এএফপি, বিবিসি, রয়টার্স: সিরিয়ায় আবারও প্রাণঘাতী গোষ্ঠীগত সহিংসতার ঢেউ শুরু হয়েছে, যা দেশটির ভঙ্গুর নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরও তীব্র করে তুলেছে। এমন একসময়ে এসব সংঘাত ঘটছে, যখন নতুন সরকার বিভক্ত দেশটির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। দ্রুজ সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর এক ব্যবসায়ীকে অপহরণের খবর ছড়িয়ে পড়ে। এরপর দক্ষিণ সিরিয়ায় দ্রুজ মিলিশিয়া ও সুন্নি বেদুইন যোদ্ধাদের মধ্যে সংঘাত শুরু হয়। এরই মধ্যে গত মঙ্গলবার ইসরায়েল সিরিয়ায় হামলা চালায়। যদিও আগে থেকেই তারা দেশটিতে মাঝেমধ্যে হামলা চালিয়ে আসছিল। ইসরায়েল দাবি করেছে, তারা দ্রুজ সম্প্রদায়কে রক্ষা করতে ও সিরিয়ার সরকারপন্থী বাহিনীকে দমন করতে এ হামলা চালিয়েছে।
গত মার্চে সিরিয়ার উপকূলীয় প্রদেশগুলোতেও ভয়াবহ সংঘাত হয়। সেই সংঘাতে শত শত আলাউতি সম্প্রদায়ের মানুষ নিহত হন। ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ এ সম্প্রদায়ের একজন সদস্য। অভিযোগ উঠেছে, সিরিয়ার সরকারপন্থী বাহিনীগুলো দক্ষিণাঞ্চলের সুয়েইদা প্রদেশে দ্রুজদের ওপর হামলা চালিয়েছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস (এসওএইচআর) বলেছে, গত রোববার থেকে শুরু হওয়া সংঘর্ষে শুধু সুয়েইদাতেই গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত অন্তত ৩৫০ জন নিহত হয়েছেন। সুয়েইদা প্রদেশে গত এপ্রিল ও মে মাসে প্রথমবারের মতো রক্তক্ষয়ী সংঘাত হয়। তখন দ্রুজ যোদ্ধাদের সঙ্গে সিরিয়ার নতুন নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘাতে ৩০ থেকে ৫০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এরপর দ্রুজ সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশটিতে এটাই দ্বিতীয় বড় সংঘাত।
গত মার্চে সিরিয়ার উপকূলীয় প্রদেশগুলোতেও ভয়াবহ সংঘাত হয়। সেই সংঘাতে শত শত আলাউতি সম্প্রদায়ের মানুষ নিহত হন। দেশটির ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ এ সম্প্রদায়ের একজন সদস্য। ভয়াবহ সহিংসতা ও ইসরায়েলের তীব্র হামলার কারণে সিরিয়ায় নতুন সরকারের নিরাপত্তাব্যবস্থা ভেঙে পড়ার নতুন আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এক দশকের বেশি সময়ের গৃহযুদ্ধের রেশ কাটতে না কাটতে ও ইসলামপন্থী বিদ্রোহীদের ক্ষমতা দখলের মধ্যেই এ আশঙ্কা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। দেশটির অন্তর্র্বতী সরকারের প্রেসিডেন্ট ও সংগঠন হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) নেতা আহমেদ আল-শারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
দ্রুজ কারা : দ্রুজরা আরবিভাষী একটি ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। সিরিয়া, লেবানন, ইসরায়েল ও অধিকৃত গোলান মালভূমিতে এ সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করেন। দ্রুজরা শিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের একটি শাখা। তবে তাদের পরিচয় ও ধর্মবিশ্বাসে ভিন্নতা রয়েছে। দ্রুজ জনগোষ্ঠীর সদস্যসংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। তাদের প্রায় অর্ধেকই বসবাস করে সিরিয়ায়। সেই হিসেবে দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩ শতাংশ দ্রুজ।
ইসরায়েলে দ্রুজদের রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত হিসেবে ধরা হয়। ফলে তারা দেশটির সেনাবাহিনীতেও যোগ দিতে পারে। ইসরায়েলের কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েল ও অধিকৃত গোলান মালভূমিতে প্রায় ১ লাখ ৫২ হাজার দ্রুজ বাস করে। ঐতিহাসিকভাবে সিরিয়ার রাজনৈতিক ব্যবস্থায় দ্রুজদের সব সময় একটি অনিশ্চিত অবস্থানে থাকতে হয়েছে। প্রায় ১৪ বছরব্যাপী চলা সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে দক্ষিণ সিরিয়ায় দ্রুজরা নিজেদের মিলিশিয়া বাহিনী পরিচালনা করেছে।
