নিউইয়র্ক টাইমস : ইসরাইলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু পশ্চিমা মিত্রদেশ এখন রাজনৈতিক চাপে পড়েছে। এ চাপ আসছে দেশগুলো সাধারণ মানুষের কাছ থেকে। কারণ, গাজার বাসিন্দাদের অনাহারে থাকার তথ্য-প্রমাণ তাঁদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করছে। গাজাবাসী যে না খেয়ে আছেন, তা মনে করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও। কয়েক মাসের মধ্যে প্রথমবারের মতো নিজের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক দূতকে ইসরাইলে পাঠিয়েছেন। সেখানে গিয়ে তিনি গাজার বিশৃঙ্খল খাদ্য বিতরণব্যবস্থা দেখবেন। গাজায় ইসরাইল গণহত্যা করছে কি না, তা নিয়ে অনেক বুদ্ধিজীবী এখন প্রশ্ন তুলছেন। যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে করা জরিপে দেখা যাচ্ছে, মানুষ ইসরাইলকে নিয়ে আরও নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করছেন। গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে ইসরাইলের এ যুদ্ধ শেষ করার স্পষ্ট কোনো পরিকল্পনাও দেখা যাচ্ছে না।
ইসরাইলের প্রতি এ অবিশ্বাস নিয়ে ক্ষুব্ধ দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তিনি বলেছেন, গাজায় অনাহারের তথ্য অতিরঞ্জিত, হামাসকে ধ্বংস করা দরকার, সমালোচনাকারীরা অনেকেই ইহুদিবিদ্বেষী। নেতানিয়াহুর মতে, পশ্চিমা দেশগুলো ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিলে তা হবে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামলার জন্য হামাসকে পুরস্কৃত করা। ইসরাইলি রাজনীতিবিষয়ক বিশ্লেষক নাটান স্যাকস বলেন, একে একই ধরনের আরেকটি সমস্যা হিসেবে মনে করছে ইসরাইল। কিন্তু তারা বিশ্বের মনোভাব বুঝতে ভুল করছে। কারণ, পুরো দুনিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি এখন বদলে যাচ্ছে। আর তরুণদের মধ্যে এ বদলটা সবচেয়ে বেশি।
গাজায় ব্যাপক অনাহার নিয়ে যখন মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে, তখন বিশ্বমঞ্চে ইসরাইল আরও একা হয়ে পড়ছে। ২০২৩ সালে হামাসের সে হামলা এখনো ইসরাইলিদের মনে গেঁথে আছে। কিন্তু গাজায় যেভাবে ধ্বংসযজ্ঞ আর অনাহার চলছে, তা বিশ্বের অন্যদের চোখে আরও বেশি পড়ছে এবং গুরুত্ব পাচ্ছে। এপ্রিলে করা এক জরিপে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রাপ্তবয়স্কদের ৫৩ শতাংশ এখন ইসরাইল সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন। ইসরাইলে হামাসের হামলার আগে এ হার ছিল ৪২ শতাংশ। হামাসের হাত থেকে জিম্মিদের মুক্তির জন্য গত মার্চে ইসরাইল গাজায় সাহায্য বন্ধ করে দেয়। তারপর তারা সেখানে নিজেরা খাবার বিতরণের চেষ্টা করে। কিন্তু তা বিশৃঙ্খল ও প্রাণঘাতী রূপ নিয়েছে। ইসরাইলের ত্রাণকেন্দ্রগুলোয় খাবার সংগ্রহ করতে গিয়ে বহু ফিলিস্তিনি হত্যার শিকার হয়েছেন।
এ সংঘাত কখন শেষ হবে, তা কেউ জানে না। ইসরাইল বহুবার গাজার বিভিন্ন জায়গা দখলে নিয়েছে, আবার ছেড়েও দিয়েছে। জাতিসংঘ বলছে, গাজায় ৬০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। তাঁদের বেশির ভাগই সাধারণ মানুষ। নেতানিয়াহু এখনো জানাননি, সংঘাত শেষে হামাসের বদলে কে গাজা শাসন করবে। এ কাজে যাদের সহায়তা করার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি—সেই সৌদি আরব, মিসর বা উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসতেও রাজি নন তিনি।
ট্রাম্প হামাসবিরোধী সংঘাতে ইসরাইলের পক্ষে। তিনি আগেও নেতানিয়াহুকে যেভাবে খুশি হামলা করার স্বাধীনতা দিয়েছেন। কিন্তু এবার ট্রাম্পকে গাজার দুর্ভিক্ষের ভিডিও দেখে হতবাক মনে হয়েছে। তাঁর অনেক ঘনিষ্ঠ সমর্থকও এখন বলছেন, ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে ভাবতে হবে। ইসরাইলের লেবার পার্টির নেতৃত্বাধীন সাবেক সরকারের হয়ে আলোচনায় অংশ নেওয়া ড্যানিয়েল ল্যাভি বলেন, এখন একধরনের সাংস্কৃতিক পরিবর্তন হচ্ছে। অনেক জায়গা, যেমন অপেরা হাউস বা সংগীত উৎসবে ইসরাইলবিরোধী, ফিলিস্তিনপন্থী—এমনকি কখনো ইহুদিবিদ্বেষী বিক্ষোভ হচ্ছে। পপ তারকা বিলি আইলিশ ও আরিয়ানা গ্র্যান্ডে যুদ্ধবিরতি ও গাজায় সাহায্যের পক্ষে কথা বলেছেন।
ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া মূলত প্রতীকী পদক্ষেপ। আগে থেকেই ১৪৭টি দেশটি এ পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সও যদি তা করে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রই হবে নিরাপত্তা পরিষদের একমাত্র স্থায়ী সদস্য যারা ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়নি। ল্যাভি এখন ইউএস-মিডল ইস্ট প্রজেক্ট নামের একটি অলাভজনক সংস্থার প্রেসিডেন্ট। তিনি বলেন, অনেক দিন ধরে ইসরাইল মনে করেছে, তারা যদি জোরেশোরে ‘হলোকাস্ট’ ও ইহুদিবিদ্বেষের কথা প্রকাশ করে, তাহলে সবাই চুপ করে যাবেন, কিন্তু সময় বদলে গেছে। এ কৌশল এখন আর আগের মতো কাজ করছে না।
জনমত জরিপেও সেই পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এপ্রিলে করা এক জরিপে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রাপ্তবয়স্কদের ৫৩ শতাংশ এখন ইসরাইল সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন। ইসরাইলে হামাসের হামলার আগে এ হার ছিল ৪২ শতাংশ। তাদের মধ্যে খুবই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রাখা মানুষের হার ১৯ শতাংশ। ২০২২ সালে তা ছিল ১০ শতাংশ। আরেকটি জরিপে দেখা গেছে, ২৪টি দেশের মধ্যে ২০টিতে অর্ধেক বা তার বেশি মানুষ ইসরাইল সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন। অস্ট্রেলিয়া, জাপান, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, তুরস্কসহ অনেক দেশে এ হার ৭৫ শতাংশের বেশি। তরুণদের মধ্যে এ মনোভাব আরও বেশি।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ বলেছেন, সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘে তাঁর দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নিও একই কথা বলেছেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার শর্ত সাপেক্ষে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতির কথা বলেছেন। এসব এটাই তুলে ধরছে যে ইসরাইল ও যুদ্ধ নিয়ে পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গি খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। যদিও ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া মূলত প্রতীকী পদক্ষেপ। আগে থেকেই ১৪৭টি দেশ এ পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সও যদি তা করে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রই হবে নিরাপত্তা পরিষদের একমাত্র স্থায়ী সদস্য, যারা ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়নি। তখন ফিলিস্তিনের স্বীকৃতি ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রকে ভেটো দিতে হতে পারে।
পশ্চিমারা এত দিন ধরে চুপ ছিল। কারণ, তাদের ইসরাইলের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে দেওয়া হতো না বলে মনে করেন ইসরাইলি বংশোদ্ভূত মার্কিন অধ্যাপক বার্নার্ড আভিশাই। তিনি বলেন, এখন গাজায় যা ঘটছে, তা দেখে জমে থাকা ক্ষোভ বেরিয়ে আসছে। এটা অনেকের ইসরাইলের সঙ্গে কাজ করা বা ভ্রমণের ইচ্ছা কমিয়ে দিচ্ছে। ইসরাইলের অর্থনীতিতে এটা ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে। ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা চাক ফ্রেইলিচ বলেন, মানুষের মনোভাবে এ বদল এবং ইসরাইলকে এর জন্য যে মূল্য দিতে হবে, সেই বাস্তবতা বুঝতে দেরি করছেন নেতানিয়াহু। এ মনোভাব বদলের পেছনের কারণ যা–ই হোক না কেন, মূল বিষয়টা হলো ইসরাইল একঘরে হয়ে যাচ্ছে।