এপি: শান্তির প্রথম পদক্ষেপই সবসময় সবচেয়ে কঠিন বললেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। মিসরে গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে আয়োজিত সম্মেলনে বিশ্বনেতাদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে এমন মন্তব্য করেন তিনি। ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে তার মধ্যস্থতায় হওয়া যুদ্ধবিরতিকে তিনি গাজা যুদ্ধের অবসান ও ধ্বংসপ্রাপ্ত ভূখণ্ড পুনর্গঠনের সূচনা হিসেবে ঘোষণা করেন।
ট্রাম্প আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে সবচেয়ে কঠিন পর্ব শেষ হয়েছে। বলেন, ‘পুনর্গঠনই হয়তো সবচেয়ে সহজ অংশ হবে। আমি মনে করি আমরা কঠিন অংশের অনেকটা সম্পন্ন করেছি। কারণ পরের ধাপগুলো স্বাভাবিকভাবে একত্রে আসবে।’ তবে অন্যরা আসন্ন জটিলতা নিয়ে ছিলেন আরও সতর্ক। কারণ শান্তি পরিকল্পনার বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখনও অনির্ধারিত। বিস্তারিত শর্তাবলি নিয়ে আলোচনা ও সমঝোতা না হলে এই প্রক্রিয়া এগোবে না এবং সংঘাত ফের শুরু হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যাবে। দীর্ঘমেয়াদি শান্তি, স্থিতিশীলতা ও পুনর্গঠনের পথ তাই হবে এক কঠিন ও দুর্গম যাত্রা। মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র (সিএসআইএস)-এর পরিচালক মোনা ইয়াকুবিয়ান বলেন, শান্তির সূচনা কোথাও না কোথাও থেকে করতে হয়। এটিকে তিনি ‘একটি গুরুত্বপূর্ণ ও আনন্দময় মুহূর্ত’ বলে অভিহিত করেন। তবে ইয়াকুবিয়ান সতর্ক করে বলেন, ‘দুঃখজনকভাবে, আমি মনে করি সামনে ব্যর্থ হওয়ার বেশ কিছু সম্ভাব্য জায়গা রয়ে গেছে।’
অমীমাংসিত বহু বিষয়: প্রকাশ্যে উপস্থাপিত শান্তি পরিকল্পনায় এখনও বহু প্রশ্নের উত্তর অনুপস্থিত। হামাস কবে এবং কীভাবে নিরস্ত্র হবে, তাদের অস্ত্র কোথায় যাবে তা স্পষ্ট নয়। ইসরাইল কীভাবে গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার করবে, তাও অজানা। গাজায় একটি নতুন নিরাপত্তা বাহিনী গঠনের কথা বলা হয়েছে, যা অন্যান্য দেশের সেনাদের নিয়ে হবে। কিন্তু কোন দেশ সেনা পাঠাবে, তাদের কীভাবে ব্যবহার করা হবে বা তারা প্রতিরোধের মুখে পড়লে কী হবে,তা নির্ধারিত নয়। এছাড়া গাজার জন্য গঠিত হতে যাওয়া অস্থায়ী প্রশাসনিক বোর্ড কোথায় থাকবে, কারা এতে থাকবে, জনগণ এর প্রতি কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে—তাও অজানা। বিশ্লেষকদের মতে, এসব জটিল বিষয় সমাধান করতে এবং নতুন করে যুদ্ধ শুরু ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য মধ্যস্থতাকারী দেশগুলোর ক্রমাগত চাপ ও মনোযোগ অব্যাহত রাখতে হবে। এর সবকিছুই ঘটছে দীর্ঘ সংঘাতের ইতিহাস, পারস্পরিক অবিশ্বাস ও সম্ভাব্য ফিলিস্তিনী রাষ্ট্র নিয়ে চলমান অনিশ্চয়তার পটভূমিতে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর যে যুদ্ধ শুরু হয়, তাতে এখন পর্যন্ত দুটি যুদ্ধবিরতি এলেও তা শুধুমাত্র সাময়িক বিরতি ও বন্দি বিনিময়ে সীমিত ছিল। যুদ্ধোত্তর ব্যবস্থাপনা নিয়ে কোনও আলোচনাই শুরু হয়নি।
এই অবস্থায় ট্রাম্পের পুনর্র্নিবাচনের পর, তিনি ইসরাইল ও আরব মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে আলোচনাকে এগিয়ে নিয়ে যান। ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যস্থতায় হওয়া শান্তি প্রস্তাবে এখনও দুই বড় বিতর্কিত বিষয়—ইসরাইলের প্রত্যাহারের পরিধি ও হামাসের ক্ষমতা হ্রাসের মাত্রা—স্পষ্ট নয়। বর্তমানে ইসরাইল এখনও গাজার প্রায় অর্ধেক অংশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, তিনি ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনায় ‘অঙ্গীকারবদ্ধ’। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হয়েছে এমন ঘোষণা দেননি। গত দুই বছরে তিনি বারবার হামাসের বিরুদ্ধে ‘সম্পূর্ণ বিজয়’ অর্জনের অঙ্গীকার করেছিলেন। দুই বছরের যুদ্ধে দুর্বল হলেও হামাস এখনও গাজায় প্রভাবশালী। এছাড়া এখনও অনিশ্চিত ‘বোর্ড অব পিস’ বা শান্তি বোর্ডের নেতৃত্ব কারা দেবেন। ট্রাম্প বলেছেন, তিনি নিজেই এটি পরিচালনা করবেন। যদিও ঘোষণায় বলা হয়েছিল, সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার এই বোর্ডে থাকবেন।
