ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় গণহত্যা চালানোর জন্য মানুষকে অনাহারে রাখাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে ইসরাইল। এমন মন্তব্যই করেছে যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। এছাড়া গাজায় শিশুদের জন্য পরিস্থিতি খুব ভয়াবহ বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল গত বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, গাজা উপত্যকায় ইসরাইল এখনও সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে ‘ক্ষুধা’কে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে, যা ফিলিস্তিনীদের ওপর চলমান গণহত্যার অংশ। আনাদুলো, ডয়চে ভেলে।

লন্ডনভিত্তিক এই সংগঠনটি বলেছে, গাজার পরিস্থিতি এখনো ভয়াবহ, বিশেষ করে শিশুদের জন্য। টানা বোমাবর্ষণ, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি, খাদ্য, পানি ও ওষুধের সংকটÑসব মিলিয়ে মানবিক বিপর্যয় চরমে। অ্যামনেস্টির সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাগনেস কালামার্ড বলেছেন, “ইসরাইল যে জীবনধারণের মৌলিক চাহিদাগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে ধ্বংস করছেÑতা আসলে শারীরিকভাবে ধ্বংস করে ফেলার এক কৌশল”। তার ভাষায়, এই অবস্থা গণহত্যার সংজ্ঞার মধ্যেই পড়ে। অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সহায়তা নিতে গিয়ে শত শত ফিলিস্তিনী নিহত বা আহত হয়েছেনÑকখনও ত্রাণ বিতরণ পয়েন্টে, কখনও সাহায্যের খোঁজে যাওয়ার পথেই। তাদের ভাষায়, “ইসরাইলের পরিচালিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) ত্রাণ ব্যবস্থা প্রকৃতপক্ষে একটা ফাঁদে পরিণত হয়েছে। ক্ষুধার্ত মানুষ সেই ফাঁদে পড়ে প্রাণ হারাচ্ছেন।”

প্রতিদিন শত শত সাহায্যবাহী ট্রাক গাজার বাইরে অপেক্ষা করলেও ইসরাইলের অনুমতি না মেলায় সেগুলো ঢুকতে পারছে না। এদিকে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধের পর এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৬৬ শিশু অপুষ্টিজনিত কারণে মারা গেছে বলে জানিয়েছে অ্যামনেস্টি। আরও বহু শিশু অসুখে ভুগে মারা গেছে, যেগুলো প্রতিরোধযোগ্য ছিল যদি সেখানে খাবার ও ওষুধ থাকত। উদাহরণ হিসেবে ৪ মাস বয়সী জিনান ইসকাফি নামে এক শিশুর মৃত্যুর তথ্য তুলে ধরা হয়। ছোট্ট এই শিশুটি দুধের অভাবে অত্যন্ত পানিশূন্যতা ও অপুষ্টিতে মারা যায়। গাজা শহর ও খান ইউনিসের হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিন যে শিশুরা স্বাস্থ্য পরীক্ষায় আসছে, তাদের প্রায় ১৫ শতাংশের মধ্যে গুরুতর বা মাঝারি অপুষ্টির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।

চিকিৎসকেরা বলছেন, “প্রাথমিক চিকিৎসার পরেও অনেক শিশু আবার অসুস্থ হয়ে ফিরছে, কারণ ক্যাম্পের পরিস্থিতি আরও খারাপ।” এছাড়া চিকিৎসকরাও বিপদে রয়েছেন। নিজেরাই বাস্তুহারা ও অপুষ্টিতে ভোগা অনেক চিকিৎসক তাদের অসহায়ত্বের কথা জানিয়েছেন। অ্যামনেস্টি বলেছে, “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় শুধু ইসরাইলের গণহত্যা থামাতেই ব্যর্থ নয়, বরং তারা এই ধ্বংসযজ্ঞ চলতে দিচ্ছে।” সংস্থাটি জোর দিয়ে বলেছে, ইসরাইলের জন্য সব ধরনের সামরিক সহায়তা বন্ধ করতে হবে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িতদের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নিষিদ্ধ করতে হবে এবং যেসব ইসরাইলি কর্মকর্তা অপরাধের সঙ্গে জড়িত, তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে।

গাজায় ত্রাণ নিতে গিয়ে নিহত শত শত মানুষ : এক সপ্তাহের সামান্য কয়েকদিন আগের ঘটনা। মাহমুদ কাসিম তার ছেলে কাদেরকে হারিয়েছেন। ১৯ বছর বয়সী কাদের মধ্য গাজায় মার্কিন সমর্থনে চলা গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে খাবার সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন। কাসিম বলেছেন, “ওইদিন রাত ১১টা নাগাদ আমি এবং ওর মা শেষবারের মতো ফোনে কাদেরের সঙ্গে কথা বলি। ও আমাদের জানায়, নেটজারিম ত্রাণকেন্দ্রে নিরাপদ জায়গায় আছে। আমি ওকে সাবধানে থাকতে বলি। ১টা নাগাদ আমি ওকে ফোন করি। কিন্তু ফোনে সাড়া পাইনি। দুইটা পর্যন্ত অপেক্ষা করি।” তারপর কাসিম মধ্য গাজায় যান। হাসপাতালগুলোতে খোঁজ নেন। শেষপর্যন্ত কাদেরের মরদেহ খুঁজে পান। দেখা যায়, অনেকগুলো বুলেটের আঘাতে তার মৃত্যু হয়েছে। কাসিম বলেছেন, “একজন ১৯ বছর বয়সী তো সবে তার জীবন শুরু করেছে। সে খাবারের বাক্স আনতে গিয়েছিল। আমি চাইনি। কিন্তু ছেলে মনে করলো, পরিবারকে সাহায্য করা উচিত। ওখানে অবর্ণনীয় অবস্থা। মানুষের জীবন চলে যাচ্ছে। না হামাস, না ইসরাইল, না আরব দেশগুলো, কেউ আমাদের জন্য ভাবে না।”

গাজায় খাবার পাওয়া সবচেয়ে বড় সমস্যা: গাজায় ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রগুলোতে প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছেন। বাস্তবতা হলো, গাজার ২৩ লাখ মানুষ পুরোপুরি ত্রাণের ওপর নির্ভরশীল। আর ত্রাণ আসে ইসরাইল হয়ে। গাজার প্রায় সকলেই ঘরছাড়া হয়েছিলেন। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের রিপোর্ট, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজার ৫৭ হাজার মানুষ মারা গেছেন। গত মে মাসের সমীক্ষা অনুসারে ৯৩ শতাংশ মানুষ খাদ্যসংকটে ভুগছেন। জাতিসংঘ ত্রাণ দেওয়া শুরু করেছে, আমেরিকা-ইসরাইলের সংস্থা জিএইচএফ তিনটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র খুলেছে। তা সত্ত্বেও গাজার মানুষ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম খাবার পাচ্ছেন। ক্রাণভর্তি ট্রাক সশস্ত্র গোষ্ঠী বা বেসামরিক মানুষ লুট করে নিচ্ছে, এমন ঘটনাও ঘটছে। এর মধ্যে ইসরাইলের সেনা উত্তর ও দক্ষিণ গাজায় বিমান হামলা চালাচ্ছে। তারা সেখান থেকে মানুষকে সরে যেতে বলেছে। আবু লিবদার বয়স ৪৪ বছর। পাঁচ সন্তানের বাবা। খান ইউনিস দিয়ে যখন একটা ত্রাণবোঝাই ট্রাক যাচ্ছিল, তিনি একটা ময়দার বস্তা নিতে পেরেছিলেন। তিনি ফোনে বলেছেন, “আমি জানি এটা ঝুঁকির কাজ। কিন্তু আমাদেরও তো কিছু খেতে হবে। হাজার হাজার মানুষ ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করছে। হঠাৎ শুনতে পেলাম দুটো গোলা ফাটার শব্দ। আমি দেখলাম অনেক মানুষ রাস্তায় পড়ে গেলেন। অনেকের দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। সৌভাগ্যবশত, আমার আঘাত লেগেছে হালকা।”

গত কয়েক সপ্তাহে কয়েকশ’ মানুষের মৃত্যু : গাজায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত কয়েক সপ্তাহে ইসরাইলের সেনার গুলি ও গোলার আঘাতে পাঁচশর বেশি মানুষ মারা গেছেন। তারা ত্রাণের অপেক্ষায় ছিলেন। হামাসকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন বলে ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ইসরাইলসহ বেশ কিছু দেশ। ইসরাইলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই দাবি অগ্রাহ্য করে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করে জানিয়েছে, “হামাস বেসামরিক মানুষের ওপর গুলী চালিয়েছে। গাজার মানুষের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট, হামাস ইসরাইলের সেনার ওপর মিথ্যা অভিযোগ করছে। তারা মৃতের সংখ্যা বাড়িয়ে বলছে, ভুয়া ভিডিও ছড়াচ্ছে।”

গত মঙ্গলবার অক্সফাম, সেভ দ্য চিল্ডরেনসহ ১৩০টি বড় সেবা প্রতিষ্ঠান ও এনজিও জিএইচএফকে বলেছে, তারা যেন ত্রাণশিবির বন্ধ করে দেয়। কারণ, ফাউন্ডেশনের ত্রাণশিবির সামরিক এলাকা বা তার কাছে, সেখানে হাজার হাজার মানুষ যাচ্ছেন। তাদের গুলির মুখে পড়তে হচ্ছে। জিএইচএফের চেয়ারম্যান জনি মুর ব্রাসেলসে বুধবার সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেছেন, তারা ত্রাণশিবির বন্ধ করবেন না। তারা এখনো পর্যন্ত পাঁচ কোটি ৫৫ লাখ মিল বিতরণ করেছেন। তারা জাতিসংঘ ও অন্য ত্রাণসংস্থার সঙ্গে একযোগে কাজ করতে ইচ্ছুক। তিনি বলেছেন, গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রতিদিন মৃত্যুর তালিকা দেয় এবং বলে তারা জিএইচএফের ত্রাণ নিতে গিয়েই মারা গেছেন। ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) আগে অনেকবার বলেছে, ত্রাণ নিতে গিয়ে সামরিক পজিশনের খুব কাছে যখন মানুষ চলে আসে, তখন তারা সাবধান করে দেওয়ার জন্য গুলী ছোড়ে। তবে এর ফলে কতজন মারা গেছেন সেই সংখ্যা তারা জানায়নি।