গাজা সিটিতে রাতের অন্ধকারে হঠাৎ এক বিশাল বিস্ফোরণ। বিছানা থেকে ছিটকে পড়েন হামজা শাবান। হতভম্ব ও আতঙ্কিত হয়ে পড়েন তিনি। জানালার বাইরে তাকাতেই দেখতে পেলেন রিমোট কন্ট্রোলের বিস্ফোরক বোঝাই রোবট। ৩৫ বছর বয়সি হামজা বলেন, ‘রোবটটা কোথায় আছে তা দেখতে আমি আবারও জানালার বাইরে তাকালাম, দেখলাম এটি আমার থেকে প্রায় ১০০ মিটার দূরে। এরপর আরেকটি বিস্ফোরণ ঘটল যা আমাকে দুই মিটার দূরে ছুড়ে দিল। আমি হাত ও হাঁটুতে ভর করে শোবারঘরের দিকে পালাতে শুরু করলাম।’ হামজা আরও বলেন, ‘আমি বিস্ফোরণের ভয়ানক শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম।’ এটি কোনো বিমান হামলা নয়, এটি এক চলন্ত মারণযন্ত্র। যার ধ্বংসযজ্ঞ শহরের প্রতিটি রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ছে। রয়র্টাস, বিবিসি।
এমন ঘটনা গাজার বাসিন্দাদের জন্য এখন খুবই সাধারণ ঘটনা হয়ে উঠেছে। গত মাসে ঘোষণা করার পর প্রায় ১০ লাখ মানুষের বাসস্থান গাজা সিটিতে হামলা সম্প্রসারণ করেছে ইসরাইলী সেনারা। এরপর থেকে প্রায় প্রতি রাতেই বড় বড় বিস্ফোরণে কেঁপে উঠছে শহরটি। গাজার ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকায় স্থলসেনা মোতায়েনের পরিবর্তে আর্মাড পার্সোনেল ক্যারিয়ার (এপিসি) পাঠাচ্ছে ইসরাইল। এই নতুন সহিংসতার কেন্দ্রে আছে ইসরাইলের সর্বশেষ যুদ্ধকৌশল-দূরনিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরকভর্তি এই ‘রোবটযান’। টনের পর টন বিস্ফোরকভর্তি এপিসিগুলো দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করে নির্দিষ্ট স্থানে পাঠানো হয়। তারপর বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটে। হামজা বলেছেন, ‘সাধারণত রাত ১০ বা ১১টার দিকে যখন মানুষ ঘুমাতে যাওয়ার চেষ্টা করে, তখনই বিস্ফোরণ শুরু হয়।’ প্রতি রাতেই এমন ৮ থেকে ১০টা বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায় বলে উল্লেখ করেন হামজা। তিনি আরও বলেছেন, ‘এসব বিস্ফোরণ ভীষণ শক্তিশালী। পুরো ভবনকে গুঁড়িয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। এগুলো বিমান হামলার চেয়েও অনেক বেশি বিধ্বংসী।’ গাজাভিত্তিক সরকারি গণমাধ্যম দপ্তরের তথ্যানুযায়ী, গত ১৩ আগস্ট থেকে উপত্যকার জনবহুল এলাকায় অন্তত ১০০টি ‘বিস্ফোরক রোবট’ ব্যবহার করা হয়েছে। অলাভজনক সংস্থা ইউরো-মেডিটেরেনিয়ান হিউম্যান রাইটস মনিটরের তথ্যানুযায়ী-এসব বিস্ফোরণে প্রতিদিন প্রায় ৩০০টি আবাসিক ইউনিট ধ্বংস হচ্ছে। সংস্থাটির আরও জানিয়েছে, প্রতিটি রোবটে প্রচণ্ড শক্তিশালী বিস্ফোরক ভরা থাকে। এর ওজন কখনো কখনো সাত টন পর্যন্ত হয়।
এদিকে, ফিলিস্তিনের সশস্ত্র সংগঠন হামাসকে শেষ সতর্কবার্তা দিয়েছে ইসরাইল। হামাস যোদ্ধারা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমস্ত জিম্মিকে মুক্তি এবং আত্মসমর্পণের দাবি মেনে না নিলে গাজায় হারিকেনের মতো হামলার ঝড় তুলবে বলে সতর্ক করেছে দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কার্টজ। সোমবার এ হুমকি দেন তিনি। অন্যদিকে, একই দিনে স্পেন ঘোষণা করেছে, গাজায় গণহত্যা বন্ধ করতে এবং এর দায়ীদের শাস্তি দিতে তারা ৯টি পদক্ষেপ নেবে। এর মধ্যে আছে ইসরাইলের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা, ইসরাইলকে সরবরাহিত যে কোনো অস্ত্রবাহী বিমানকে স্পেনের আকাশপথ ব্যবহার থেকে বন্ধ করা এবং ইসরাইলী সেনাদের জ্বালানি বহনকারী জাহাজকে স্পেনের বন্দর ব্যবহার থেকে নিষিদ্ধ করা।
গাজার বাসিন্দাদের অবিলম্বে সরে যাওয়ার নির্দেশ ইসরাইলী সেনাবাহিনীর
ইসরাইলী সেনাবাহিনী গাজা সিটির সব বাসিন্দাকে ‘অবিলম্বে সরিয়ে নিতে’ নির্দেশ দিয়েছে। কারণ তারা ‘প্রচণ্ড শক্তি’ দিয়ে এলাকায় অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক পোস্টে আইডিএফের আরবি ভাষার মুখপাত্র ‘সব এলাকার উপস্থিত ব্যক্তিদের’ মানবিক জোনে চলে যাওয়ার আহ্বান জানান। ফলে ১০ লাখ ফিলিস্তিনীর শহরের বাসিন্দারা কয়েক সপ্তাহ ধরে এই আক্রমণের আশঙ্কা করছিল। কারণ হামাসকে চূড়ান্তভাবে ধ্বংস করার পরিকল্পনা নিয়েছে ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।
তারপরও এই সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ গাজার বৃহত্তম নগরকেন্দ্রের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। কেউ কেউ বলেছেন, তাদের দক্ষিণে যেতে হবে। কিন্তু বেশিরভাগই বলেছেন তারা থেকে যাবেন কারণ অন্য কোথাও নিরাপদ নয়।
জাতিসংঘও বলছে, গাজার কোথাও নিরাপদ বিবেচনা করা যায় না। গত মাসে ইসরাইলের নিরাপত্তা মন্ত্রিসভা গাজার সবচেয়ে জনবহুল শহরটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরিকল্পনা অনুমোদন করে। এর আগে ইসরাইল সতর্ক করেছিল যে হামাস যদি জিম্মিদের মুক্তি না দেয়,তারা গাজায় সামরিক হামলা বাড়াবে। ৫৫ বছর বয়সী ছয় সন্তানের মা উম মোহাম্মদ বলেছেন, গত সপ্তাহের গোলাবর্ষণ সত্ত্বেও আমি সরে যেতে অস্বীকার করেছিলাম। কিন্তু এখন কী করবো? গাজাবাসীরা ইতিমধ্যেই ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধের পর বহুবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে। উত্তর থেকে দক্ষিণে এবং দক্ষিণ থেকে উত্তরে ঘুরতে ঘুরতে তাদের মানবিক সংকট আরও গভীর হয়েছে।
ইসরাইলী সেনাবাহিনী গাজা সিটির বাসিন্দাদের দক্ষিণের খান ইউনিসের আল-মাওয়াসি এলাকায় যেতে নির্দেশ দিয়েছে। ওই এলাকাকে তারা ‘মানবিক জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই সামরিক অভিযান এমন সময়ে আসছে যখন কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ, গাজায় ইসরাইলের বোমাবর্ষণে ক্ষুব্ধ হয়ে, এই মাসে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনী রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলেছে। তবে ইসরাইল তা প্রত্যাখ্যান করেছে। আন্তর্জাতিক সমালোচকেরা বলছেন, ইসরাইলের পরিকল্পনা পুরো গাজা উপত্যকাকে নিরস্ত্রীকরণ করা এবং এর নিয়ন্ত্রণ নেওয়া, যা ২২ লাখ মানুষের মানবিক দুর্দশা আরও বাড়িয়ে দিতে পারে, যেখানে কিছু এলাকায় দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করা হয়েছে। ২০২৩ সালের অক্টোবরে যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই ইসরাইল গাজার ৭৫ শতাংশ এলাকা দখল করেছে।
