আফগানিস্তানে ভয়াবহ ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮১২ জনে। আহত হয়েছেন আরও কমপক্ষে ২ হাজার ৮১৭ জন। গতকাল এক সাংবাদিক সম্মেলনে এ তথ্য জানান দেশটির সরকারপক্ষের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ।
জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে লিখেছেন, ‘স্থানীয় প্রশাসন ও বাসিন্দারা ক্ষতিগ্রস্তদের উদ্ধারে কাজ করছেন। রাজধানীসহ আশপাশের প্রদেশগুলো থেকেও সহায়তা দল ঘটনাস্থলে পৌঁছাচ্ছে।’
মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ওইদিন আফগানিস্তানের হিন্দুকুশ পর্বতমালায় ৬ দশমিক ২ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল আসাদাবাদ শহর থেকে প্রায় ২৭ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে।
শক্তিশালী কম্পনে বহু গ্রাম সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। পাহাড়ধসে একাধিক সড়ক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দুর্গম এলাকায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এর ফলে উদ্ধারকাজ ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
আফগানিস্তান বারবার ভয়াবহ ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে। হিন্দুকুশ পর্বতমালা ঘিরে থাকা এই দেশটি পৃথিবীর অন্যতম ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল। বিসিসি, রয়টার্স।
টেকটোনিক ফল্ট লাইনের অবস্থান
আফগানিস্তান দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্য এশিয়ার মাঝামাঝি এমন এক অঞ্চলে অবস্থিত, যেখানে ভারতীয় প্লেট ও ইউরেশীয় প্লেট একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা খায়। এই চাপের কারণেই হিমালয় ও হিন্দুকুশ পর্বতমালা তৈরি হয়েছে।
হিন্দুকুশ পর্বতমালা
আফগানিস্তানের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, বিশেষত হিন্দুকুশ পর্বতমালা, পৃথিবীর অন্যতম ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। এখানে প্রায়ই ভূগর্ভে প্লেটের সরে যাওয়া বা ধাক্কার ফলে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়।
শ্যালো বা অগভীর ভূমিকম্প
আফগানিস্তানে ভূমিকম্পগুলো প্রায়ই ভূগর্ভের অগভীর স্তরে হয়। এর ফলে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা অনেক বেশি হয়, কারণ কম্পন সরাসরি মাটির উপরিভাগে ছড়িয়ে পড়ে।
দুর্বল অবকাঠামো
ভূমিকম্প শুধু প্রাকৃতিক নয়, মানবিক দিক থেকেও ক্ষতির মাত্রা বাড়ে। আফগানিস্তানে ভবন, গ্রাম ও অবকাঠামো অনেকটাই দুর্বল; তাই মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পও ব্যাপক প্রাণহানি ও ধ্বংস ডেকে আনে।
প্রতি পাঁচ মিনিটে একজন রোগী হাসপাতালে আসছে: আফগানি ডাক্তার
সারা রাত চোখের পাতা বুজতে পারেননি ডা. মুলদাদ। কুনার প্রদেশের রাজধানী আসাদাবাদে প্রাদেশিক হাসপাতালের প্রধানের দায়িত্বে আছেন তিনি। রোববার (৩১ আগস্ট) রাতে ভূমিকম্পে আহত হয়ে হাসপাতালে আসা রোগীদের চিকিৎসার জন্য সহমর্কীদের নেতৃত্ব দিতে ব্যস্ত ছিলেন তিনি।
ডা. মুলদাদ বিবিসিকে জানান, তারা ‘প্রতি পাঁচ মিনিটে একজন রোগী’ ভর্তি করছেন এবং পুরো হাসপাতাল আহত ব্যক্তিতে পরিপূর্ণ।
তার ভাষ্য, গত কয়েক ঘন্টায় ১৮৮ জন আহত ব্যক্তিকে - যার মধ্যে নারী ও শিশুও রয়েছে - হাসপাতালে আনা হয়েছে। বিছানায় জায়গা শেষ হওয়ায় রোগীদের মাটিতে শুয়ে থাকতে হচ্ছে।
ডা. মুলাদাদ পরিস্থিতিকে এমন একটি ‘সংকট’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন, যা তিনি কখনও আশা করেননি। সেই সঙ্গে তিনি হাসপাতালে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন।
