনিক হারেৎস।
দীর্ঘ ১৫ মাস সামরিক অভিযানের পর যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপে গত ১৯ জানুয়ারি গাজায় যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয় ইসরাইল। তারপর প্রায় দু’মাস গাজায় কম-বেশি শান্তি বজায় ছিল; কিন্তু গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহারের প্রশ্নে হামাসের মতানৈক্যকে কেন্দ্র করে মার্চ মাসের তৃতীয় গত সপ্তাহ থেকে ফের গাজায় বিমান হামলা শুরু করে ইসরাইল।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, গত ১৮ মার্চ থেকে গাজায় নতুন করে ইসরাইলী বিমান হামলায় ১ হাজার ১৬৩ ফিলিস্তিনী নিহত এবং আরও ২ হাজার ৭০০ জনেরও বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। ইসরাইলের বর্বর এই হামলা চলতি বছরের জানুয়ারিতে কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভেঙে দিয়েছে। জাতিসংঘের মতে, ইসরাইলের বর্বর আক্রমণের কারণে গাজার প্রায় ৮৫ শতাংশ ফিলিস্তিনী বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন। এছাড়া অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডের ৬০ শতাংশ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে। এর আগে গত বছরের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গাজায় যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং তার সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডে আগ্রাসনের জন্য আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যার মামলার মুখোমুখিও হয়েছে ইসরাইল।
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় দেড় বছর ধরে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে দখলদার ইসরাইল। এই সময়ে ৫০ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করেছে দখলদারদের সেনারা। এতে করে উপত্যকাটির হাজার হাজার শিশু বাবা-মা হারিয়ে এতিম হয়ে গেছে। ফিলিস্তিনের কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর বরাতে সংবাদমাধ্যম গত বৃহস্পতিবার জানিয়েছে, গাজায় ৩৯ হাজার ৩৮৪ শিশু এতিম হয়েছে। যারমধ্যে ১৭ হাজার শিশুর বাবা-মা উভয়কে হত্যা করেছে ইসরাইলী বাহিনী। ফিলিস্তিনী শিশু দিবসের প্রাক্কালে গাজার এমন ভয়াবহ তথ্য জানিয়েছে দেশটির পরিসংখ্যান ব্যুরো।
গত জানুয়ারিতে ইসরাইলের সঙ্গে সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের যুদ্ধবিরতি হয়। কিন্তু দখলদাররা চুক্তি লঙ্ঘন করে পবিত্র রমযান মাস শুরুর পর গাজায় ফের ব্যাপক হামলা চালানো শুরু করে। এমনকি মুসলিমদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতরেও হত্যাযজ্ঞ অব্যাহত রেখেছিল তারা। এছাড়া ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে আছেন আরও অনেকে। দখলদাররা ভারী সরঞ্জাম প্রবেশ করতে না দেওয়ায় ধ্বংসস্তূপের নিচে থাকা এসব মানুষকে উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না। শুধুমাত্র আজই ৬২ জনকে হত্যা করেছে ইসরাইল। মাজেদ ওবায়েদ নামে গাজা সিটির এক বাসিন্দা সংবাদমাধ্যমটিকে বলেছেন, সকালে ইসরাইলী হামলায় চারতলা একটি ভবন ধসে পড়ে। সেটির নিচে অনেকে চাপা পড়ে আছে। তিনি জানান, এ হামলায় যারা নিহত হয়েছেন তাদে ৯০ শতাংশই নিরীহ নারী ও শিশু।
গাজায় যুদ্ধাপরাধ নিয়ে তদন্ত চান ১৩ ইসরাইলী আইনজীবী
গাজা উপত্যকায় চলমান ২য় দফা সামরিক অভিযানে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) দ্বারা সংগঠিত যুদ্ধাপরাধের যথাযথ তদন্ত চেয়েছেন দেশটির ১৩ জন আইনজীবী। শিগগিরই এ ইস্যুতে পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে ইসরাইরের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা (অ্যাটর্নি জেনারেল) গ্যালি বাহারাভ-মিয়ারা এবং ইসরাইলের সামরিক বাহিনীর আইনজীবী ইফাত তোমের-ইয়ারুশালমি বরাবর চিঠিও দিয়েছেন তারা।
গত বৃহস্পতিবার এক প্রতিবেদেনে এ তথ্য জানিয়েছে ইসরাইলী দৈনিক হারেৎস। এ ব্যাপারে আরও বিস্তারিত জানতে গ্যালি বাহারাভ-মিয়ারা এবং ইফাত তোমের ইয়ারুশালমির দপ্তরেও যোগাযোগ করেছিল হারেৎজ। কিন্তু দুই দপ্তরের কোনো কর্মকর্তা মন্তব্য করতে রাজি হননি। ২০২৩ সালের ৭ অক্টেবর ইসরাইলের ভূখণ্ডে অতর্কিত হামলা চালিয়ে ১ হাজার ২০০ জনকে হত্যা করে গাজা উপত্যকা নিয়ন্ত্রণকারী গোষ্ঠী হামাসের যোদ্ধারা। পাশাপাশি ২৫০ জনকে জিম্মি হিসেবে গাজায় নিয়ে আসে তারা। আকস্মিক এ হামলার জবাব দিতে এবং জিম্মিদের উদ্ধারে সেদিন থেকেই গাজায় অভিযান শুরু করে ইসরাইলী বাহিনী। তারপর প্রায় ১৫ মাস অভিযান পরিচালনার পর ২০২৫ সালের ১৯ জানুয়ারি গাজায় যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয় ইসরাইল। এই ১৫ মাসে গাজায় নিহত হয়েছেন ৪৯ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনী। তবে গাজা উপত্যকা থেকে সেনা প্রত্যাহার নিয়ে হামাসের সঙ্গে মতানৈক্য হওয়ায় গত ১৮ মার্চ থেকে ফের গাজায় সামরিক অভিযান শুরু করে আইডিএফ।