মিডলইস্ট মনিটর, আলজাজিরা: অনেক গাজাবাসী অপুষ্টির মুখোমুখি হওয়ায়, দাতারা অবরুদ্ধ এলাকায় রক্তদান করতে পারছেন না। গাজার ইতিমধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার মুখে পড়েছে কারণ রক্তের ব্যাংকগুলি শুকিয়ে গেছে এবং ইসরাইলী বাহিনী রোগী এবং বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলিকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য ক্লিনিক এবং সুযোগ-সুবিধাগুলিকে লক্ষ্য করে সাহায্যের অবরোধ অব্যাহত রেখেছে। অবরুদ্ধ এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা কর্মকর্তারা গত বুধবার জানিয়েছেন যে রক্তের তীব্র ঘাটতি রয়েছে কারণ ইসরাইলী-সৃষ্ট তীব্র ক্ষুধা সংকটের কারণে অনেক সম্ভাব্য দাতা অপুষ্টিতে ভুগছেন, যার মধ্যে গত ২৪ ঘন্টায় পাঁচজন ফিলিস্তিনী মারা গেছেন।

গাজা সিটি থেকে রিপোর্ট করা আল জাজিরার হানি মাহমুদ বলেছেন, গাজার বাকি কার্যকরী চিকিৎসা সুবিধাগুলিতে - আল-শিফা হাসপাতাল, আল-আকসা হাসপাতাল এবং নাসের হাসপাতাল - রক্তদানের তীব্র প্রয়োজন। আমরা ব্লাড ব্যাংকগুলিতে অনেক লোককে দেখেছি যারা তাদের প্রিয়জনদের বাঁচানোর জন্য রক্তদানের অনুমতি দেওয়ার জন্য ডাক্তারদের কাছে ভিক্ষা করছিল, কিন্তু জোরপূর্বক পানিশূন্যতা এবং অনাহারের কারণে তারা রক্তদানের যোগ্য না হওয়ায় তাদের ফিরিয়ে দিতে হয়েছিল,” মাহমুদ বলেন। আল-শিফা হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকের প্রধান আমানি আবু ওউদা বলেন, বেশিরভাগ হবু দাতা যারা আসেন তারা অপুষ্টিতে ভুগছেন, যা রক্তদানের নিরাপত্তা এবং মানকে প্রভাবিত করে।

নতুন প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে সাম্প্রতিক মাসগুলিতে ইসরাইলী জোরপূর্বক উচ্ছেদের আদেশের পরেও গাজার মাত্র ৮.৬ শতাংশ ফসলি জমি এখনও অ্যাক্সেসযোগ্য। মাত্র ১.৫ শতাংশ অ্যাক্সেসযোগ্য এবং অক্ষত রয়েছে, এটি বলা হয়েছে।

ইসরাইলের অবরোধ চিকিৎসা সরবরাহ ও জ্বালানি পর্যন্ত বিস্তৃত : এদিকে, হামাস গাজায় দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে। “ আগামী আমরা শুক্রবার, শনিবার ও রবিবার শহর, রাজধানী এবং স্কোয়ারে এবং আগামী সমস্ত দিনগুলিতে ইহুদিবাদী ও মার্কিন দূতাবাসের সামনে মিছিল, বিক্ষোভ এবং বিক্ষোভের মাধ্যমে জনগণের চাপ অব্যাহত রাখার এবং বৃদ্ধি করার আহ্বান জানাচ্ছি,” হামাস এক বিবৃতিতে বলেছে। ইসরাইলের অবরোধ চিকিৎসা সরবরাহ এবং অত্যন্ত প্রয়োজনীয় জ্বালানি পর্যন্ত বিস্তৃত - সাম্প্রতিক মাসগুলিতে বেশ কয়েকটি চিকিৎসা সুবিধা বন্ধ করে দেওয়ার কারণে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের উপ-মুখপাত্র ফারহান হক সতর্ক করে বলেছেন যে গাজায় জ্বালানি প্রবেশের উপর ইসরাইলের অব্যাহত অবরোধ

যেভাবে রাজনৈতিক মারপ্যাচে বিশ্বাসঘাতকতার শিকার গাজা

সংগ্রাম ডেস্ক : ইসরাইলী মানবাধিকার সংস্থা বিতসেলেম অবশেষে গাজায় ইসরাইলের চলমান যুদ্ধকে গণহত্যা বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০২৫ সালের ২৭ জুলাই প্রকাশিত এই বিস্তারিত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ইসরাইলী সেনাবাহিনীর সামরিক অভিযানের উদ্দেশ্য, পরিকল্পিতভাবে বেসামরিক জীবন ধ্বংস এবং সরকার-পরিচালিত দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির চিত্র। তবে এত গুরুত্বপূর্ণ এক অভিযোগ আনতে সংস্থাটির প্রায় দুই বছর সময় নেওয়া নিয়ে উঠেছে নানা প্রশ্ন। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ধরনের দেরি শুধু দুঃখজনক নয় বরং এটি এমন এক রাজনীতি-প্রভাবিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের নমুনা, যা ইসরাইলী যুদ্ধাপরাধকে টিকিয়ে রাখতে অবদান রেখেছে। প্রতিবেদনের তাৎপর্য দ্বিগুণ এই কারণে যে, এটি কোনো বিদেশি সংগঠন নয় বরং ইসরাইলী একটি মানবাধিকার সংস্থার নিজ দেশের বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ অভিযোগ। বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমে এই প্রতিবেদন নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ দেখা গেলেও প্রশ্ন রয়ে গেছে। ফিলিস্তিনী সাংবাদিকদের বা মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বারবারের সতর্কতা ও প্রতিবেদন এতদিন ধরে কেন উপেক্ষিত হলো? গাজার ভিতর থেকে বারবার গণহত্যা, শিশুহত্যা, পরিকল্পিত দুর্ভিক্ষের খবর এলেও পশ্চিমা গণমাধ্যম ও একাডেমিক মহল তেমন মনোযোগ দেয়নি। ১৯৪৮ সালের তানতুরার হত্যাকাণ্ড, ১৯৮২ সালে লেবাননের সাবরা ও শাতিলায় গণহত্যা, কিংবা ২০০২ সালের জেনিনের ঘটনাও প্রথমে ফিলিস্তিনী ভাষ্যে অস্বীকৃত ছিল। বহু সময় পরে, কোনও ইসরাইলী বা পশ্চিমা প্রতিষ্ঠান তা ‘স্বীকার’ করলেই কেবল আন্তর্জাতিক গুরুত্ব পায়।

প্রশ্ন উঠছেবিতসেলেমের এই স্বীকৃতি পেতে এত দেরি হলো কেন? ইসরাইলী সংস্থাগুলোর রয়েছে হিব্রু ভাষা ও সামরিক তথ্যের বিশেষ প্রবেশাধিকার। ফলে গণহত্যার মতো বিষয় নির্ধারণে তাদের দেরি হওয়ার কথা নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এমন ইচ্ছাকৃত দেরিই আন্তর্জাতিক মহলের ‘নৈতিক দ্বিধা’র অংশ, যা গাজায় গণহত্যা বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছে। ২০২৪ সালের ২৬ জানুয়ারি, আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) দক্ষিণ আফ্রিকার করা অভিযোগে ইসরাইলের বিরুদ্ধে গণহত্যার ‘প্রাথমিক সম্ভাবনা’ মেনে নিলেও এখনো পর্যন্ত চূড়ান্ত কোনো রায় দেয়নি। বরং আদালত ইসরাইলকেই নিজেকে তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছে একটি কার্যত অবাস্তব প্রত্যাশা, যখন ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নিজেই গাজা ‘পরিষ্কারের’ ঘোষণা দিয়েছেন। একইভাবে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) গত বছর নভেম্বরে নেতানিয়াহু এবং তার তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলেও আজও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। উল্টোভাবে, মামলার প্রধান কৌঁসুলি করিম খান এখন মার্কিন প্রশাসন ও মিডিয়ার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু।

যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসওম্যান আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্তেজ কিংবা সেনেটর বার্নি স্যান্ডার্সÍযারা ‘বিপ্লবী রাজনীতি’র প্রতীক হিসেবে পরিচিত তারা পর্যন্ত গণহত্যা শব্দটি ব্যবহারে দ্বিধায় ছিলেন। মার্চ ২০২৪-এ কর্তেজ বলেছিলেন, গণহত্যা চলছে বলেই মনে হচ্ছে কিন্তু আমি এখনো শব্দটি ব্যবহার করতে প্রস্তুত নই। স্যান্ডার্স আরও এগিয়ে গিয়ে আইরল্যান্ডে এক বক্তব্যে বলেন, গণহত্যা শব্দটি আমাকে অস্বস্তিতে ফেলে। এমন ‘নৈতিক দ্বিধা’ আর ‘ভদ্র রাজনীতি’ হাজারো প্রাণহানির বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে গেছে। এটি শুধু নৈতিক ব্যর্থতা নয় বরং এই ধরণের দেরি ও দ্বিধাই ইসরাইলকে বিনাশয়ী যুদ্ধে উৎসাহিত করেছে। আন্তর্জাতিক আদালত, মানবাধিকার সংস্থা, রাজনীতি ও গণমাধ্যম যদি সময়মতো সঠিক অবস্থান নিত, তাহলে বহু প্রাণ বাঁচানো যেত।

ফিলিস্তিনিদের কষ্ট, অভিজ্ঞতা, ও সত্যকে ইসরাইলী বা পশ্চিমা অনুমোদনের অপেক্ষায় বসে থাকলে চলবে না। তাদের কণ্ঠই যেন মূল সত্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য ও সম্মানজনক হয় এটাই বর্তমান সময়ের ন্যূনতম নৈতিক দাবি। যারা এতদিন ‘অপেক্ষা’ করে থাকলেন, তারা ইতিহাসের আদালতে যেমন অভিযুক্ত হবেন, তেমনি গাজার অসহায় মা-বাবার আর্তনাদও তাদের ক্ষমা করবে না। যারা শেষ পর্যন্ত নিজের সন্তানকেও রক্ষা করতে পারলেন না বিশ্বের নিরবতা ও নিক্স্রীয়তার কারণে। এই প্রতিবেদন আমাদের জন্য একটি কঠিন আয়নার মতো। যেখানে আমরা নিজের বিবেক ও ভূমিকা দেখছি। সময় এসেছে, নিরবতা ভেঙে ফেলার। এখনো দেরি হয়নি কিন্তু সময় ফুরিয়ে আসছে।