কাতারের রাজধানী দোহায় ফিলিস্তিনী স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের কর্মকর্তাদের অবস্থান লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। বর্বর ওই হামলায় অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেছেন সেখানে অবস্থানরত হামাস নেতারা। নিরাপদেই আছেন তারা। দোহায় হামাস নেতাদের অবস্থান লক্ষ্য করে অন্তত ১২টি বিমান হামলা চালায় ইসরাইল। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, হামলায় হামাস নেতারা নিরাপদ থাকলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাদের শেলটার দেওয়া হোটেল। সেখানেই গাজায় যুদ্ধ বন্ধের শর্ত নিয়ে আলোচনা করছিলেন হামাস নেতারা। হামলার লক্ষ্য ছিল হামাসের শীর্ষ নেতা খলিল আল হাইয়া, জাহের জাবারিনসহ আরও কয়েকজন। এ ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চল ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার নেতারা তীব্র নিন্দা জানিয়ে একে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন, কাতারের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। মেহের নিউজ, বিবিসি।

কাতার: দোহায় হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্যদের আবাসিক ভবনকে লক্ষ্য করে চালানো ইসরাইলের বিমান হামলাকে ‘কাপুরুষোচিত’ আক্রমণ বলে উল্লেখ করেছে কাতার। এক বিবৃতিতে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাজেদ আল-আনসারি বলেন, ‘কাতার স্পষ্টভাবে জানাচ্ছে যে, এই বেপরোয়া ইসরাইলি আচরণ ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার সঙ্গে ছিনিমিনি খেলা মেনে নেওয়া হবে না। আমাদের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব লক্ষ্য করে কোনো কর্মকা- বরদাশত করা হবে না’।

জাতিসংঘ: জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ইসরাইলের বিমান হামলাকে কাতারের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখ-তার প্রকাশ্য লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেন। তিনি গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রচেষ্টায় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাতারের ইতিবাচক ভূমিকার কথা তুলে ধরে স্থায়ী যুদ্ধবিরতিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার আহ্বান জানান।

ইরান: ইরান এ হামলাকে ‘বিপজ্জনক’ এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন আখ্যা দিয়ে আঞ্চলিক শান্তিকে বিপন্নকারী পদক্ষেপ অবিলম্বে বন্ধ করার আহ্বান জানায়। এক বিবৃতিতে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইসমাইল বাঘাই বলেন, ‘অত্যন্ত বিপজ্জনক ও অপরাধমূলক এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক সব আইন ও বিধিনিষেধের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এটি কাতারের জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখ-তায় হস্তক্ষেপ’।

ইয়েমেন: ইয়েমেন এই হামলাকে কাতারের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন ও আঞ্চলিক কূটনীতিকে ক্ষতিগ্রস্তকারী ঘটনা বলে উল্লেখ করে আরব দেশগুলোকে ইসরাইলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানায়। ইয়েমেনের সুপ্রিম পলিটিক্যাল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মাহদি আল-মাশাত সতর্ক করে বলেন, ‘যদি আমরা সবাই মিলে জায়নিস্ট হুমকির মোকাবিলা না করি, তাহলে দোহায় যা ঘটেছে, তা আবার ঘটবে এবং বাকি দেশগুলোতেও ঘটতে থাকবে’।

সৌদি আরব: সৌদি আরব এই হামলাকে ‘ভ্রাতৃপ্রতীম কাতার রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রকাশ্য লঙ্ঘন’ বলে উল্লেখ করেছে এবং ইসরাইলের অব্যাহত আগ্রাসনের ‘গুরুতর পরিণতির’ বিষয়ে সতর্ক করেছে।

পাকিস্তান: পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এ আক্রমণকে ‘অযৌক্তিক ও আগ্রাসী সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন’ হিসেবে নিন্দা করেছেন। তিনি কাতারের জনগণ ও নেতৃত্বের প্রতি গভীর সহানুভূতি প্রকাশ করে বলেন, পাকিস্তান সবসময় ফিলিস্তিনি সংগ্রামের পাশে থাকবে।

ইরাক : ইরাকও এ হামলাকে ‘কাপুরুষোচিত কর্মকা-’ আখ্যা দিয়ে কাতারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছে এবং আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি তাদের অঙ্গীকারের কথা জানিয়েছে।

তুরস্ক: তুরস্ক বলেছে, এই হামলা প্রমাণ করে ইসরাইল গাজার গণহত্যার সমাধানে কোনো আগ্রহ রাখে না। আঙ্কারা অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি এবং কূটনৈতিক আলোচনায় ফেরার আহ্বান জানিয়েছে।

জর্ডান: জর্ডানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আয়মান সাফাদি এ আক্রমণকে আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদের প্রকাশ্য লঙ্ঘন আখ্যা দেন। তিনি বলেন, ‘এটি ইসরাইলের বর্বর আগ্রাসনের ধারাবাহিকতা, যা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলছে’।

সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই): ইউএই বিমান হামলাকে ‘বিশ্বাসঘাতক ইসরাইলি হামলা’ বলে নিন্দা জানিয়েছে। দেশটি একে ‘প্রকাশ্য ও কাপুরুষোচিত’ আখ্যা দিয়ে দেশগুলোর জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান এবং আন্তর্জাতিক আইন মেনে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছে।

আরব লীগ: আরব লীগ বলেছে, কাতারের সার্বভৌমত্বের এই লঙ্ঘন আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করছে। সংস্থাটি ভবিষ্যতে এমন আগ্রাসন ঠেকাতে যৌথ পদক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছে।

মালদ্বীপ : মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জু এ বিমান হামলাকে ‘আন্তর্জাতিক আইন ও সার্বভৌমত্বের গুরুতর লঙ্ঘন’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দ্রুত ও ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ নিয়ে ইসরাইলকে জবাবদিহির মুখোমুখি করার আহ্বান জানান।

পোপ লিও চতুর্দশ : ভ্যাটিক্যানের পোপ লিও চতুর্দশও কাতারে ইসরাইলের বিমান হামলা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, পরিস্থিতি ‘অত্যন্ত গুরুতর’ এবং এর ফলে আঞ্চলিক অস্থিরতার ঝুঁকি আরও বাড়বে।

খুশি নন ট্রাম্প : কাতারের ওপর ইসরায়েলের হামলায় বিরক্তি প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, তিনি 'খুশি নন'। হামলার কারণে এখন ভেস্তে যেতে বসেছে গাজায় যুদ্ধ বিরতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগ। কারণ ইসরায়েল যেখানে হামলা করেছে সে ভবনেই আলোচনার জন্য বসেছিলেন হামাসের শীর্ষ কূটনৈতিক নেতারা। গত মঙ্গলবার বিকালে কাতারের রাজধানী দোহায় হামাসের কর্মকর্তাদের বৈঠকে ইসরায়েল হামলা চালায়। ইসরায়েলি গণমাধ্যম জানিয়েছে, ১৫টি ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে এই হামলা চালানো হয়, যেখানে একটি লক্ষ্যবস্তুতে ১০টি গোলাবারুদ নিক্ষেপ করা হয়েছিল। দোহার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন যে তারা ৮টি পৃথক বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছেন।

হামাস জানিয়েছে যে তাদের পাঁচজন সদস্য নিহত হয়েছে, তবে দাবি করেছে যে তাদের শীর্ষ নেতৃত্ব বেঁচে গেছেন। হামাস বলেছে, এই হামলা "একটি জঘন্য অপরাধ, একটি স্পষ্ট আগ্রাসন এবং সমস্ত আন্তর্জাতিক নিয়ম ও আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন"। কাতার বলেছে যে এই হামলা আন্তর্জাতিক আইনের "স্পষ্ট লঙ্ঘন", পাশাপাশি কাতারের জন্য "গুরুতর হুমকি"। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্পষ্টতই ক্ষুব্ধ এবং হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন যে তিনি "এর প্রতিটি দিক নিয়ে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট"। তিনি বলেন, হামলা চলাকালীন মার্কিন সেনাবাহিনীর কাছ থেকে তিনি হামলার কথা জানতে পেরেছেন। মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি রয়েছে কাতারে, তাই আমেরিকার অনুমতি ছাড়া এ হামলা হয়েছে তা বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং জাতিসংঘের নেতারা এই হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। বাংলাদেশ সরকারও এ হামলার নিন্দা জানিয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে “এই ধরনের কর্মকা- কাতারের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখ-তার, আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতিসংঘ সনদের নীতির স্পষ্ট লঙ্ঘন। এই বেআইনি এবং বিনা প্ররোচনায় আক্রমণের মুখে বাংলাদেশ ভ্রাতৃপ্রতিম কাতার সরকার এবং জনগণের সাথে দৃঢ় সংহতি প্রকাশ করে।”