গাজা উপত্যকায় আবারও বিমান হামলা শুরু করেছে দখলদার ইসরাইল। গত রোববার যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করে জায়নিস্ট বাহিনী এ হামলা চালায় বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম । ইসরাইলী গণমাধ্যমগুলো রাফা ও দক্ষিণ গাজার বিভিন্ন এলাকায় হামলার খবর দিচ্ছে। ইসরাইলের চ্যানেল ১২ জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু, প্রতিরক্ষামন্ত্রী কাটজ এবং সেনা কর্মকর্তারা এক ফোনালাপে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করছেন। ইসরাইলের সরকারি সম্প্রচারমাধ্যম জানায়, হামাস যোদ্ধাদের সঙ্গে ‘ গোলাগুলী বিনিময়’-এর পর এই হামলা চালানো হয়। ইসরাইলী মিডিয়ার দাবি, দক্ষিণ গাজার রাফা এলাকায় ‘সন্ত্রাসী তৎপরতার’ জবাব হিসেবেই এ অভিযান চালানো হয়েছে। ইসরাইলী সংবাদমাধ্যমগুলো আরও জানায়, রাফায় সামরিক যান বিস্ফোরণে ইসরাইলের দুই সেনা সদস্য নিহত হয়েছেন।এদিকে, ফিলিস্তিনী স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস এক বিবৃতিতে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সাম্প্রতিক অভিযোগকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। যুক্তরাষ্ট্র দাবি করেছিল, হামাস যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভঙ্গ করে ‘আসন্ন হামলার প্রস্তুতি’ নিচ্ছে। বিবৃতিতে হামাস বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের এই মন্তব্য সম্পূর্ণভাবে ইসরাইলী দখলদারদের বিভ্রান্তিকর প্রচারণার সঙ্গে মিলে যায় এবং এটি ইসরাইলের চলমান সংগঠিত অপরাধ ও আগ্রাসনের জন্য রাজনৈতিক আড়াল তৈরি করে। হামাসের দাবি, বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারা অভিযোগ করে, ইসরাইল নিজেরাই সশস্ত্র অপরাধী গোষ্ঠী গঠন, অস্ত্র সরবরাহ ও অর্থায়ন করছে যারা ফিলিস্তিনী নাগরিকদের হত্যা, অপহরণ, ত্রাণবাহী ট্রাক লুট ও সম্পদ চুরিতে জড়িত। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, এসব অপরাধে ইসরাইলী দখলদার বাহিনীর সম্পৃক্ততা নিজস্ব গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন ও ভিডিওচিত্রের মাধ্যমে ইতোমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে। হামাস জানায়, গাজার পুলিশ বাহিনী ও স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় আইনসম্মত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এসব অপরাধী চক্রকে শনাক্ত ও বিচার করার কাজ চলছে, যাতে সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তা ও সম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়। সংগঠনটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানায়, ইসরাইলী দখলদারদের বিভ্রান্তিকর বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি বন্ধ করে যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন বন্ধে তেলআবিবকে নিয়ন্ত্রণে আনতে। বিবৃতির শেষে হামাস পুনর্ব্যক্ত করে, তারা ফিলিস্তিনী জনগণের নিরাপত্তা রক্ষা ও সংগঠিত আগ্রাসন ও অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা প্রতিরোধে অঙ্গীকারবদ্ধ। আলজাজিরা, লয়টার্স।
ইসরাইল ৪৭ বার যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন
বার বার যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করছে ইসরাইলী বাহিনী। ফিলিস্তিনী কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি মাসের শুরুতে কার্যকর হওয়ার পর থেকে ইসরাইলী সেনাবাহিনী ৪৭ বার যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। ফলে ৩৮ ফিলিস্তিনী নিহত এবং ১৪৩ জন আহত হয়েছেন। এদিকে ইসরাইলী সরকার বলছে, গাজা ও মিশরের মধ্যবর্তী রাফা সীমান্ত ক্রসিং ‘পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত’ বন্ধ থাকবে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু হামাসের বিরুদ্ধে জিম্মিদের মরদেহ উদ্ধারে যথেষ্ট পদক্ষেপ না নেওয়ার অভিযোগ করেছেন। কিন্তু হামাস এরই মধ্যে আরও দুই জিম্মির মরদেহ ফেরত দিয়েছে। হামাস বলছে, নেতানিয়াহু যুদ্ধবিরতি চুক্তি ‘ব্যহত করার জন্য তুচ্ছ অজুহাত’ কাজে লাগাতে চাচ্ছেন।
