গার্ডিয়ান, বিবিসি এক্স , এএফপি: যেমনটা উড়ালসড়ক পেরিয়ে রাস্তা। তার ওপর দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি গাড়ি। রাস্তাজুড়ে যানজট। তেহরানের সড়কের এই দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। দাবি করা হচ্ছে, ইসরায়েলইরান সংঘাতের কারণে আতঙ্কে ইরানের রাজধানী ছেড়ে চলে যাচ্ছে মানুষ। অধিকাংশই গাড়িতে কেউ মোটরসাইকেল আর কেউবা হেঁটেই নিরুদ্দেশের দিকে যাত্রা করেছেন। পেট্রলপাম্পগুলোয়ও থিকথিকে ভিড়। কোথাও তিলধারণের জায়গা নেই। কোথায় যাচ্ছে তেহরানের মানুষ? জানা নেই। গত শুক্রবার ঘুমভাঙা ভোরে মানুষ জানতে পারে ইরানে আগ্রাসন চালিয়েছে ইসরায়েল। তেহরানের রাস্তা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। এরপর হামলা–পাল্টা হামলা চলছে। গত মঙ্গলবার তেহরান খালি করার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এতে অনেকেই ধারণা করছেন, ইরানে আরও বড় হামলা হতে পারে। এই আতঙ্কে তেহরান ছাড়ছেন অনেকে।
দ্য লাস্ট ফটো অব দ্য হোম: গত মঙ্গলবারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেসব মানুষ তেহরানে নিজেদের বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, তাঁরা ঘরে তালা লাগানোর আগে ঘরের ভেতরের ছবি শেয়ার করছেন। সংঘাত থামার পর ঘরে ফিরে এসে নিজেদের বাড়িঘর আর অক্ষত পাবেন কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত নন তাঁরা। তাই পরে যেন প্রিয় ঘরের ছবি দেখে স্মৃতি রোমন্থন করতে পারেন, এ কারণেই এই ছবি শেয়ার করছেন তাঁরা। একটি ছবিতে দেখা গেছে, খালি পড়ে থাকা একটি সোফা, তার সামনে স্যুটকেসে জিনিসপত্র ভরে রাখা। জানালার পর্দা নামানো। টেবিলে সুন্দর করে রাখা গাছের টব, সোফার কুশনগুলোও যত্ন করে সাজিয়ে রাখা।
বিদায় প্রিয়: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তেহরানের এক বাসিন্দা লিখেছেন, ‘প্রিয়জনদের কাছ থেকে পাওয়া উপহার আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়েছি। গাছগুলোকে একটু করে পানি দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়াটা অসহনীয় কষ্টের। কারণ, আর কখনো ফেরা হবে কি না, সেটা নিশ্চিত নই।’ আরেকজন তাঁর কাজের জায়গা, কম্পিউটার ও হেডফোনের ছবি দিয়ে লিখেছেন, ‘যেসব জিনিস পেতে কঠোর পরিশ্রম করেছি, সেগুলোকে বিদায় জানালাম...আশা করি, যখন আমি ফিরে আসব, এগুলো এখানেই থাকবে।’ আরেকজন লিখেছেন, ‘একদিন আমার এই সুন্দর নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে আসব, এই আশা নিয়েই নীরবে বিদায় জানালাম।’
সবাই কি আর ছাড়তে পারে ঘর: ফরহাদ নামের এক তরুণ তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে যুদ্ধ আতঙ্কে তেহরান ছেড়েছেন। ২২ বছর বয়সী ফরহাদ তেহরানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। দ্য গার্ডিয়ানের মঙ্গলবারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তেহরান ছাড়ার সময় ধ্বংসযজ্ঞের স্পষ্ট চিত্র দেখেছেন ফরহাদ। তাঁদের পেছনে একটি ভবনের ছাদ থেকে ধোঁয়া উড়ছিল, আগুন জ্বলছিলÍআর তাঁরা ধীরে ধীরে মাইলের পর মাইল দীর্ঘ যানজটে এগিয়ে যাচ্ছিলেন ইসরায়েলি বোমাবর্ষণ থেকে বাঁচার জন্য।
