ফিলিস্তিনকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান এবং মধ্যপ্রাচ্যের আল আকসা অঞ্চলে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান (টু স্টেট সলিউশন) বাস্তবায়ন করতে জাতিসংঘ, ফ্রান্স এবং সৌদি আরবের উদ্যোগে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে যে বৈশ্বিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল, তা শেষ হয়েছে। সম্মেলন শেষে অন্যান্য দেশগুলোর মতামত সাপেক্ষে ইসরাইলের উদ্দেশে ‘রেড লাইন’ ঘোষণা করেছে দুই আয়োজক দেশ ফ্রান্স এবং সৌদি। আর সেই ‘রেড লাইন’ হলো পশ্চিম তীরে ইসরাইলের সম্প্রসারণ কার্যক্রম। সম্মেলন শেষে এক যৌথ ঘোষণাপত্রে ফ্রান্স এবং সৌদি আরব বলেছে, “ইসরাইলকে অবশ্যই অনতিবিলম্বে গাজায় সামরিক অভিযান বন্ধ করতে হবে এবং গাজায় বন্দি সব ইসরাইলী জিম্মির মুক্তি নিশ্চিত করতে হবে।” টাইমস অব ইসরাইল, এএফপি,টিআরটি ওয়ার্ল্ড, সিএনএন,আনাদোলু ,রয়টার্স, বিবিসি।
“পাশাপাশি গাজায় স্থায়ী যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করতে হবে, ইসরাইলের কারাগারে বন্দি ফিলিস্তিনিদের মুক্তি দিতে হবে এবং গাজা “এছাড়া পশ্চিম তীরে ক্ষমতাসীন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নেতৃত্বে গাজা উপত্যকা ও পশ্চিম তীরের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের ব্যাপারে একমত হয়েছে সম্মেলনে অংশ নেওয়া দেশগুলো। তাই এখন থেকে পশ্চিম তীর ইসরাইলের জন্য রেড লাইন। পশ্চিম তীরে যে কোনো ধরনের সম্প্রসারণ কার্যক্রম ইসরাইলের গুরুতর পরিণতি বয়ে আনবে এবং বর্তমানে ইসরাইলের সঙ্গে আমাদের শান্তিচুক্তিসহ অন্যান্য যেসব চুক্তি রয়েছে, সেগুলোকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে।” সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে গাজা উপত্যকা নিয়ন্ত্রণকারী গোষ্ঠী হামাসকে অস্ত্র সমর্পণ ও গাজার প্রশাসন থেকে বিদায় নেওয়ার আহ্বানও জানানো হয়েছে। প্রায় দু’মাস ধরে প্রস্তুতির পর গত কাল সোমবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ মিলনায়তনে হয়েছে এই সম্মেলন। ইসরাইল এবং তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই বর্জন করেছে এ সম্মেলন।
এই সম্মেলনেই ফিলিস্তিনকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে ফ্রান্স, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, অ্যান্ডোরা, মোনাকো। সম্মেলনের আগে স্বীকৃতি দিয়েছে যুক্তরাজ্য ও পর্তুগাল। গত সোমাবার ইসরাইলের জাতিসংঘ প্রতিনিধি দলের সদস্য ড্যানি ডেনন বৈশ্বিক এ সম্মেলকে ‘সার্কাস’ উল্লেখ করে বার্তাসংস্থাকে বলেছেন, “এই সম্মেলনে কোনো কাজ হবে বলে আমাদের মনে হয় না এবং আমরা মনে করি, সন্ত্রাসবাদকে পুরস্কৃত করতে এই সম্মেলনের ডাক দেওয়া হয়েছে।” তবে আগের দিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করা এক ভিডিওবার্তায় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেছেন, “আমরা চাই, (আল আকসা অঞ্চলে) পাশাপাশি দু’টি রাষ্ট্র থাকবে। একটি রাষ্ট্র হবে ইসরাইল, যা ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেবে; অপর রাষ্ট্রটি হবে ফিলিস্তিন যা ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেবে। আমাদের একমাত্র দাবি আল আকসা অঞ্চলে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান নীতির বাস্তবায়ন।”
ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিলো ফ্রান্স : ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে ফ্রান্স। গত সোমবার নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের বার্ষিক সাধারণ পরিষদের বৈঠকের আগে এই স্বীকৃতি দিয়েছে ফ্রান্স। এখন পর্যন্ত ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া সর্বশেষ দেশ হচ্ছে ফ্রান্স। এর ফলে ফিলিস্তিন ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সমর্থন আরও জোরালো হলো। ফ্রান্সের এই পদক্ষেপ এমন এক সময়ে এলো যখন গাজায় ইসরাইলের আগ্রাসন চলছে । নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘে বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেছেন, ‘শান্তির সময় এসেছে’ এবং ‘গাজায় চলমান যুদ্ধকে কিছুই ন্যায্যতা দেয় না।’ ফ্রান্স এবং সৌদি আরব ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা তথা দুই রাষ্ট্র সমাধান ইস্যুতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে এক দিনের একটি শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করছে। জি৭-এর সদস্য জার্মানি, ইতালি এবং যুক্তরাষ্ট্র এতে অংশ নেয়নি। ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা রয়েছে বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা, আন্দোরা এবং সান মারিনোর । এর আগে রবিবার ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং পর্তুগাল। এর ফলে গাজায় চলমান মানবিক সংকট এবং পশ্চিম তীরে বসতি নির্মাণের কারণে ইসরাইলের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। তবে ইসরাইল বলেছে যে, এই স্বীকৃতি হামাসকে পুরস্কৃত করবে। কারণ ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীটি ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরাইলে আক্রমণ চালিয়ে প্রায় ১,২০০ জন হত্যা করে। জিম্মি করে রাখে আরও ২৫১ জনকে।
