গাজা উপত্যকার পূর্বাঞ্চলে ভারী বোমা হামলা চালানো শুরু করেছে ইসরাইল। সোমবার (১১ আগস্ট) প্রত্যক্ষদর্শী ফিলিস্তিনিরা জানিয়েছেন, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সবচেয়ে তীব্র বোমাবর্ষণ চলছে। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজা সিটিতে নতুন সম্প্রসারিত অভিযান খুব দ্রুতই শেষ করতে চান বলে জানানোর পর সেখানে এই তীব্র বোমাবর্ষণ শুরু হল। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা এ খবর জানিয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছে,ইসরাইলের ট্যাংক এবং বিমান সোমবার গাজা সিটির পূর্বাঞ্চলীয় সাবরা, জয়তুন এবং শেজাইয়ায় বোমা বর্ষণ করেছে। এতে বহু পরিবার বাড়িঘর ছেড়ে পশ্চিমের দিকে সরে যেতে বাধ্য হয়েছে।

গাজা সিটির কিছু বাসিন্দা বলেছে, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এই রাত ছিল সবচেয়ে বাজে। এতে শহরটিতে আরও জোরদার সামরিক হামলা হওয়ার প্রস্তুতির আশঙ্কা বেড়েছে।

গতকাল ইসরাইলি বিমান হামলায় গাজা সিটির আল শিফা হাসপাতাল প্রাঙ্গণে একটি তাঁবুর মধ্যে আল জাজিরার খ্যাতনামা সংবাদদাতা আনাস আল শরীফসহ ছয়জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। প্রায় ২২ মাস ধরে চলা ইসরাইলি অভিযানে সাংবাদিকদের ওপর এটিই সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলা।

হামাস বলছে, উত্তর প্রান্তের বাসিন্দাদের স্থানচ্যুত হওয়ার পর বর্তমানে প্রায় ১০ লাখ মানুষ গাজা সিটিতে আশ্রয় নিয়েছে।

ইসরাইলি সেনাবাহিনী বলেছে, তাদের বাহিনী ওই এলাকায় হামাস যোদ্ধাদের লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণ করেছে।

গাজার ২৫ বছর বয়সী এক বাসিন্দা আমর সালাহ বলেন, যুদ্ধ আবার নতুন করে শুরু হচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। ট্যাংক থেকে বাড়িঘরে গোলা ছোড়া হচ্ছে। বেশ কয়েকটি বাড়িঘরে গোলা আঘাত হেনেছে। বিমান থেকে ছোড়া হচ্ছে ক্ষেপণাস্ত্র। কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র গাজার পূর্বাঞ্চলের কিছু রাস্তায় পড়েছে।

ইসরাইলের সেনাবাহিনী বলেছে, তারা রোববার গাজা সিটির পূর্বাঞ্চলে হামাসের একটি রকেট উৎক্ষেপণস্থল ধ্বংস করেছে।

ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু রবিবার বলেছেন, তিনি নতুন অভিযান ত্বরান্বিত করার জন্য সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন।

তিনি বলেন, আমি যত দ্রুত সম্ভব যুদ্ধ শেষ করতে চাই। সেকারণে আমি খুব কম সময়ের মধ্যে গাজা সিটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)-কে নির্দেশ দিয়েছি।

নতুন পরিকল্পনাটি আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ একে ‘অন্তহীন যুদ্ধের দিকে অগ্রসর হওয়া’ বলে উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, এটি অভূতপূর্ব মাত্রার একটি বিপর্যয়ের পূর্বাভাস দিচ্ছে।

গুরুত্বপূর্ণ ইউরোপীয় মিত্র জার্মানি ঘোষণা করেছে যে তারা গাজায় ব্যবহার হতে পারে এমন সামরিক সরঞ্জাম ইসরাইলে রপ্তানি বন্ধ করবে। ব্রিটেন ও অন্যান্য ইউরোপীয় মিত্ররা ইসরাইলকে গাজা সামরিক অভিযান বাড়ানোর সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে আহ্বান জানিয়েছে।

গাজায় আশা জাগাতে ‘কূটনৈতিক প্রচেষ্টা’ কাজে লাগাচ্ছে তুরস্ক : এরদোগান

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান বলেছেন, ‘গাজায় আশা জাগাতে আমরা আমাদের দেশের সমস্ত সম্পদ এবং কূটনৈতিক সক্ষমতা কাজে লাগাচ্ছি।’