যুক্তরাষ্ট্র, মিশর, কাতার, তুরস্কের মধ্যস্থতায় গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও এখনো বন্ধ রয়েছে ‘লাইফলাইন’ খ্যাত রাফা ক্রসিং। গাজার শহর থেকে প্রায় ৩০-৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণে মিশর সীমান্তে অবস্থিত এ চেকপোস্টটি মাত্র ৩০০ মিটারের একটি রাস্তা। তবে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ এবং ত্রাণ পৌছানোর প্রধান আন্তর্জাতিক প্রবেশদ্বার এই রাফা ক্রসিং। রাফাহ ক্রসিং বন্ধ থাকায় মৃতদেহ উদ্ধার ও স্থানান্তরে উল্লেখযোগ্য বিলম্ব হবে। গাজার মধ্যে এখনও বন্দি ও মৃতদেহ ফেরতের বিষয়টি যুদ্ধবিরতির বাস্তবায়নের অন্যতম বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাফাহ ক্রসিং পুনরায় খোলার সঙ্গে সব মৃতদেহ পুনরুদ্ধারের বিষয়টি যুক্ত করেছে ইসরায়েল। ২০২৩ সালের অক্টোবরে শুরু হওয়া সংঘাতে গাজায় কমপক্ষে ৬৮ হাজার ১১৬ জন নিহত এবং ১ লাখ ৭০ হাজার ২০০ জন আহত হয়েছে। অপরদিকে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলায় ১ হাজার ১৩৯ জন নিহত এবং প্রায় ২০০ জনকে জিম্মি করে নিয়ে যাওয়া হয়।
গাজায় ইসরাইলের হামলায় একই পরিবারের
নিহত ৭ শিশুর দুজনের মরদেহ উদ্ধার হয়নি
ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইলী বাহিনীর হামলায় একই পরিবারের নিহত ১১ সদস্যের মধ্যে ৭টিই শিশু। এর মধ্যে দুই শিশুর লাশ এখন পর্যন্ত উদ্ধার করা যায়নি। হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠার আট দিনের মাথায় স্থানীয় সময় গত শুক্রবার সন্ধ্যায় ওই হামলার ঘটনা ঘটে। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর গাজায় এটাকেই সবচেয়ে প্রাণঘাতী একক ঘটনা হিসেবে ধরা হচ্ছে। হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজার সিভিল ডিফেন্স জানায়, গাজা নগরীর জেইতুন এলাকায় ‘আবু শাবান’ গোত্রের পরিবারকে বহনকারী একটি গাড়ি লক্ষ্য করে ইসরাইলী বাহিনী ট্যাংকের গোলা ছুড়ে। সিভিল ডিফেন্সের মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল এক বিবৃতিতে বলেন, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে তিনজন নারী ও সাতটি শিশু রয়েছে। পরিবারটি তাদের বাড়ি দেখার জন্য যাচ্ছিল। মাহমুদ বাসাল বলেন, ‘পরিবারটিকে সতর্ক করা বা ভিন্নভাবে মোকাবিলা করা যেত। যেটা ঘটেছে, সেটা নিশ্চিত করে, দখলদারেরা এখনো রক্তপিপাসু হয়ে আছে এবং নিরীহ বেসামরিক মানুষের বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটন করায় জোর দিচ্ছে।’
সংস্থার পক্ষ থেকে দেওয়া পৃথক এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, তারা জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সমন্বয় দপ্তরের (ওসিএইচএ) সঙ্গে সমন্বয় করে ওই ঘটনায় নয়জনের মরদেহ উদ্ধার করতে পেরেছে। এখনো দুটি শিশুর মরদেহ উদ্ধার করা যায়নি। গাজার সিভিল ডিফেন্স সংস্থা জানায়, তারা জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সমন্বয় দপ্তরের (ওসিএইচএ) সঙ্গে সমন্বয় করে ওই ঘটনায় নয়জনের মরদেহ উদ্ধার করতে পেরেছে। এখনো দুটি শিশুর লাশ উদ্ধার করা যায়নি। এ ঘটনাকে ‘হত্যাযজ্ঞ’ হিসেবে চিহ্নিত করে সমালোচনা করেছে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। তারা বলছে, যুক্তিহীনভাবে পরিবারটিকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ইসরাইলকে যুদ্ধবিরতির শর্ত মেনে চলার জন্য চাপ দিতে হামাস মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও মধ্যস্ততাকারীদের প্রতি আহ্বান জানায়। এর আগে গত সপ্তাহেও গাজা নগরীর সুজয়েয়া এলাকায় ইসরাইলী বাহিনীর হাতে পাঁচ ফিলিস্তিনী নিহত হয়েছিলেন। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পরও এখন পর্যন্ত মিসরের সঙ্গে রাফা সীমান্ত ক্রসিংসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত বন্ধ করে রেখেছে ইসরাইল। ফলে দুর্ভিক্ষপীড়িত গাজা উপত্যকায় বড় পরিসরে ত্রাণ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। গত শনিবার ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দপ্তর জানায়, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত রাফা সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ থাকবে। সোমবার থেকে মিসরে ফিলিস্তিনের দূতাবাস আবারও চালু হচ্ছে এমন ঘোষণা আসার পরপরই ইসরাইল এ কথা জানিয়ে দেয়।