যুক্তরাজ্যসহ ২৮টি দেশ গাজায় যুদ্ধের তাৎক্ষণিক সমাপ্তি দাবি করেছে। তারা বলেছে, সেখানে বেসামরিক জনগণের দুর্ভোগ ‘নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে’। ব্রিটেন, ফ্রান্স, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়াসহ পশ্চিমা দেশগুলো গত সোমবার এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছে, ইসরাইলের উচিত গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করা। তারা গাজায় সাহায্য বিতরণকেন্দ্রের আশেপাশে শত শত ফিলিস্তিনিসহ বেসামরিক মানুষদের ‘অমানবিক হত্যাকা-ে’র নিন্দা জানিয়েছে। যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গাজাবাসীদের জন্য ইসরাইলের সহায়তা বিতরণের মডেলটি বিপজ্জনক। এতে সহায়তা ধীরগতিতে সরবরাহ এবং খাদ্য ও পানির সন্ধানে যাওয়ার সময় ৮০০’র বেশি বেসামরিক লোক নিহত হওয়া ‘ভয়াবহ’। ওয়াফা , আনাদোলু, বিবিসি, আল জাজিরা, রয়টার্স।

গাজার হামাস-নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, গত সপ্তাহান্তে ত্রাণের জন্য অপেক্ষারত অবস্থায় ইসরাইলী গুলীতে শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। আরও ১৯ জন অপুষ্টিজনিত কারণে মারা গেছে। ইসরাইলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই বিবৃতিকে ‘বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন এবং হামাসকে ভুল বার্তা প্রদানকারী’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে। গাজায় চলমান ইসরাইলের হত্যাযজ্ঞ এরই মধ্যে ২১ মাসের বেশি সময় পার হতে চলেছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত উপত্যকাটির ২০ লাখের বেশি বাসিন্দার মানবিক পরিস্থিতি ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই ২১ মাসে ইসরাইলের কৌশলের বিরুদ্ধে বহু আন্তর্জাতিক বিবৃতি এসেছে। এমন সময় তবে সোমবারের ইসরাইলের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত দেশগুলোর এই যৌথ বিবৃতিটি তার স্পষ্ট ভাষার জন্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

এই বিবৃতিতে যুক্তরাজ্যসহ অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ফ্রান্স, ইতালি, জাপান, নিউজিল্যান্ড এবং সুইজারল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা স্বাক্ষর করেছেন। বিবৃতির শুরুতেই বলা হয়েছে, ‘গাজার যুদ্ধ এখনই শেষ হওয়া উচিত।’ এরপর সতর্ক করে বলা হয়েছে, ‘গাজার বেসামরিক জনগণের দুর্ভোগ নতুন এক গভীর পর্যায়ে পৌঁছেছে। ইসরাইলী সরকারের সহায়তা সরবরাহের পদ্ধতি বিপজ্জনক। এটি অস্থিতিশীলতা বাড়ায় এবং গাজাবাসীর মানবিক মর্যাদাকে লঙ্ঘন করে।’

বিবৃতিতে একটি সমঝোতাভিত্তিক অস্ত্রবিরতি, ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের হাতে আটক বন্দীদের মুক্তি এবং জরুরি মানবিক সহায়তার অবাধ প্রবাহের আহ্বান জানানো হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “আমরা গাজায় ধীরগতিতে সহায়তা সরবরাহ এবং বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য ও পানির খোঁজে থাকা বেসামরিক মানুষ, যার মধ্যে শিশুরাও আছে, তাদের অমানবিক হত্যাকা-ের নিন্দা জানাই। এটি আতঙ্কজনক যে ৮০০’র বেশি ফিলিস্তিনি সহায়তা নিতে গিয়ে নিহত হয়েছে।” যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি পরে হাউজ অফ কমন্সে বলেন, ‘গাজায় ভয়াবহতার এক দীর্ঘ তালিকা চলছে, যার মধ্যে নিরাশ, অনাহারক্লিষ্ট শিশুদের হত্যা অন্তর্ভুক্ত।’ তিনি ঘোষণা করেন, যুক্তরাজ্য এই বছরে গাজার জন্য অতিরিক্ত ৪০ মিলিয়ন পাউন্ড মানবিক সহায়তা দেবে। ল্যামি বলেন, তিনি “ইসরাইলের নিরাপত্তা এবং টিকে থাকার অধিকারের দৃঢ় সমর্থক হলেও, ইসরাইলী সরকারের বর্তমান কর্মকা- বিশ্বে ইসরাইলের ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং এর দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তাকেও দুর্বল করছে।”