তেহরানের আরেক বাসিন্দা মিনা ১০ ঘণ্টা যাত্রা করে গন্তব্যে পৌঁছেছেন। ২৪ বছর বয়সী চাকরিজীবী মিনা বলেন, ‘যানজটে আটকে থাকার সময় সারাক্ষণ ভেবেছি, যদি রাস্তায় হামলা হয়! আমাদের চারপাশে যদি কোনো গোপন অস্ত্রাগার থাকে? এই অনিশ্চয়তার ভয় আমাদের মধ্যে প্রবল উৎকণ্ঠা তৈরি করেছিল।’ ফরহাদ ও মিনা সেই তেহরানবাসীর মধ্যে, যাঁরা ইসরায়েল শুক্রবার ভোরে ইরানে শত শত বিমান হামলা চালানোর পর থেকে শহর ছেড়ে চলে গেছেন। তেহরানে বোমা থেকে বাঁচার জন্য নির্ধারিত কোনো আশ্রয়কেন্দ্র নেই। শহর কর্তৃপক্ষ মেট্রোরেল স্টেশনগুলোকে জরুরি আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে খুলে দিয়েছে এবং মানুষকে মসজিদে যেতে বলেছে। যদিও এসব ভূমি–উপরস্থ আশ্রয়কেন্দ্র কতটা সুরক্ষা দিতে পারে, তা অনিশ্চিত। এই অনিশ্চয়তা থেকেই শহর ছাড়ছেন অনেক তেহরানবাসী।
ছাড়তে চেয়েও তেহরান ছাড়তে না পারা আকরাম নামের একজন বলেন, ‘শহরের অর্ধেকের বেশি মানুষ চলে গেছে’। তেহরান এখন আধা লকডাউনের অবস্থায়। বলতে পারেন, শুধু ব্যাংক আর সিটি করপোরেশন চলছে। খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে, বাজার প্রায় বন্ধ, তেহরান কার্যত খালি হয়ে গেছে। পেট্রলপাম্পগুলো প্রতিদিন একজনকে ১০ লিটারের বেশি তেল দিচ্ছে না, এ কারণে স্টেশনের সামনে দীর্ঘ লাইনের সৃষ্টি হচ্ছে।
তেহরানের অনেক বাসিন্দা এখনো শহর ছেড়ে যেতে পারেননি। এমনই একজন ৪০ বছর বয়সী সাদিয়া। তিনি বলেন, ‘ তেহরানে এখন তিন ধরনের মানুষ আছেনÍযাঁদের যাওয়ার জায়গা নেই, যাঁদের যাওয়ার টাকাপয়সা নেই এবং যেসব মধ্যম পর্যায়ের সরকারি কর্মীর ছুটি বাতিল করা হয়েছে, তাঁরা।
তেহরান ছেড়ে অনেকেই চলে গেলেও কোথাও যেতে পারছেন না কারাগারের বন্দীরা। মেহরাভেহ খানদান নামের এক ব্যক্তির বাবা মানবাধিকারকর্মী রেজা খানদান বর্তমানে এভিন কারাগারে বন্দী। মেহরাভেহ বলেন, ‘আমার বাবা কারাগারে! আপনি বলুন, উনি কীভাবে তেহরান ছাড়বেন? কীভাবে?! তাঁকে বলছেন শহর ছাড়তে, মানে কী?’
কোথায় যাব আমি?: সবার তো আর নিরাপদে যাওয়ার জায়গা থাকে না। তারপরও বাধ্য হয়ে মানুষকে পথে নামতে হয়। কোথায় যাবেন, এর উত্তর না জেনেই হাঁটতে হয় বিপৎসংকুল পথ। আবার কেউ কেউ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আঁকড়ে থাকছেন নিজের ঘর।
তেমনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক নারী বিবিসি পার্সিয়ানকে বলেন, ‘আমি অন্তঃসত্ত্বা। আমার একটি ছোট মেয়েও আছে। আমার সবকিছু এই শহরেই... কোথায় যাব আমি?’ ৪০ বছর বয়সী আরেক নারী বলেছেন, তাঁর ছোট দুই সন্তান আছে। তিনি বলেন, ‘সবকিছু যদি ধ্বংস হয়, তাহলেও আমি চাই, আমার সন্তান ও আমি আমাদের ঘরেই থাকব। কারণ, আবার শুরু করার শক্তি আমার নেই।’
তেহরান ছেড়ে যাওয়া বাসিন্দারা অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। নিজেরা এই মুহূর্তে নিরাপদে থাকলেও শহরে রেখে আসা আপনজনদের নিয়ে দুশ্চিন্তা ও নিজেদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় মুষড়ে পড়ছেন তাঁরা। শহর বা দেশ ছেড়ে গেলেই কি মানুষ সেসব ছাড়তে পারেন! পারেন না। যেমন পারেননি তেহরান ছেড়ে আসা মিনা। তিনি বলেছেন, ‘এখান থেকে আমি আমার প্রিয় শহরকে ধ্বংস হতে দেখছি। বেশি কিছু আনিনি, শুধু বাঁচার মতো কিছু জিনিস এনেছি। আমার মন পড়ে আছে তেহরানেই। আমি শুধু আশা নিয়ে এসেছি।’ প্রিয় শহর ও ঘর কেউ ছেড়ে আসা মানে প্রিয়বালার মতো খানিকটা নাম পড়ে থাকল পাঠশালায়, খানিকটা নাম ভেসে গেছে কান্নায়, খানিকটা সীমান্তের পথে, খানিকটা নাম জুড়ে আছে টবে সাজানো গাছের পাতায়, আর দেশছাড়া মানুষের খানিকটা নাম লিখে দিতে হবে ইমিগ্রেশন খাতায়।