সোমবার (১১ আগস্ট) দেশটির রাজধানী আঙ্কারায় মন্ত্রিসভার একটি বৈঠক হয়। বৈঠকের পর দখলদার ইসরাইলের উদ্দেশ্যে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট একথা বলেন।

এরদোগান বলেন, আমরা নেতানিয়াহু (ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী) এবং তার খুনি নেটওয়ার্ককে তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার জন্য আমাদের অঞ্চলকে আরও বড় বিপর্যয়ের দিকে টেনে আনতে দেব না।

উল্লেখ্য, দখলদার ইসরাইল ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় প্রায় ৬১,৫০০ মানুষকে হত্যা করেছে। সামরিক অভিযান চালিয়ে ছিটমহলটিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। অনাহারে মৃত্যু, রোগ এবং জোরপূর্বক অভিবাসনসহ একটি গভীরতর মানবিক সংকট তৈরি করেছে।

গত নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গাজায় যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য নেতানিয়াহু এবং তার সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। গাজায় গণহত্যার দায়ে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যার মামলার মুখোমুখিও হতে হচ্ছে ইসরাইলকে।

ইসরাইলি বাহিনীর টার্গেট লিস্টে সাংবাদিকদের নাম!

এখন আর অকস্মাৎ হামলা নয়। বেছে বেছে গাজায় কাজ করা স্থানীয় সাংবাদিকদের হত্যা করছে ইসরাইলি বাহিনী। তারা যাকে শত্রু মনে করছে, তাকেই কোনো রকম বাছবিচার ছাড়া হত্যা করা হচ্ছে।

গাজায় যুদ্ধ পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে, আর এর সবচেয়ে বড় শিকার হয়ে উঠছেন স্থানীয় সাংবাদিকরা। যুদ্ধের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ২৭০ জন সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মী ইসরাইলের হামলায় নিহত হয়েছেন। সর্বশেষ রবিবার আল-শিফা হাসপাতালের বাইরে আল-জাজিরার মিডিয়া তাঁবুতে ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় পাঁচ সাংবাদিক নিহত হন। নিহতদের মধ্যে ছিলেন আল-জাজিরা সংবাদদাতা আনাস আল-শরীফ ও মোহাম্মদ কারাকা, আলোকচিত্রী ইব্রাহিম জাহের ও মোহাম্মদ নোফাল।

এই প্রেক্ষাপটে, গাজার ময়দান থেকে কাজ করা স্থানীয় সাংবাদিক মোহাম্মদ আসাদের সঙ্গে কথা বলেছে মেহর নিউজ এজেন্সি। আসাদ জানান, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে সাংবাদিকরা এমন প্রতিবন্ধকতা ও বিপদের মুখোমুখি হচ্ছেন যা বিশ্বে কোনো যুদ্ধ ফটোগ্রাফার আগে কখনও দেখেননি। তিনি বলেন, আমাদের পরিবহন নেই, জ্বালানি নেই, নিরাপত্তা সরঞ্জাম নেই— যে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট আছে, তাও মেয়াদোত্তীর্ণ।

আসাদ অভিযোগ করেন, সাংবাদিকদের সরাসরি টার্গেট করা হচ্ছে এবং অনেকের নাম ইসরাইলি সেনাদের হত্যার তালিকায় রাখা হয়েছে। কেউ ‘রেড জোনে’ থাকাকালীন হামলার শিকার হচ্ছেন, আবার কেউ রাস্তায় হাঁটার সময় গুলিবর্ষণে নিহত হচ্ছেন। শুধু তাই নয়, তাদের বাড়ি-অফিস ধ্বংস হয়ে গেছে, ক্যামেরা ও সরঞ্জাম নষ্ট হয়ে গেছে এবং সীমান্ত বন্ধ থাকায় কোনো ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সুযোগ নেই।

তিনি আরও জানান, ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন, মোবাইল ফোনও চার্জহীন হয়ে পড়ছে। অনেক সময় ঘটনাস্থলে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। অনেক হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসযজ্ঞ আমরা কাভার করতে পারি না, কারণ ভারী গুলিবর্ষণ ও অবরোধ আমাদের আটকে দেয়।

আসাদ আন্তর্জাতিক মহলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, শুধু দূর থেকে সংহতি জানিয়ে লাভ নেই। আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের গাজায় আসতে হবে এবং আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোকে সাংবাদিকদের নিরাপত্তায় কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। পরিস্থিতি ভয়াবহ, দখলদার বাহিনী পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ চালিয়ে গাজা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছে।