ব্লুমবার্গ, দ্য ফিনান্সিয়াল টাইমস,মিডল ইস্ট আই, রয়টার্স: সৌদি আরব ‘দ্য লাইন’ নামের তাদের ভবিষ্যতের শহর গড়ার পরিকল্পনা নতুন করে যাচাই–বাছাই করতে কয়েকটি পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দিয়েছে। ১৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই শহরটি লোহিত সাগরের উপকূলে তৈরি হওয়ার কথা রয়েছে। এটি সৌদি আরবের বৃহৎ প্রকল্প ‘নিওম’-এর প্রধান একটি অংশ। ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সৌদি সরকারের বিনিয়োগ তহবিল (পিআইএফ) এই পরামর্শদাতাদের বলেছে, গাড়িমুক্ত প্রকল্পটি বাস্তবায়নযোগ্য কি না, তারা যেন তা খতিয়ে দেখে।

সৌদি সরকারের এই নতুন উদ্যোগ ‘দ্য লাইন’-এর ভবিষ্যৎ নিয়ে আরও সন্দেহ তৈরি করতে পারে। এর আগে গত এপ্রিলে নিওম প্রকল্পের সিইও নিজেই পুরো মেগা প্রকল্প নিয়ে ‘বড় ধরনের পর্যালোচনা’ শুরু করেছেন। নিওম প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে বিলাসবহুল হোটেল, স্কি রিসোর্ট এবং ‘দ্য লাইন’ শহর—এগুলো সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ‘ভিশন ২০৩০’ পরিকল্পনার অংশ, যার লক্ষ্য হলো দেশটির অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যময় করা এবং তেলভিত্তিক আয়নির্ভরতা কমানো। ২০২৪ সালেই সৌদি সরকার ‘দ্য লাইন’ প্রকল্প ছোট করে আনার সিদ্ধান্ত নেয়। শুরুতে যেখানে ২০৩০ সালের মধ্যে ১৫ লাখ মানুষ বসবাস করবেন বলা হয়েছিল। এখন ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে মাত্র ৩ লাখ মানুষ সেখানে থাকবেন, তা ছাড়া শহরটির মধ্যে মাত্র ২ দশমিক ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ অংশই তখন পর্যন্ত তৈরি হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ২০২১ সালে অনেক উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে এই প্রকল্প নির্মাণের ঘোষণা দেন। এক ভিডিওতে ইতিহাসের বড় বড় আবিষ্কার—যেমন চাঁদে অবতরণ ও ইন্টারনেটের আবির্ভাব—এসব দেখিয়ে প্রশ্ন করা হয়, ‘এরপর কী?’ ওই ভিডিওতে দেখা যায়, তখন যুবরাজ টিভিতে এসে উত্তর দেন ‘দ্য লাইন’।

যুবরাজ বলেন, শহরটি হবে ১৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ, সেখানে থাকবে না কোনো গাড়ি, রাস্তা কিংবা কার্বন নিঃসরণ। ১০ লাখ মানুষ পাঁচ মিনিট হাঁটাপথের মধ্যেই বাসা, শিক্ষা ও বিনোদনের সব সুবিধা পাবেন। যুবরাজ আরও বলেছিলেন, শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে মাত্র ২০ মিনিট লাগবে, অর্থাৎ সেখানে অত্যন্ত দ্রুতগতির ট্রেনব্যবস্থা চালু থাকবে। ওই সময় সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এই শহর সৌদি অর্থনীতিতে ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার যোগ করবে এবং ৩ লাখ ৮০ হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে।

সৌদি আরব সরকার সমাজে কিছু উদার সংস্কার এনেছে। যেমন বিদেশিদের জন্য সম্পত্তি কেনার অনুমতি। আবার অন্যদিকে সরকারবিরোধীদের ওপর দমন–পীড়নও চালিয়ে যাচ্ছে। তবে সৌদি আরবে এই ধরনের মেগা প্রকল্পগুলো বারবার ব্যর্থতার মুখে পড়েছে। কারণ, খরচ খুব বেশি, অন্যদিকে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম পড়ে যাচ্ছে। ২০২৫ সালের বাজেট অনুযায়ী, এখনো সৌদি আরবের রাজস্ব আয়ের প্রায় ৬১ শতাংশই আসে তেল বিক্রি থেকে। এ বছর বেশির ভাগ সময় ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম (ব্রেন্ট ক্রুড) ৭০ ডলারের নিচে ছিল।

সৌদি আরব অনেক বছর ধরেই রাশিয়ার সঙ্গে মিলে ওপেক+ জোটের মাধ্যমে তেল সরবরাহ সীমিত রাখার পক্ষে ছিল। কিন্তু অন্যান্য দেশ যেমন ইরাক, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাজাখস্তানের মতো দেশ উৎপাদন বাড়িয়ে দিয়েছে। গত এপ্রিল মাসে সৌদি আরব হঠাৎ করে ওপেক+মিলে জ্বালানি তেলের উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়। বিশ্লেষকদের মতে, ‘চুক্তি ভঙ্গকারী’ দেশগুলোকে শাস্তি দেওয়ার কৌশল হিসেবে সৌদি আরব এই কাজ করেছিল। এর ফলে তেলের দাম আরও কমে গেছে। গত এপ্রিলেই গোল্ডম্যান স্যাকস মক্কেলদের উদ্দেশে এক বার্তায় বলেছে, সৌদি আরব বড় বাজেট ঘাটতির মুখে পড়তে যাচ্ছে। এ কারণে তাদের আরও মেগা প্রকল্প কমিয়ে আনা হতে পারে। এর মধ্যে নিওম প্রকল্পেও সমস্যা দেখা দিয়েছে। এর প্রধান নির্মাণ ব্যবস্থাপক নাধমি আল-নাসের ২০১৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত কাজ করেছেন। তিনি ২০২৪ সালের নভেম্বরে পদত্যাগ করেন।

নাধমি দায়িত্ব পালনকালে কঠোরতা দেখিয়ে নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। ওই সময় তিনি বলেছিলেন, ‘আমি সবাইকে দাসের মতো খাটাই, কেউ মারা গেলে আমি আনন্দ করি। এভাবেই আমি আমার প্রকল্প বাস্তবায়ন করি।’ ২০২৪ সালের শেষের দিকে আরও দুজন বিদেশি কর্মকর্তা নিওম ছেড়ে চলে যান। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছ, ওই দুই কর্মকর্তা একজন ইসলাম ধর্ম নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন, অশ্লীল রসিকতা করতেন এবং উপসাগরীয় নারীদের ‘হিজড়া’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন। গত নভেম্বরে আয়মান আল-মুদাইফারকে নিওমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর আগে তিনি সৌদি আরবের প্রায় এক লাখ কোটি ডলারের বিনিয়োগ তহবিলের (পিআইএফ) রিয়েল এস্টেট বিভাগ তদারকি করছিলেন।