বিবিসি আরও বলছে, প্রায় ২৫০ জন আহত ব্যক্তিকে পার্শ্ববর্তী নাঙ্গাহার প্রদেশের প্রধান হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
ডা. মুলাদাদ বলেন, এখন পর্যন্ত চারটি মৃতদেহ তার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ডজন ডজন মৃতদেহ অন্যান্য স্থানীয় ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তান সীমান্তের কাছে ৬ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। রোববার (৩১ আগস্ট) রাতে আঘাত হানা এ ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পাকিস্তান সীমান্তবর্তী কুনার প্রদেশের নোরগাল জেলা। এতে সবশেষ ৬২২ জন নিহতের খবর পাওয়া গেছে।
আফগানিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিশ্চিত করেছে, ভূমিকম্পে কমপক্ষে ৬২২ জন নিহত এবং ১,৫০০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন।
এক রাতে ১৩ পরাঘাত নুরি বললেন, এমন শক্তিশালী ভূমিকম্প জীবনে দেখিনি
আফগানিস্তানে ভূমিকম্পকবলিত প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকাগুলোয় জরুরি উদ্ধার তৎপরতায় সহায়তার জন্য সংশ্লিষ্ট ত্রাণ সংস্থাগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন দেশটির ক্ষমতাসীন তালেবান সরকারের কর্মকর্তারা।
কুনার ও নানগারহার প্রদেশের বেশ কয়েকটি এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, তাঁরা গতকাল রাতে অনেকগুলো পরাঘাত অনুভব করেছেন।
নানগারহার প্রদেশের বাসিন্দা পোলাদ নুরি নামে ২৮ বছরের একজন বলেন, তিনি ১৩টি পরাঘাত অনুভব করতে পেরেছেন। এ কারণে মধ্যরাতে তিনি ঘর ছেড়ে সড়কে বেরিয়ে এসেছিলেন। তাঁর মতো কয়েক শ মানুষ রাস্তায় বেরিয়েছিলেন। পোলাদ নুরি বলেন, ‘এমন শক্তিশালী ভূমিকম্প আমি আমার জীবনে আগে দেখিনি।’
কুনার প্রদেশের পুলিশপ্রধান বিবিসিকে বলেন, ভূমিকম্পের পরাঘাত ও বন্যার জেরে আক্রান্ত এলাকাগুলোর অনেক জায়গায় ভূমিধস হয়েছে। এতে চলাচলের সড়ক বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণে শুধু আকাশপথে উদ্ধার অভিযান চালানো সম্ভব হবে বলেও জানান তিনি।
তালেবান কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁদের সম্পদ সীমিত। তাই উদ্ধারকাজে সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তা দরকার। বিশেষ করে ভূমিকম্পকবলিত এলাকাগুলোয় পৌঁছানোর জন্য হেলিকপ্টার প্রয়োজন।
কুনার প্রদেশের দুটি সূত্র জানায়, স্থানীয় মাজার উপত্যকায় আজ সোমবার ভোরে অন্তত চারটি হেলিকপ্টার চিকিৎসাকর্মীদের নিয়ে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের তথ্য অনুযায়ী, স্থানীয় সময় গতকাল রোববার রাত ১১টা ৪৭ মিনিটে ভূমিকম্প হয়। এর উৎপত্তিস্থল ছিল ভূপৃষ্ঠের আট কিলোমিটার গভীরে। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৬।
এটা এতটাই তীব্র ছিল যে ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে বেশ কয়েক সেকেন্ড কম্পন টের পাওয়া গেছে। প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দূরে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে কম্পন অনুভূত হয়েছে।
কুনারে আঘাত হানা ভূমিকম্পে এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৬২২ জনে পৌঁছেছে। সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের বরাতে এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
অবশ্য তালেবান–শাসিত দেশটির রাষ্ট্র পরিচালিত সংবাদমাধ্যম রেডিও-টেলিভিশন অব আফগানিস্তানের (আরটিএ) বরাত দিয়ে ৫০০ জন নিহত হওয়ার তথ্য জানিয়েছে দোহাভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভূমিকম্পে আহত মানুষের সংখ্যা প্রায় এক হাজার।