গাজায় ২৪ ঘণ্টায় ৪৬ ফিলিস্তিনীকে হত্যা করেছে ইসরাইল। গত ১৮ মার্চ যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের পর থেকে এক হাজার ৩০৯ ফিলিস্তিনীকে হত্যা করেছে দেশটি। আহত করা হয়েছে তিন হাজার ১৮৪ জনকে। উপত্যকাটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে এই পর্যন্ত ৫০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনীর প্রাণ কেড়ে নিয়েছে ইসরাইলী বাহিনী। দেশটির বোমা ও ড্রোন হামলায় এ সময়ে আহত হয়েছেন অন্তত এক লাখ ১৫ হাজার ২২৫ মানুষ।
ভোর থেকে গাজায় হামলা চালিয়ে ১৩ জনকে হত্যা করা হয়েছে। আর খান ইউনিসে নয় জনকে হত্যা করা হয়েছে। গাজার জাবালিয়া এলাকায় ইসরাইলের আর্টিলারি শেলের আঘাতে দুই ফিলিস্তিনীর মৃত্যু হয়েছে। রাতভর ইসরাইলী ড্রোন হামলায় গাজা সিটিতে অন্তত ২১ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে এক বাবা ও মেয়েও রয়েছেন। গাজার দক্ষিণাঞ্চলে একটি তাঁবুতে বিমান হামলায় কমপক্ষে ছয়জন নিহত হয়েছেন। ইসরাইলী হামলায় গাজায় ১৫ চিকিৎসক হত্যার নতুন একটি ফুটেজে ভাইরাল হয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, ওই গাড়িতে স্পষ্ট চিহ্ন থাকার পরও গুলী চালানো হয়েছে। আল-জাজিরা, মিডল ইস্টআই, প্যালেস্টাইন টুডে ও এপি/রয়টার্স
গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের অবিরাম বোমাবর্ষণ ও হামলার মধ্যে ফিলিস্তিনীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেষ বার্তা ও বিদায় চিঠি লিখে রাখছেন। তাদের আশঙ্কা, এবার তারা বাঁচবেন না। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরাইলের হামলা শুরুর পর থেকেই গাজাবাসী একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে, ইসরাইলের আক্রমণ ও তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের কথা বিশ্ববাসীকে জানাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে আসছেন। কিন্তু গত ২৪ ঘণ্টায় হতাশা ও মৃত্যুভয় নিয়ে লেখা পোস্টের সংখ্যা বেড়েছে। গত বৃহস্পতিবার ইসরাইলের হামলায় অন্তত ১১২ ফিলিস্তিনী নিহত হয়েছেন। গত ১৮ মার্চ থেকে ইসরাইলের হামলা পুনরায় শুরু হওয়ার পর এটিই সবচেয়ে ভয়াবহ দিন।
গাজার এক নারী নূরের পোস্ট করা ভিডিওতে দেখা গেছে, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া একটি এলাকায় পাশের ভবনে ইসরাইলী হামলা হচ্ছে। ভিডিওটির পটভূমিতে এক নারীর কান্নার শোনা যায়। পোস্টের ক্যাপশনে লেখা, ‘এবার মনে হচ্ছে আমরা বাঁচব না...’। দক্ষিণ গাজার রাফাহ থেকে সাংবাদিক আবদুল্লাহ আলাত্তার শুক্রবার সকালের পোস্টে লিখেছেন, ‘এবার আমরা টিকতে পারব না বলে মনে হচ্ছে।’ এটি ব্যাপকভাবে শেয়ার হয়েছে। দেইর আল-বালাহর ফুটবল সাংবাদিক আবুবকর আমেদ লিখেছেন, ‘গাজাবাসী জানে, বিশ্ব তাদের নিরাশ করেছে। তাই তাদের হত্যা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।’
অনেক ব্যবহারকারী বিশ্ববাসী ও নেতৃবৃন্দকে গাজাবাসীর পক্ষে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ইসরাইলের অবরোধের কারণে গাজাবাসী শুধু বোমাবর্ষণই নয়, খাদ্য সংকটেরও শিকার হচ্ছেন। এক ফিলিস্তিনী লিখেছেন, ‘মাথার ওপর বোমা, নিচে ক্ষুধা গাজা আজ ধুঁকছে। আর কত দিন আমরা এভাবে টিকে থাকব? বিশ্বকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে!’ ইসরাইলের যুদ্ধ এখনও তার মিত্রদের সমর্থন ও অর্থায়নে চলছে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের। গত মার্চে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন কংগ্রেসের স্বাভাবিক পর্যালোচনা ছাড়াই ইসরাইলকে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার অস্ত্র বিক্রি অনুমোদন করে। বৃহস্পতিবার স্বতন্ত্র সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স ট্রাম্প প্রশাসন কর্তৃক অনুমোদিত ৮.৮ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি বন্ধের প্রস্তাব দেন। কিন্তু মাত্র ১৫ সিনেটর (যাদের মধ্যে টিম কেইন ও সাবেক প্রেসিডেন্টপ্রার্থী এলিজাবেথ ওয়ারেনও রয়েছেন) সমর্থন করায় প্রস্তাবটি ব্যর্থ হয়।
বিদায় বার্তা ও আত্মশ্রদ্ধাঞ্জলি
অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মৃত্যুর আগে বিদায় বার্তা ও প্রার্থনা পোস্ট করছেন। গাজার লেখক ও ফার্মাসিস্ট ওমর হামাদ বৃহস্পতিবার রাতে এক্স (টুইটার)-এ লিখেছেন, তার লেখা কোনও পরিবর্তন আনতে পারেনি। তার লেখা, ‘প্রথমে উৎসাহী ছিলাম, যা লিখতাম সব শেয়ার করতাম। কিন্তু কী দেখলে বা পড়লে তোমরা জাগ্রত হবে তা আমি জানি না। আমাদের জন্য নয়, তোমাদের বিবেকের জন্য, যাতে ঘুমোতে গিয়ে তোমাদের বিবেক কাঁদে না।’
৩ এপ্রিল আরেক পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘গোটা গণহত্যার মধ্যে এত কাছে থেকে কখনও মৃত্যুকে অনুভব করিনি, যতটা করছি এখন।’ ইউরোপীয় হাসপাতাল ও আল-আকসা হাসপাতালের চিকিৎসক হামজা আলশারিফ লিখেছেন, ‘গাজার সর্বত্র বোমাবর্ষণ তীব্র হচ্ছে, রক্তের ছোঁয়া সবখানে।’ ১৮ মার্চ থেকে তার প্রোফাইলে পিন করা পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘আমি যদি মারা যাই, আমি শুধু একটি সংখ্যা নই-আমি একা এক গ্রহ, আমার স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা ছিল। আমাকে তোমাদের দোয়া থেকে ভুলো না, আমার কথা বলতে থাকো।’
গত মাসে ইসরাইলের মিসাইলে আল জাজিরার ২৩ বছরী সাংবাদিক হোসাম শাবাত নিহত হন। এর কয়েক ঘণ্টা আগে প্যালেস্টাইন টুডের সাংবাদিক মোহাম্মদ মানসুরের বাড়িতে হামলা চালিয়ে তাকে, তার স্ত্রী ও ছেলেকে হত্যা করা হয়। হোসামের মৃত্যুর পর তার সহকর্মীরা তার আগে থেকে লেখা একটি বার্তা শেয়ার করেন: ‘আপনি যদি এটি পড়েন, তাহলে আমি ইসরাইলী বাহিনীর টার্গেটে পরিণত হয়ে নিহত হয়েছি।’
এই আত্মশ্রদ্ধাঞ্জলি স্মরণ করিয়ে দেয় প্রখ্যাত ফিলিস্তিনী কবি ও শিক্ষাবিদ রিফাত আলারীর কথা, যিনি গত ডিসেম্বরে ইসরাইলী হামলায় নিহত হন। তার ‘যদি আমাকে মরতেই হয়’ কবিতাটি ইসরাইলের যুদ্ধের মধ্যে প্রতিবাদ ও আশার প্রতীক হয়ে উঠেছিল।
গাজার পরিস্থিতি অত্যন্ত খারাপ
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় নির্বিচার হামলা অব্যাহত রেখেছে দখলদার ইসরাইল। সঙ্গে সেখানে এক মাস ধরে পূর্ণ অবরোধ আরোপ করে রেখেছে দখলদাররা। এতে সেখানকার পরিস্থিতি ‘দমবন্ধকর’ হয়ে পড়েছে। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম গাজার পরিস্থিতি দিন দিন কঠিন হচ্ছে। সাংবাদিক হিন্দ খোদারি গাজার দের এল-বালাহ থেকে বলেছেন, “এখানে এখনো সকাল। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি, ফিলিস্তিনীরা যে কোনো খাবারের সন্ধান করছে যেন তারা তাদের পরিবারকে খাওয়াতে পারে। গত এক মাস ধরে গাজায় একটি ট্রাকও প্রবেশ করেনি- কোনো খাবার না, বাণিজ্যিক কোনো কিছু না, কোনো জ্বালানি না, রান্নার কোনো গ্যাস না, এমনকি ওষুধও না। এমনকি কোনো তাঁবু বা আশ্রয় উপকরণও না।”