ধ্বংসস্তূপে পড়ে থাকা গাজা: সব আলোচনার পটভূমিতে রয়েছে এক ভয়াবহ বাস্তবতা—গাজা সম্পূর্ণ পুনর্বাসনের প্রয়োজনীয়তা এবং অসীম মানবিক সংকট। গাজার ২০ লাখেরও বেশি জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ মানুষ বাস্তুচ্যুত। স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, ঘরবাড়ি ধ্বংস, কৃষিজমি উজাড়, ক্ষুধা সর্বত্র। এই তীব্র মানবিক চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাও গড়ে তুলতে হবে। বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনুমান অনুযায়ী, গাজা পুনর্গঠনে ব্যয় হবে প্রায় ৫৩ বিলিয়ন ডলার। ধনী আরব দেশগুলো এর বড় অংশে অর্থায়ন করতে পারে। তবে তারা চায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পথে নিশ্চয়তা ও যুদ্ধ পুনরায় শুরু না হওয়ার প্রতিশ্রুতি।
তবে সবচেয়ে বড় বাধা হলো ফিলিস্তিনী রাষ্ট্র গঠন: ট্রাম্পের পরিকল্পনায় এটি কেবল দীর্ঘমেয়াদি রূপান্তরকালীন সময়ের পর এবং ফিলিস্তিনী কর্তৃপক্ষের সংস্কার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে সম্ভাবনা হিসেবে রাখা হয়েছে যা নেতানিয়াহু ও তার মিত্ররা দৃঢ়ভাবে বিরোধিতা করেন। ইয়াকুবিয়ান বলেন, ট্রাম্প প্রশাসনের চুক্তিটি ইচ্ছাকৃতভাবেই অস্পষ্ট ছিল ফিলিস্তিনী রাষ্ট্র বিষয়ে। এটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে ফিলিস্তিনী ও তাদের আরব মিত্রদের ন্যূনতম গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করা যায়। তবে দুই-রাষ্ট্র সমাধান শব্দটি এড়িয়ে যাওয়া হয়—যা ইসরাইলের জন্য এখনো অগ্রহণযোগ্য।
স্বাধীন রাষ্ট্র প্রশ্নে ট্রাম্পের দ্বিধা: গত সোমবার রাতে যুক্তরাষ্ট্রে ফেরার পথে সাংবাদিকদের প্রশ্নে ট্রাম্প বলেন, ‘অনেকেই এক-রাষ্ট্র সমাধান পছন্দ করে, কেউ দুই-রাষ্ট্র সমাধান চায়। দেখা যাক কী হয়।’ তিনি আরও বলেন, শেষ পর্যন্ত আমি ঠিক করব কী সঠিক, তবে সেটা হবে অন্য রাষ্ট্র ও দেশের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে। জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক উপ-রাষ্ট্রদূত রবার্ট উড বাইডেন প্রশাসনের সময় একাধিক যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, পরবর্তী ধাপটি খুবই কঠিন হবে এবং এতে বিশাল পরিমাণ কাজের প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, ‘এই প্রক্রিয়াটি কার্যকর করতে হলে প্রশাসনকে বিশেষত সর্বোচ্চ পর্যায়ে সম্পৃক্ত থাকতে হবে। আজকের দিনটি ভালো, কিন্তু যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি।’
গাজার সব সীমান্ত ক্রসিং খুলে দেওয়ার আহ্বান জাতিসংঘ ও রেডক্রসের: জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি গাজায় সব সীমান্ত ক্রসিং খুলে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে, যাতে যুদ্ধবিধ্বস্ত ফিলিস্তিনী ভূখণ্ডে জরুরি মানবিক সহায়তা পৌঁছানো যায়। রেডক্রসের মুখপাত্র ক্রিশ্চিয়ান কারদন জেনেভায় সাংবাদিকদের বলেন, মানবিক সহায়তাকর্মীদের, বিশেষ করে রেডক্রসের পক্ষ থেকে আমরা যে আহ্বান জানাচ্ছি, তা হলো, বৃহৎ চাহিদার কারণে সব প্রবেশপথ খোলা থাকা নিশ্চিত করতে হবে। জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সংস্থা ওসিএইচএর মুখপাত্র ইয়েন্স লারকে বলেন, আমাদের সব সীমান্তপথ খোলা প্রয়োজন। ইসরাইল ও জিম্মি পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে—হামাস অস্ত্রবিরতির শর্ত ভঙ্গ করছে, কারণ তারা এখনও ২৪ জন নিহত জিম্মির মরদেহ ফেরত দেয়নি। এদিকে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান বলেছেন, নতুন যুদ্ধবিরতি চুক্তির আওতায় তিনি গাজা পুনর্গঠনের জন্য গালফ দেশগুলো, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সহায়তা চেয়ে উদ্যোগ নেবেন।
মিশরের শার্ম আল-শেখে গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে অনুষ্ঠিত বৈশ্বিক সম্মেলন শেষে দেশে ফেরার পথে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, পশ্চিমা দেশগুলোর ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্তকে দুই-রাষ্ট্র সমাধানের ভিত্তি হিসেবে দেখা উচিত। তুর্কি প্রেসিডেন্টের কার্যালয় থেকে প্রকাশিত বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, এরদোগান বিশ্বাস করেন গাজার পুনর্গঠনের প্রকল্পগুলোর অর্থায়ন দ্রুত পাওয়া যাবে।