ইন্টারনেট: ভূমিকম্পের ঝুঁকি বিবেচনায় সমগ্র বাংলাদেশকে মোট তিনটি জোনে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে উচ্চঝুঁকির আওতাভুক্ত অঞ্চলকে জোন-১, মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা জোন-২ এবং জোন-৩-এর এলাকা নিম্ন ঝুঁকিপ্রবণ হিসাবে চিহ্নিত। আবহাওয়া অধিদপ্তরের এক মানচিত্রে দেশের ভূমিকম্প ঝুঁকিপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার প্রাণঘাতী ভূমিকম্পের রেশ কাটতে না কাটতেই, গত শনিবার রাজধানী ও আশপাশের এলাকায় মাত্র ৮ ঘণ্টার ব্যবধানে আরও তিনটি মৃদু ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। এদিকে শনিবার থেকে রোববার পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ৯১টি ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণকারী ওয়েবসাইট ‘আর্থকোয়াকট্র্যাকার ডটকম’। কিছু দেশ রয়েছে যেগুলোতে ভূমিকম্পের ঝুঁকি তুলনামূলক কম। ওই দেশগুলো প্রধান ভূমিকম্পের ফল্টলাইন থেকে অনেক দূরে অবস্থিত হওয়ায় সাধারণত প্রাকৃতিকভাবে ভূমিকম্প হয় না। উত্তর-মধ্য আফ্রিকার দেশ চাদে ভূমিকম্প ঝুঁকি অত্যন্ত কম। সবচেয়ে কাছের ফল্ট লাইন আফ্রিকা ও আরবীয় প্লেট সীমান্ত, যা দেশটি থেকে প্রায় ২ হাজার ১০০ কিলোমিটার দূরে। তবে বন্যা, খরা, দাবানলের মতো অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপদের ঝুঁকি রয়েছে। নাইজার কোনো প্রধান ফল্ট লাইনের কাছে নেই। ভূমিকম্পের ঝুঁকি কম হলেও দেশটিতে বন্যা, খরা ও উচ্চ তাপমাত্রা জনজীবন প্রভাবিত করতে পারে।

পশ্চিম আফ্রিকার একটি দেশ আইভরি কোস্ট। সেখানে ভূমিকম্পের ঝুঁকি বেশ কম। স্থলবেষ্টিত দেশ বুরকিনা ফাসোতে ভূমিকম্পের ঝুঁকি কম হলেও বন্যা, খরা ও আগুনের ঝুঁকি রয়েছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং দীর্ঘ শুষ্ক মৌসুম কৃষি উৎপাদন প্রভাবিত করছে। ক্যারিবীয় প্লেটের ফল্ট লাইন থেকে প্রায় ৪৮০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বাহামা। ভূমিকম্প খুবই বিরল হলেও উপকূলীয় বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকি বেশি দেশটিতে। উত্তর ইউরোপের সুন্দর একটি দেশ ফিনল্যান্ড। তাদের সবচেয়ে কাছের ফল্ট লাইনও ২ হাজার ১০০ কিলোমিটার দূরে। তবে খনন বা বিস্ফোরণের কারণে মাঝেমধ্যে মানবসৃষ্ট ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ফিনল্যান্ডে বন্যা-দাবানলের মতো অন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যাও বেশ কম। উত্তর-পশ্চিম ইউরোপের দেশ ডেনমার্ক আফ্রিকান-ইউরেশিয়ান প্লেট সীমান্ত প্রায় ১ হাজার ৯৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ফলে ডেনমার্কে খুব কম ভূমিকম্প হয়, হলেও মাত্রা থাকে কম।

প্রধান ফল্ট লাইন থেকে ১ হাজার ১০০ কিলোমিটার দূরে থাকায় লাটভিয়ায় ভূমিকম্প দেখাই যায় না। তবে বসন্তকালে ভারি বৃষ্টিপাত ও বরফ গলনজনিত বন্যা হতে পারে। উত্তর-পশ্চিম ইউরোপের দেশ আয়ারল্যান্ডে ভূমিকম্পের ঝুঁকি কম। দক্ষিণ আমেরিকার দেশ উরুগুয়ে প্রধান ফল্ট লাইন থেকে প্রায় ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হওয়ায় ভূমিকম্প বিরল। তবে উপকূলবর্তী অবস্থানের কারণে বন্যার ঝুঁকি রয়েছে।

ভূমিকম্প পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ও ধ্বংসাত্মক প্রাকৃতিক ঘটনার মধ্যে অন্যতম। জনবহুল এলাকায় এটি মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি ডেকে আনতে পারে, এমনকি সুনামি ও ভূমিধসের মতো দুর্যোগের কারণও হতে পারে। টেকটোনিক প্লেটের নড়াচড়া, আগ্নেয়গিরিতে চৌম্বকীয় পদার্থের সঞ্চালন, তাপমাত্রা বা পানির চাপের পরিবর্তন এবং তীব্র বাতাসসহ বেশ কিছু কারণ ভূমিকম্প সৃষ্টি করে। ভূমিকম্প প্রতিরোধ করা সম্ভব না হলেও কিছু ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এর সময় নিজেকে অনেকাংশে নিরাপদ রাখা যায়।

ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে বসবাস মানেই প্রতিদিন ভূমিকম্প হবে এমন নয়। তবুও বাড়িতে জরুরি সরঞ্জাম প্রস্তুত রাখা, পরিবারের সবাইকে দুর্যোগ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানানো এবং পরিস্থিতি গুরুতর হলে দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যাওয়া জরুরি। আশপাশের পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন থাকা ও নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ নেওয়া ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সহায়ক। বিশেষত, যারা পৃথিবীর সবচেয়ে ভূমিকম্পপ্রবণ দেশগুলোতে বাস করেন তাদের জন্য প্রস্তুত থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখন জেনে নেওয়া যাক, বিশ্বের কোন কোন দেশ সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্পপ্রবণ।

জাপান : ভূমিকম্পপ্রবণ দেশের তালিকার শীর্ষে রয়েছে জাপান। প্রশান্ত মহাসাগরের চারপাশের অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকম্প অঞ্চল—‘রিং অফ ফায়ার’-এ অবস্থান করায় দেশটি সবসময়ই টেকটোনিক কার্যকলাপ ও ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকে। এই ঝুঁকি মোকাবিলায় জাপান উন্নত প্রযুক্তি ও সিসমিক মনিটরিং ব্যবস্থা তৈরি করেছে, যা ক্ষুদ্রতম ভূমিকম্পও শনাক্ত করতে সক্ষম। পুরো দেশজুড়ে কৌশলগতভাবে স্থাপন করা হয়েছে এক হাজারের বেশি সিসমোমিটার। গবেষণায় দেখা গেছে, অধিকাংশ ভূমিকম্পই ছোট, যা সাধারণ মানুষ টেরও পায় না। তবে মাঝে মাঝে বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হানে, যা প্রাণহানি ও ব্যাপক ক্ষতির কারণ হয়। জাপানে দেশব্যাপী একটি সতর্কতা ব্যবস্থা চালু আছে, যা বাসিন্দাদের আগাম তথ্য দিয়ে প্রস্তুত হতে সাহায্য করে।

ইন্দোনেশিয়া: ইন্দোনেশিয়া বিশ্বের অন্যতম ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ। প্রায় প্রতি বছরই ৬ মাত্রার বেশি শক্তিশালী ভূমিকম্প দেশটিতে আঘাত হানে। ২০১৮ সালে ৬ এর ওপরে নয়টি ভূমিকম্পে হাজারও মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। প্রশান্ত মহাসাগরীয় রিং অব ফায়ারের ওপর অবস্থানের কারণে দেশটি ভূমিকম্পের পাশাপাশি আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত, খরা, বন্যা ও সুনামির ঝুঁকিতেও রয়েছে।

চীন: চীনে ভূমিকম্পের ইতিহাস দীর্ঘ এবং ভয়াবহ। অতীতে বহু ভূমিকম্প হাজার হাজার মানুষের প্রাণ নিয়েছে। ২০০৮ সালে সিচুয়ান প্রদেশে আঘাত হানা ৭.৯ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্পে ৮৭ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায় বা নিখোঁজ হন। দেশটি একাধিক সক্রিয় টেকটোনিক প্লেটের ওপর অবস্থান করায় ক্রমাগত ভূত্বকে চাপ সৃষ্টি হয়, যা ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়ায়। চীনের বিস্তীর্ণ পাহাড়ি অঞ্চলগুলো ভূমিধসের ঝুঁকি তৈরি করে, যা পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোকেও ভূমিকম্পে প্রভাবিত করতে পারে।

ফিলিপাইন: প্রশান্ত মহাসাগরীয় রিং অফ ফায়ারের ধার ঘেঁষে অবস্থান করায় ফিলিপাইনও বিশ্বের সবচেয়ে ভূমিকম্পপ্রবণ দেশগুলোর একটি। এর পাহাড়ি ভূপ্রকৃতি ভূমিকম্পের সময় মারাত্মক ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়ায়। পাশাপাশি নিয়মিত টাইফুন ও গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঝড়ও দেশটিকে বিপদে ফেলে। এসব কারণে বাসিন্দারা নিজেদের সুরক্ষায় মজবুত ঘরবাড়ি নির্মাণসহ বিভিন্ন নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকেন।

ইরান: ইরান বহু বছর ধরেই বিধ্বংসী ভূমিকম্পের সাক্ষী। দেশটির বিভিন্ন প্লেট সীমানা ও ফল্ট লাইনের ওপর অবস্থান করায় এখানে ভূমিকম্পের হার খুবই বেশি। ১৯৯০ সালে গিলান প্রদেশে আঘাত হানা ভূমিকম্পে ৪০ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়। ভয়াবহ এই ট্র্যাজেডিগুলোর পরও ইরানিরা দেশে বসবাস চালিয়ে যাচ্ছেন, কারণ ভূমিকম্পসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার উপায় সম্পর্কে তারা ইতিমধ্যে জ্ঞান ও সচেতনতা অর্জন করেছে।