জাতিসংঘ ও গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দুই মাসের বেশি সময় সম্পূর্ণ অবরোধ রাখার পর গত মে মাসের শেষের দিক থেকে ইসরাইল তা শিথিল করে। এরপর থেকে প্রতিদিনই খাদ্যের জন্য অপেক্ষাকালে ফিলিস্তিনিদের নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। ত্রাণ সংগ্রহ করতে গিয়ে এখন পর্যন্ত ৮৭৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। জাতিসংঘ ও এর অংশীদাররা গাজার বর্তমান সাহায্য পদ্ধতির সঙ্গে সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। কারণ এটি অনিরাপদ এবং মানবিক সহায়তার নিরপেক্ষতা, স্বাধীনতা ও মানবিকতার নীতিমালা লঙ্ঘন করে।

গত মঙ্গলবার জাতিসংঘের মানবাধিকার দফতর জানায়, জিএইচএফের সহায়তা বিতরণ শুরুর পর আট সপ্তাহে এর আশেপাশে ৬৭৪ জন নিহত হয়েছে। জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থার কনভয় চলাচলের পথে আরও ২০১টি হত্যার ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো হলো যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, কানাডা, সাইপ্রাস, ডেনমার্ক, এস্তোনিয়া, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, আইসল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, ইতালি, গ্রিস, জাপান, লাটভিয়া, লিথুনিয়া, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা, নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, স্লোভেনিয়া, স্পেন, সুইডেন এবং সুইজারল্যান্ড। দেশগুলোর পক্ষে তাঁদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন। গত শনিবারও খান ইউনিস এবং নিকটবর্তী রাফাহ শহরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল পরিচালিত বিতর্কিত সংস্থা গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন- জিএইচএফের দুটি স্থানের আশপাশে আরও ৩৯ জন নিহত হয়েছে।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরাইলে হামলা চালায় হামাস। এর প্রতিশোধ নিতে ওইদিনই ইসরাইল গাজায় সামরিক অভিযান শুরু করে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরাইলী হামলায় তখন থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ৫৯ হাজার ২৯ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।

গাজায় ইসরাইলী অবরোধের মধ্যে ক্ষুধায় আরও এক শিশুর মৃত্যু : ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ক্ষুধা ও অপুষ্টিতে আরও এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। মূলত গণহত্যামূলক আগ্রাসনের মধ্যে ইসরাইলের আরোপিত মানবিক সহায়তা অবরোধ ক্রমেই গভীরতর বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে অঞ্চলটিকে। ফিলিস্তিনের সরকারি বার্তাসংস্থা জানিয়েছে, ৪ বছর বয়সী রেজ্জান আবু জাহির অপুষ্টিজনিত জটিলতায় মারা গেছে। গাজার আল-আকসা শহীদ হাসপাতালে দায়িত্বরত চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, মৃত্যুর পেছনে প্রধান কারণ ছিল ক্ষুধা ও দীর্ঘদিনের অপুষ্টি।

ওয়াফার প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, গাজার বিভিন্ন হাসপাতালে শত শত মানুষ ছোট-বড় সবাই চরম ক্ষুধা ও অপুষ্টিতে ভুগছেন। এই পরিস্থিতিতে চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত বিছানা বা ওষুধ কিছুই হাসপাতালগুলোতে নেই। প্রতিবেদনে জানানো হয়, গাজায় বর্তমানে প্রায় ১৭ হাজার শিশু মারাত্মক অপুষ্টির শিকার। শুধু শারীরিকভাবে নয়, মানসিকভাবেও ক্ষুধা ও নিরাপত্তাহীনতায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তারা। অনেকেই চরম মানসিক চাপ ও স্মৃতিভ্রষ্টতার মতো সমস্যায় ভুগছে। জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ এর আগেই সতর্ক করেছিল, মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত মাত্র তিন মাসে গাজায় পাঁচ বছরের নিচের শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির হার দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এর কারণ হিসেবে সংস্থাটি সরাসরি ইসরাইলের মানবিক সহায়তা প্রবেশে বাধা দেওয়াকে দায়ী করেছে। মূলত চলতি বছরের মার্চ থেকে ইসরাইল গাজার সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে এবং ওষুধ ও খাদ্যসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রবেশে বাধা দিচ্ছে। এর ফলে চিকিৎসা, খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় হামলা শুরু করে ইসরাইল। এরপর থেকে সামরিক আগ্রাসনের পাশাপাশি “ক্ষুধা নীতি” অনুসরণ করে মানবিক দুর্যোগকে আরও গভীর করেছে তারা।