গত ডিসেম্বরে বাশারের ক্ষমতাচ্যুতির পর থেকে নতুন সরকার দক্ষিণ সিরিয়ায় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। কিন্তু দ্রুজরা সেটার বিরোধিতা করছেন। এ সরকারের প্রতি দ্রুজ নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গি বিভক্ত। নেতাদের একটি অংশ সরকারের বিষয়ে সতর্ক। অন্যরা শারা সরকারের কর্তৃত্বের সরাসরি বিরোধী। গত বছরের ডিসেম্বরে বাশারের ক্ষমতাচ্যুতির পর থেকে দেশটির নতুন সরকার দক্ষিণ সিরিয়ায় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। কিন্তু দ্রুজরা সেটার বিরোধিতা করছে। নতুন সরকারের প্রতি দ্রুজ নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গি বিভক্ত। নেতাদের একটি অংশ নতুন সরকারের বিষয়ে সতর্ক। অন্যরা নতুন সরকারের কর্তৃত্বের সরাসরি বিরোধী। তবে উভয় পক্ষের একটি বড় অংশই সুয়েইদা প্রদেশে সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে এবং সিরিয়ার সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পরিবর্তে স্থানীয় মিলিশিয়ার ওপর নির্ভর করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা জানিয়েছে।
আল-শারার নেতৃত্বাধীন সরকার দ্রুজ সম্প্রদায়ের ওপর সাম্প্রতিক হামলার নিন্দা জানিয়েছে। পাশাপাশি দক্ষিণ সিরিয়ায় আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু সরকারি বাহিনীও জনগোষ্ঠীটির ওপর হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এসওএইচআরের প্রতিবেদনে সরকারি বাহিনী দ্রুজদের ‘নির্বিচারে হত্যা’ করেছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এ ধরনের প্রতিবেদনের কারণে দ্রুজদের অনেকের মধ্যে দামেস্কের কর্তৃপক্ষের প্রতি অবিশ্বাস বেড়েছে।
এদিকে বাশারের পতনের পর থেকে ইসরায়েল নিজেদের উত্তর সীমান্তের কাছে বসবাসকারী দ্রুজ সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। এটি সিরিয়ার সংখ্যালঘুদের সঙ্গে দেশটির মিত্রতা গড়ার দীর্ঘদিনের চেষ্টারই অংশ। ইসরায়েল নিজেকে সিরিয়ার কুর্দি, দ্রুজ ও আলাউতি সংখ্যালঘুদের ত্রাণকর্তা হিসেবে উপস্থাপন করে থাকে। তাদের সহায়তার অজুহাতে দেশটির সামরিক ঘাঁটিসহ সরকারি বাহিনীর ওপর হামলা চালাচ্ছে তেল আবিব।
মে মাসের গোষ্ঠীগত সংঘর্ষের সময় ইসরায়েল দামেস্কের প্রেসিডেন্টের প্রাসাদের কাছাকাছি বিমান হামলা চালিয়েছিল। তখন বলেছিল, এটি দ্রুজদের ওপর হামলার বিরুদ্ধে একটি সতর্কবার্তা। কিন্তু সিরিয়া ও লেবাননের কিছু দ্রুজ নেতা ইসরায়েলের এ হামলার বিরোধিতা করেন। তাঁদের অভিযোগ, এ অঞ্চলে নিজের সম্প্রসারণবাদী আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্যই গোষ্ঠীগত বিভাজন বাড়ানোর চেষ্টা করছে ইসরায়েল।
ইসরায়েল কেন হামলা চালাচ্ছে : মূলত একটি সতর্কবার্তা ও প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ হিসেবে সিরিয়ায় সাম্প্রতিক বিমান হামলাগুলো চালিয়েছে ইসরায়েলÍএমনটাই বলছে তেল আবিব। উদ্দেশ্য, সিরিয়ার সেনাবাহিনী যাতে দক্ষিণাঞ্চলে মোতায়েন করা না হয়। এ এলাকায় ইসরায়েল একটি বেসামরিক অঞ্চল গড়ে তুলতে চায়।
ইসরায়েলের উদ্বেগ, সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে দেশটির বর্তমান সরকারের অনুগত যোদ্ধারা অবস্থান নিতে পারেন। এখান থেকে ইসরায়েল অধিকৃত গোলান মালভূমির দূরত্ব বেশি দূরে নয়। তাই নিজেদের উত্তর সীমান্তের এ অঞ্চলে শারা সরকারের অনুগত যোদ্ধাদের উপস্থিতি নিয়েই তাদের যত মাথাব্যথা। ইসরায়েলের গত ১৫ জুলাইয়ের বিমান হামলা সুয়েইদা প্রদেশে সিরিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী ও সামরিক যানবাহনে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু ১৬ জুলাই হামলার পরিসর বাড়ানো হয়। এদিন রাজধানী দামেস্কে সিরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, সেনা সদর দপ্তর ও প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের আশপাশে হামলা চালায় ইসরায়েল। সিরিয়া ও দেশটির কিছু মিত্রদেশ এসব হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে।
১৬ জুলাইয়ের হামলাগুলো ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের পর থেকে দেশটিতে চালানো হামলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল। গত ডিসেম্বরে বাশার উচ্ছেদ হওয়ার পর থেকে দেশটির বিভিন্ন স্থানে ছয় শতাধিক হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। ইতিমধ্যে গোলান মালভূমির জাতিসংঘ-নিয়ন্ত্রিত একটি বাফার জোনে (নিরপেক্ষ অঞ্চল) সেনা পাঠায় সিরিয়া। ১৬ জুলাই দামেস্কে বিমান হামলা শুরুর পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ লেখেন, ‘দামেস্কের প্রতি সতর্কবার্তা শেষ হয়েছে। এখন যন্ত্রণাদায়ক আঘাত শুরু হবে।’ সিরিয়ার সামরিক সদর দপ্তরে হামলার দৃশ্য সরাসরি সম্প্রচার করেছে দেশটির শীর্ষস্থানীয় একটি টেলিভিশন চ্যানেল। চ্যানেলটির স্টুডিও ওই ভবনের ঠিক উল্টো দিকে অবস্থিত। সম্প্রচারের দেখা যায়, হামলার কারণে উপস্থাপক স্টুডিও ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন।
১৬ জুলাই হামলার পর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এই সহিংসতা নিয়ে ‘অত্যন্ত উদ্বিগ্ন’। ওই দিনই তিনি ঘোষণা করেন, ‘আমরা এমন কিছু নির্দিষ্ট পদক্ষেপের বিষয়ে সম্মত হয়েছি, যা আজ রাতেই এ ভয়াবহ ও দুঃখজনক পরিস্থিতির অবসান ঘটাবে।’ লেবানন, ইরাক, কাতার, জর্ডান, মিসর, কুয়েতসহ একাধিক আরব রাষ্ট্র ১৬ জুলাই সিরিয়ার সরকারি ও নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর ইসরায়েলের হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ হামলাকে ‘ইসরায়েলের সুস্পষ্ট আগ্রাসন’ উল্লেখ করে নিন্দা জানিয়েছে। ইরানও এ হামলার নিন্দা জানিয়ে মন্তব্য করেছে।
বাশারের পতনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা তুরস্কও ইসরায়েলের হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, ১৪ বছরের গৃহযুদ্ধের পর সিরিয়ার পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা ইসরায়েল নস্যাৎ করতে চাইছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, সিরিয়ার জনগণের শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস ও আন্তর্জাতিক সমাজে একীভূত হওয়ার ঐতিহাসিক সুযোগ তৈরি হয়েছে। সব পক্ষের উচিত সিরিয়ার সরকারের শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে সহায়তা করা। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও সুয়েইদা ও দামেস্কে ইসরায়েলের উসকানিমূলক হামলার নিন্দা জানিয়েছেন।
সামনে কী অপেক্ষা করছে : সিরিয়ার চলমান গোষ্ঠীগত সহিংসতা দেশটির গৃহযুদ্ধ-পরবর্তী নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক অবস্থার নাজুক পরিস্থিতির স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়। সাম্প্রতিক এসব সংঘাতের কারণে দেশটিতে আবার গোষ্ঠীগত সহিংসতা ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। অন্তর্র্বতী প্রেসিডেন্ট শারা পুরো সিরিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন। তাঁর সরকারে ইসলামের বিভিন্ন আইনকানুন বিষয়ে কঠোর মনোভাবসম্পন্ন ব্যক্তিদের আধিপত্য রয়েছে। তাই প্রশ্ন হলো, এ সরকার কি প্রায় ১৪ বছরের গৃহযুদ্ধে গভীরভাবে বিভক্ত দেশটির গোষ্ঠীগত বিভক্তি মেটাতে পারবে? কারণ, গোষ্ঠীগত সংঘাতের পাশাপাশি ইসরায়েলের উপর্যুপরি হামলা শারার রাষ্ট্র পুনর্গঠন ও যুদ্ধ-পরবর্তী সম্প্রীতি স্থাপনের প্রয়াসকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করছে। ইসরায়েল আপাতত দামেস্কের বর্তমান শাসক ও দক্ষিণ সিরিয়ায় তাঁর সহযোগী যোদ্ধাদের সম্ভাব্য নিরাপত্তা হুমকি হিসেবেই দেখবে বলে মনে হচ্ছে। তাই তারা দেশটির এমন গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে মৈত্রী সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করবে, যারা নতুন সরকার থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন বলে মনে করে।