গাজার হামাস-নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, এরপর থেকে গাজায় অভিযান চালিয়ে ৬৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরাইল। বর্তমানে গাজা সিটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার লক্ষ্যে স্থল অভিযান চালাচ্ছে ইসরাইলী বাহিনী। ফরাসি নেতা সম্মেলনে বলেছেন, যুদ্ধ বন্ধ করা এবং হামাসের হাতে আটক অবশিষ্ট ইসরাইলী জিম্মিদের মুক্ত করার সময় এসেছে। তিনি অন্তহীন যুদ্ধের বিপদের বিরুদ্ধে সতর্ক করে বলেছেন, ন্যায় সর্বদা শক্তির ওপরে প্রাধান্য পেতে হবে।
ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে বহুপ্রতীক্ষিত দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেওয়ার আশা করছে পশ্চিমা দেশগুলো। ইসরাইল ফিলিস্তিন সংকট সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তির মাধ্যমে যে শান্তিপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, তার ভিত্তি ছিল এই দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান। যদিও ইসরাইলের পশ্চিমা মিত্রদের অনাগ্রহের কারণে এ উদ্যোগ কখনো আলোর মুখ দেখেনি।
এখন ইসরাইলের দীর্ঘদিনের মিত্রদের দেওয়া এই স্বীকৃতি বাস্তবে বড় কোনো পরিবর্তন না আনলেও তা ফিলিস্তিনিদের প্রতি একটি শক্তিশালী নৈতিক বার্তা। এর মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনের প্রতি পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন আরও জোরদার হলো। যদিও এসবের তোয়াক্কা না করে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে ফিলিস্তিনে নির্বিচার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইলী বাহিনী।
নেতানিয়াহুর কর্মকা-ের কারণেই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে লুক্সেমবার্গ : ফিলিস্তিনকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে লুক্সেমবার্গ। তবে এর আগে দেশটির প্রধানমন্ত্রী লুক ফ্রাইডেন বলেছেন, ইসরাইল নয় বরং ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর কর্মকা-ের কারণেই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিচ্ছে লুক্সেমবার্গ। এক সাক্ষাৎকারে ফ্রাইডেন বলেন, “আমরা ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছি না; আমরা নেতানিয়াহুর সরকারের কর্মকা-ের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিচ্ছি, কারণ সেসব পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক নিয়মভিত্তিক শৃঙ্খলার পরিপন্থি।”
লুক্সেমবার্গ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। তবে আনুষ্ঠানিক এই ঘোষণার আগে সিএনএন-কে দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের লক্ষ্যের কথা উল্লেখ করে ফ্রাইডেন বলেন, “আমরা চাই দুটি দেশ ও দুটি জনগোষ্ঠী পাশাপাশি শান্তি ও সমৃদ্ধির সঙ্গে বসবাস করুক।” ফ্রাইডেন বলেন, ফিলিস্তিনিদের জন্য ভবিষ্যতের আশা জাগাতে হবে এবং একই সঙ্গে ইসরাইলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তার মতে, দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানই একমাত্র পথ। তিনি আরও বলেন, “ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার নতুন প্রচেষ্টা শান্তিপূর্ণ ইসরাইল ও শান্তিপূর্ণ ফিলিস্তিনকে পাশাপাশি দাঁড় করাতে পারে।” ফ্রাইডেন সতর্ক করে দিয়ে বলেন, যুদ্ধবিরতি না হলে এবং গাজায় মানবিক সহায়তা অব্যাহতভাবে বাধাগ্রস্ত হলে ইউরোপ নিষেধাজ্ঞার প্রস্তুতি নিতে পারে।
এর আগে গত রোববার অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, পর্তুগাল ও যুক্তরাজ্য ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এর আগে আরও কয়েকটি দেশ একই ঘোষণা দিয়েছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ইসরাইল গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে। অবরুদ্ধ এই ভূখ-টিতে এখন পর্যন্ত ৬৫ হাজার ৩০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু।
এবার ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিল মোনাকো : ফিলিস্তিনকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে বিশ্বের আরও তিনটি দেশ। জাতিসংঘ অধিবেশনের প্রাক্কালে নিউইয়র্কে আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অ্যান্ডোরা, মোনাকো ও লুক্সেমবার্গ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে আনুষ্ঠানিক এই স্বীকৃতি দেয়। একই সম্মেলনে ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও মাল্টাও একই ঘোষণা দেয়। সংবাদমাধ্যমটি বলছে, জাতিসংঘ অধিবেশনের প্রাক্কালে নিউইয়র্কে আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে বেলজিয়াম, মাল্টা, অ্যান্ডোরা, মোনাকো ও লুক্সেমবার্গ। এর মাধ্যমে ফিলিস্তিন স্বীকৃতির ধারায় আরও ৫টি দেশ যুক্ত হলো।