“এমন অবস্থায় এখানকার পরিস্থিতি দমবন্ধকর হয়ে পড়েছে। আমরা দেখছি অনেক মানুষ এক গ্যালন স্বাস্থ্যকর পানির জন্য লাইন ধরছেন। আমরা দেখছি ফিলিস্তিনীরা গরম খাবারের জন্য বিভিন্ন কিচেনে লাইন ধরছেন। কিন্তু এই কিচেনগুলোর রসদও ফুরিয়ে যাওয়ায় আগামী কয়েকদিনের মধ্যে তাদের সেবা বন্ধ হয়ে যাবে বলে আমরা ধারণা করছি।” যোগ করেন হিন্দ খোদারি।
এছাড়া গাজার স্বাস্থ্য সেবা খাতও বেশ নাজুক হয়ে পড়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, এত মানুষ আহত হয়েছেন যে হাসপাতালগুলো উপচে পড়ছে। এছাড়া সাধারণ মানুষকে যে চিকিৎসা দেওয়া হবে সেটির সুযোগ নেই। কারণ চিকিৎসা সরঞ্জামেরই ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
১২ ঘণ্টায় দখলদাররা খান ইউনিস এলাকা লক্ষ্য করে সবচেয়ে বেশি হামলা চালিয়েছে। সেখানে অন্তত ১৯ জন নিহত হয়েছেন। যাদের মধ্যে নারী ও শিশু রয়েছেন। ইসরায়েলি সেনারা খান ইউনিসের কয়েকটি আবাসিক ভবন ও অস্থায়ী তাঁবুতে হামলা চালিয়েছে। এতে অনেক মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়েছেন। যারা সেখান থেকেই বাঁচার আকুতি জানাচ্ছেন। ধ্বংসস্তূপে মানুষ আটকে থাকায় মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। অপরদিকে সবমিলিয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় অবরুদ্ধ এ উপত্যকায় ৪৬ জন নিহত হয়েছেন।
রাফাহকে বিচ্ছিন্ন করতে নতুন করিডোর ইসরাইলের
দখলদার ইসরাইলী সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তারা দক্ষিণ গাজায় একটি নতুন সামরিক করিডোর গড়ে তোলার কাজ শুরু করেছে। এই করিডোরটির নাম ‘মোরাগ করিডোর’। করিডোরটির নাম ২০০৫ সালে উৎখাত হওয়া একটি অবৈধ ইহুদি বসতি ‘মোরাগ’-এর নামানুসারে রাখা হয়েছে। এই করিডোরটির কাজ শেষ হলে এটি রাফাহ শহরকে গাজার বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। গাজার মধ্যাঞ্চল দেইর আল-বালাহ থেকে আল জাজিরার সাংবাদিক হিন্দ খুদারি জানিয়েছেন, রাফাহ ও খান ইউনুসের মধ্যবর্তী এলাকায় ইসরাইলী সেনারা রাফাহকে পুরো গাজা থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘এই এলাকায় কেউ কাছাকাছি গেলেই ইসরাইলী সেনারা তাদের লক্ষ্য করে গুলী করছে। বর্তমানে ফিলিস্তিনীদের জন্য একমাত্র খোলা পথ হচ্ছে উপকূলীয় সড়কের ‘আল-রাশিদ করিডোর’। সাংবাদিক হিন্দ খুদারি আরও বলেন, ‘এর অর্থ হচ্ছে- আরও বেশি ফিলিস্তিনীকে এখন খান ইউনুস ও দেইর আল-বালাহ এলাকায় ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। আর ইসরাইল আরও বেশি পরিমাণে ফিলিস্তিনী ভূমি দখলের চেষ্টা করছে। তাদের কাছে রাফাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি হলো কারেম আবু সালেম সীমান্ত ক্রসিং-এর প্রধান সড়ক। এই সড়কটিই গাজা ও ইসরাইলের মধ্যে একমাত্র সংযোগস্থল। আর এটিই মূলত রাফাহ দিয়ে ফিলিস্তিনীদের বাইরে যাওয়ার প্রধানতম পথ।