ওয়াক্ফ আইন ঘিরে অতি সম্প্রতি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে যে সহিংসতা ঘটল, তা নিয়ে বাংলাদেশের মন্তব্যকে ‘অযৌক্তিক’ বলে মনে করে ভারত। ভারতে সংখ্যালঘু মুসলিমদের ‘পূর্ণ নিরাপত্তা’ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকারের আহ্বানে ‘বেজার’ হয়েছে দেশটির সরকার। এ বিষয়ে বিবৃতি দিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল। গতকাল শুক্রবার দেয়া বিবৃতিতে জয়সওয়াল অন্তর্বর্তী সরকারের ওই আহ্বানকে ‘অসৎ প্রয়াস’ বলে মন্তব্য করেছেন। এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে সহিংসতা নিয়ে মন্তব্য করার জন্য বাংলাদেশের কড়া সমালোচনা করেছে ভারত। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের বক্তব্যকে ‘অযৌক্তিক মন্তব্য’ এবং ‘ভন্ডামিপূর্ণ আচরণ’ বলে অভিহিত করেছে। সেইসঙ্গে ভারত বাংলাদেশকে সেখানকার সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় মনোনিবেশ করার আহ্বান জানিয়েছে। মুর্শিদাবাদে সংঘটিত সহিংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বাংলাদেশের প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছিলেন, আমরা ভারত এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীর সম্পূর্ণ সুরক্ষার জন্য সকল পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। এদিকে গত ২ এপ্রিল গভীর রাতে ভারতের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভা এবং পরের দিন উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় পাস হয় ‘সংশোধিত ওয়াক্ফ বিল, ২০২৫’। তারপর ৫ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর স্বাক্ষরের মধ্যে দিয়ে আইনে পরিণত হয় সেই বিল এবং ৮ এপ্রিল তা কার্যকর হয়।

এর আগে গত বৃহস্পতিবার সরকার পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় বাংলাদেশকে জড়ানোর ভারতের চেষ্টার তীব্র প্রতিবাদ জানায়। প্রতিবেশী দেশটিকে সেখানকার সংখ্যালঘু মুসলিমদের ‘পূর্ণ নিরাপত্তা’ নিশ্চিত করার আহ্বানও জানায় ঢাকা। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম অন্তর্বর্তী সরকারের এই অবস্থান তুলে ধরে বলেন, মুর্শিদাবাদের সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় বাংলাদেশকে জড়ানোর যেকোনো চেষ্টাকে আমরা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করি। বাংলাদেশ সরকার মুসলিমদের ওপর হামলা এবং তাদের জানমালের নিরাপত্তাহানির ঘটনার নিন্দা জানায়।

এরই প্রতিক্রিয়ায় পররাষ্ট্র মন্ত্রকের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেছেন, বাংলাদেশের মন্তব্য সেখানে সংখ্যালঘুদের ওপর চলমান নির্যাতনের বিষয়ে ভারতের উদ্বেগের সঙ্গে সমান্তরাল করে দেখানোর একটি ছদ্মবেশী ও ছলনাপূর্ণ প্রয়াস, যেখানে এই ধরনের অপরাধীরা অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। গতকাল শুক্রবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এদিকে, মুর্শিদাবাদে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে দাবি করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যপালকে তার উপদ্রুত এলাকা সফর স্থগিত করার জন্য অনুরোধ করেছেন। রাজ্য সরকারের রিপোর্ট অনুযায়ী, ৪ এপ্রিল জঙ্গিপুরের থানা এলাকা জুড়ে শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল কিন্তু ৮ এপ্রিল উমরপুরে ৫,০০০ জনতা জাতীয় সড়ক ১২ অবরোধ করলে তা সহিংস হয়ে ওঠে। পুলিশের উপর ইট, লোহার রড, ধারালো অস্ত্র এবং আগুন বোমা দিয়ে হামলা চালানো হয় বলে অভিযোগ। সরকারি যানবাহনকেও লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত সপ্তাহে মুসলিম-অধ্যুষিত মুর্শিদাবাদ জেলায় নতুন ওয়াকফ আইন নিয়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভ চলাকালে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। মালদা, মুর্শিদাবাদ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং হুগলি জেলায় এই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে আগুন লাগানো, ইটপাটকেল নিক্ষেপ এবং রাস্তা অবরোধের ঘটনা ঘটে।

এনডিটিভি অনলাইন প্রতিবেদন অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই সহিংসতার জন্য বাংলাদেশকে দোষারোপ করেন। তার দাবি, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বৈঠক করে চক্রান্ত করে সেখানে অশান্তি লাগিয়েছেন। শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, সংশোধিত ওয়াকফ আইন ঘিরে উত্তর প্রদেশসহ দেশটির আরও কিছু অঞ্চলে সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর নির্যাতনের নানা তথ্য গণমাধ্যমের খবরে উঠে আসছে।

এদিকে আইন কার্যকর হওয়ার পরপরই ভারতের রাজধানী দিল্লি, পশ্চিমবঙ্গ, মণিপুরসহ বিভিন্ন রাজ্যে বিক্ষোভ শুরু করেন মুসলিমরা ও বিজেপিবিরোধী বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দ। সবচেয়ে বেশি বিক্ষোভ হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। এই বিক্ষোভকে ঘিরে আক্ষরিক অর্থেই রণক্ষেত্রে রূপ নিয়েছিল রাজ্যের মুর্শিদাবাদ, মালদহ, নদীয়াসহ বিভিন্ন জেলা। পুলিশ-বিক্ষোভকারী সংঘাতে মুর্শিদাবাদে ৩ জন সংবাদও পাওয়া গেছে এবং গ্রেফতার হয়েছেন ২ শতাধিক বিক্ষোভকারী। তবে বর্তমানে মুর্শিদাবাদ ও অন্যান্য জেলার অবস্থা শান্ত। আইন স্থগিতের দাবিতে ইতমধ্যে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে মামলা হয়েছে এবং দেশটির প্রধান বিচারপতি সঞ্জিব খান্নার বেঞ্চে বুধবার মামলার ওপর শুনানিও শুরু হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টে মামলার শুনানি শুরু হওয়ার দিনই আইনটির কার্যকর হওয়ার সময় পিছিয়ে দিয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার।