ইসরাইলী বাহিনীর হামলায় বৃহস্পতিবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় নিহত হয়েছেন ১৩৮ জন এবং আহত হয়েছেন আরও ৬২৫ জন। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি অনুসারে, ইসরাইলী বাহিনীর বৃহস্পতিবার-শুক্রবারের অভিযানের জেরে গাজায় গত ২১ মাসে মোট নিহতের সংখ্যা ৫৭ হাজার ২৬৮ জন এবং আহতের সংখ্যা ১ লাখ ৩৫ হাজার ১৭৩ জনে পৌঁছেছে। “তবে আহত ও নিহতের প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি। ধ্বংসস্তূপের তলায় অনেকে চাপা পড়ে আছে। তাদেরকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি”, বলা হয়েছে মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় অভিযান শুরু করে আইডিএফ। মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সোমবারের পর ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযানে গাজায় মোট নিহতের সংখ্যা পৌঁছেছে ৫৪ হাজার ৯২৭ জনে। এদের পাশাপাশি আহত হয়েছেন আরও ১ লাখ ২৬ হাজার ২২৭ জন ফিলিস্তিনি। ২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইলের ভূখণ্ডে ঢুকে অতর্কিত হামলা চালায় গাজা উপত্যকা নিয়ন্ত্রণকারী সশস্ত্র রাজনৈতিক গোষ্ঠী হামাসের যোদ্ধারা। এলোপাতাড়ি গুলী চালিয়ে ১ হাজার ২০০ জনকে হত্যার পাশাপাশি ২৫১ জনকে জিম্মি হিসেবে ধরে নিয়ে যায় তারা। আনাদোলু এজেন্সি, রয়টার্স।

হামাসের হামলার জবাব দিতে এবং জিম্মিদের মুক্ত করতে ওই দিন থেকেই গাজায় অভিযান শুরু করে ইসরাইলী বাহিনী। ১৫ মাসেরও বেশি সময় ধরে টানা অভিযান চালানোর পর যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যস্থতাকারী অন্যান্য দেশগুলোর চাপে বাধ্য হয়ে গত ১৯ জানুয়ারি গাজায় যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে ইসরায়েল। কিন্তু বিরতির দু’মাস শেষ হওয়ার আগেই গত ১৮ মার্চ থেকে ফের গাজায় অভিযান শুরু করে আইডিএফ। দ্বিতীয় দফার এ অভিযানে গত আড়াই মাসে গাজায় নিহত হয়েছেন ৬ হাজার ৭১০ জন ফিলিস্তিনি এবং আহত হয়েছেন আরও প্রায় ২৩ হাজার ৫৮৪ জন। যে ২৫১ জন জিম্মিকে হামাসের যোদ্ধারা ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তাদের মধ্যে অন্তত ৩৫ জন এখনও জীবিত আছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। সামরিক অভিযানের মাধ্যমে তাদের উদ্ধার করার ঘোষণা দিয়েছে আইডিএফ।

ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে হামলায় নিহত ৬১৩

জাতিসংঘের মানবাধিকার দফতর জানিয়েছে, ইসরাইলী হামলায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলী সমর্থিত গাজা গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) পরিচালিত ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র এবং অন্যান্য সংস্থা পরিচালিত মানবিক সহায়তা বহরের আশপাশে অন্তত ৬১৩ জন নিহত হয়েছেন। গত শুক্রবার জাতিসংঘের মানবাধিকার দফতরের মুখপাত্র রাভিনা শামদাসানি জেনেভায় সাংবাদিকদের বলেন, আমরা ৬১৩টি হত্যার ঘটনা নথিভুক্ত করেছি। এটি ২৭ জুন পর্যন্ত হিসাব। এরপর আরও কিছু ঘটনা ঘটেছে।’ জাতিসংঘ-নেতৃত্বাধীন ব্যবস্থাকে এড়িয়ে জিএইচএফ যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি নিরাপত্তা ও লজিস্টিক কোম্পানির সহায়তায় গাজায় ত্রাণ সরবরাহ করছে। ইসরায়েলের দাবি, জাতিসংঘ-নেতৃত্বাধীন ব্যবস্থায় হামাস জঙ্গিরা ত্রাণ ছিনিয়ে নিচ্ছে। তবে জাতিসংঘ এই জিএইচএফ পদ্ধতিকে বিপজ্জনক এবং মানবিক নিরপেক্ষতার নীতিমালার লঙ্ঘন বলে আখ্যা দিয়েছে। রাভিনা শামদাসানি আরও বলেন, জিএইচএফ ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র এবং মানবিক সহায়তা বহরের আশপাশে হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। এসব মানবিক সংস্থার মধ্যে জাতিসংঘও রয়েছে।

জিএইচএফ মে মাসের শেষ দিকে গাজায় খাদ্য প্যাকেট বিতরণ শুরু করে। সংস্থাটি একাধিকবার দাবি করেছে যে তাদের বিতরণ কেন্দ্রে কোনও হামলার ঘটনা ঘটেনি। তবে জাতিসংঘের মানবাধিকার দফতর (ওএইচসিএইচআর) জানিয়েছে, ৬১৩ জন নিহতের মধ্যে ৫০৯ জন নিহত হয়েছেন জিএইচএফ বিতরণকেন্দ্রগুলোর আশেপাশে। ওএইচসিএইচআর বলেছে, তাদের এই হিসাব বিভিন্ন উৎস থেকে সংগৃহীত। যেমন: হাসপাতাল, কবরস্থান, পরিবার, ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ, এনজিও এবং স্থলভিত্তিক অংশীদারদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে এ হিসাব করেছে তারা। সংস্থাটি আরও জানিয়েছে, তারা নতুন নতুন প্রতিবেদন যাচাই করছে এবং এখনও নির্দিষ্টভাবে জানাতে পারছে না যে ঠিক কোথায় কতজন নিহত হয়েছেন।

জিএইচএফ আগেই রয়টার্সকে জানিয়েছিল, তারা পাঁচ সপ্তাহে ৫ কোটির বেশি খাবার সরবরাহ করেছে ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের মাঝে। সংস্থাটির অভিযোগ, অন্যান্য ত্রাণ সংস্থাগুলোর প্রায় সব ত্রাণ লুটপাট হয়ে গেছে। ইসরায়েল ১৯ মে গাজার উপর প্রায় ১১ সপ্তাহের ত্রাণ অবরোধ তুলে নেয়। তবে জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক সমন্বয় দফতর রয়টার্সকে জানিয়েছে, কিছু সহিংস লুটপাট এবং ট্রাক চালকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে।

মানবিক বিষয়ক সমন্বয় দফতরের মুখপাত্র এরি কানেকো এক বিবৃতিতে রয়টার্সকে বলেন, একটি দখলদার শক্তি হিসেবে, ইসরাইলীর দায়িত্ব গাজার জননিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা নিশ্চিত করা। এর মধ্যে পড়ে -একাধিক ক্রসিং ও রুট ব্যবহার করে আরও বেশি জরুরি ত্রাণ প্রবেশ করতে দেওয়া- যাতে মানবিক চাহিদা পূরণ করা যায়। এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক কোনও মন্তব্য করেনি ইসরাইলী সামরিক বাহিনীর ত্রাণ সমন্বয় সংস্থা। তবে ইসরাইলী সামরিক বাহিনী সোমবার স্বীকার করেছে যে গাজায় ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুই বছরব্যাপী ইসরাইলীর সামরিক অভিযানে গাজার অধিকাংশ এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ২০ লাখেরও বেশি বাসিন্দা গৃহহীন হয়েছে। ফলে খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মারাত্মক সংকট দেখা দিয়েছে।