গাজায় ইসরাইলী হামলায় একদিনে নিহত আরও ৫২
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় হামলা জোরদার করেছে ইসরাইলী বাহিনী। দখলদার বাহিনীর হামলায় একদিনেই আরও ৫২ জন নিহত হয়েছেণ। একইসঙ্গে ক্ষুধায় আরও দুই শিশুসহ ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। সংবাদমাধ্যমটি বলছে, গাজা শহরের বাসিন্দাদের ‘এখনই চলে যেতে’ হুমকি দিয়েছেন ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। একইসঙ্গে জাতিসংঘের মানবাধিকার-বিষয়ক প্রধান বেসামরিক মানুষকে ‘গণহত্যা’ এবং জীবনরক্ষাকারী সহায়তা সরবরাহ ইচ্ছাকৃতভাবে বাধাগ্রস্ত করার অভিযোগে ইসরাইলের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।
সোমবার জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক অভিযোগ করে বলেন, ইসরাইল ‘একটির পর একটি যুদ্ধাপরাধ’ করছে এবং গাজার ধ্বংসযজ্ঞের মাত্রা ‘বিশ্বের বিবেককে নাড়া দিচ্ছে’। তিনি আরও বলেন, ইসরাইলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) জবাবদিহি করার মতো যথেষ্ট কারণ আছে। গত জানুয়ারিতে আদালত ইসরাইলকে গণহত্যা প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছিল। ফিলিস্তিনী সিভিল ডিফেন্স জানিয়েছে, রোববার সকাল থেকে ইসরাইলী হামলায় অন্তত ৫০টিরও বেশি ভবন ধ্বংস হয়েছে এবং আরও ১০০টির আংশিক ক্ষতি হয়েছে।
সংস্থাটির মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল অভিযোগ করেন, ইসরাইল ইচ্ছাকৃতভাবে বাস্তুচ্যুত পরিবারের শিবিরসংলগ্ন আবাসিক ভবনগুলোতে আঘাত হানছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ২০০টিরও বেশি তাবু ধ্বংস হয়েছে। হানি মাহমুদ গাজা শহর থেকে জানিয়েছেন, ‘একটির পর একটি সুউচ্চ ভবন ভেঙে পড়তে দেখা হৃদয়বিদারক। এগুলো শুধু ভবন নয়, এর সঙ্গে মানুষের বেঁচে থাকার জন্য জরুরি সেবাগুলোও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, সেটিও আবার যুদ্ধের প্রায় দুই বছর পরও।’ স্থানীয় হাসপাতালগুলো জানিয়েছে, সোমবার একদিনেই অন্তত ৫২ ফিলিস্তিনী নিহত হয়েছেন, এর মধ্যে ৩২ জন প্রাণ হারিয়েছেন গাজা শহরের। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আরও ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে ক্ষুধা ও অপুষ্টিতে, যাদের মধ্যে দুজন শিশু রয়েছে। ইসরাইল নিয়মিতভাবে সাহায্য ঠেকানো বা বোমা হামলা করায় এ মানবিক সংকট তৈরি হয়েছে। চিকিৎসকরা জানান, সোমবার ইসরাইলী হামলায় নিহতদের মধ্যে ফিলিস্তিনী সাংবাদিক ওসামা বালউশাও রয়েছেন।