ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডে ইসরাইলের বেআইনি কর্মকাণ্ডে ক্ষোভ জানিয়েছেন আয়ারল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট মাইকেল ডি. হিগিন্স। তিনি বলেছেন, গাজার পরিস্থিতি এখন এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছে যেখানে কোনও জবাবদিহিতা নেই। গতকাল সোমবার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা। জেরুসালেম পোস্ট, আনাদুলু, আল-জাজিরা
গত শনিবার আইরিশ টেলিভিশন আরটিই নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট হিগিন্স বলেন, “আমরা এক ধরনের জবাবদিহিতাহীন অবস্থায় আছি”। তিনি গাজার পরিস্থিতিকে বিশ্বের ইতিহাসের এক “বেদনাদায়ক সময়” বলেও উল্লেখ করেন।
হিগিন্স বলেন, এখন এমন এক অস্বাভাবিক মুহূর্ত চলছে যেখানে ইসরাইলী মন্ত্রিসভার সদস্যরা প্রকাশ্যে বেআইনি কাজের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছেন, কিন্তু আন্তর্জাতিক আইনকে একেবারেই পাত্তা দিচ্ছেন না। তিনি আরও বলেন, “পশ্চিম তীর ও গাজার মধ্যে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার যে প্রস্তাব উঠেছে, সেটিও আসলে জবাবদিহিতাহীনতার প্রতিফলন। এই অবস্থা গণতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি।”
প্রযুক্তির “অজবাবদিহিমূলক ভূমিকা” নিয়েও তিনি সতর্ক করে বলেন, এর মাধ্যমে পরিস্থিতি অস্ত্র প্রতিযোগিতার দিকে গড়াতে পারে, যেখানে মানবিক মূল্যবোধ একেবারেই অগ্রাহ্য হবে। হিগিন্স বলেন, “গাজায় যে গণহত্যা চলছে, তাকে দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত রাজনৈতিক সমস্যাগুলো থেকে মনোযোগ সরানোর অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা যায় না।”
তিনি মনে করিয়ে দেন, জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ‘চ্যাপ্টার সেভেন’ভুক্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন। এর মাধ্যমে নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন ছাড়াই প্রয়োজনে বলপ্রয়োগসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরাইলী হামলায় গাজায় ৬২ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনী নিহত হয়েছেন। এই সামরিক অভিযান পুরো অঞ্চলকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে এবং দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে।
গত বছরের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োয়াভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গাজায় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।
এছাড়া গাজায় যুদ্ধ চালানোর অভিযোগে ইসরাইল আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) গণহত্যার মামলার মুখোমুখি হয়েছে।
গাজা রক্ষায় জাতিসংঘ সেনা মোতায়েনের আহ্বান আইরিশ প্রেসিডেন্টের
বিধ্বস্ত গাজা উপত্যকায় নতুন করে হামলা ও দখল পরিকল্পনার পাশাপাশি অবৈধ বসতি স্থাপনের পথে হাঁটছে ইসরাইল। এমন পরিস্থিতিতে দখলদার বাহিনীর হাত থেকে উপত্যকাবাসীদের রক্ষায় জাতিসংঘের সেনা মোতায়েনের আহ্বান জানিয়েছেন আয়ারল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট মাইকেল ডি. হিগিনস। গত রোববার ইসরাইলী সংবাদমাধ্যম জানায়, শনিবার প্রেসিডেন্ট হিগিনস আয়ারল্যান্ডের সরকারি প্রচারমাধ্যম আরটিইকে এক সাক্ষাৎকারে এমন আহ্বান জানান। আইরিশ প্রেসিডেন্ট বলেন, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের উচিত বাহিনী গঠনের মাধ্যমে মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করা। তার মতে, আইন অনুসারে নিরাপত্তা পরিষদ ভেটো দিলেও জাতিসংঘের মহাসচিব নিজ দায়িত্বে সশস্ত্র সেনা পাঠাতে পারেন। তার ভাষ্য, ‘সাধারণ পরিষদের কমিটির একটি অংশও যদি সমর্থন দেয়, এমনকি নিরাপত্তা পরিষদ ভেটো দিলেও মহাসচিব মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করতে নিজেই সেনা মোতায়েন করতে পারেন।
গাজার হাসপাতালে ইসরাইলী হামলা ৪ সাংবাদিকসহ নিহত ২০
গাজার দক্ষিণাঞ্চলের একটি হাসপাতালে ইসরাইলী বাহিনীর হামলায় চারজন সাংবাদিকসহ অন্তত ২০ জন নিহত হয়েছেন। সোমবার ফিলিস্তিনী স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিহত সাংবাদিকদের মধ্যে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের চুক্তিভিত্তিক ক্যামেরাপারসন হুসাম আল-মাসরি আছেন। প্রথম দফার হামলাতেই তিনি নিহত হন। এরপর যখন উদ্ধারকর্মী, সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষ ঘটনাস্থলে ছুটে যান, তখনই দ্বিতীয় দফার হামলা চালানো হয়। এসময় মোহাম্মদ সালামা, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক মারিয়াম আবু দাকা এবং এনবিসির মুয়াজ আবু তাহা নিহত হন। এতে রয়টার্সের অপর চুক্তিভিত্তিক আলোকচিত্রী হাতেম খালেদ গুরুতর আহত হন। এছাড়া বেশ কয়েকজন উদ্ধারকর্মীও নিহত হন এই হামলায়।
ইসরাইলী সামরিক বাহিনী কিংবা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে এখনও কোনও মন্তব্য করা হয়নি।
ফিলিস্তিনী সাংবাদিক ইউনিয়ন এ হামলার নিন্দা জানিয়েছে। এক বিবৃতিতে তারা বলেছে, এটি মুক্ত সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে খোলাখুলি যুদ্ধ। সাংবাদিকদের আতঙ্কিত করে তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধা দিতেই ইসরাইল এ ধরনের হামলা চালাচ্ছে।
গাজার সরকারি গণমাধ্যম দপ্তর থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘নাসের হাসপাতালে আরও চারজন সাংবাদিক নিহত হওয়ায় গাজায় শহীদ সাংবাদিকের সংখ্যা ২৪৪ জনে দাঁড়িয়েছে।’
ইসরাইলী হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া এক সাংবাদিক আল জাজিরাকে জানিয়েছেন, দুই বছর ধরে চলা যুদ্ধের কারণে তারা বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট থেকে বঞ্চিত, তাই ফিলিস্তিনী সাংবাদিকরা খবর পাঠাতে হাসপাতালের এই পরিষেবাগুলো ব্যবহার করে আসছেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা সবসময় আহত ফিলিস্তিনীদের অনুসরণ করছি। জানাজা, দাফন থেকে শুরু করে অপুষ্টির ঘটনাগুলোও হাসপাতাল থেকেই জানতে পারছি ও প্রতিবেদন করছি আমরা।’
এই কারণেই ফিলিস্তিনী সাংবাদিকরা গাজার হাসপাতালগুলোকে তাদের শিবিরে পরিণত করেছিলেন। সেখানেই তাদের ওপর হামলা চালানো হল।
২০ দিনে গাজার এক হাজারের বেশি ভবন ধ্বংস করেছে ইসরাইল
গাজা শহরের জেইতুন এবং সাবরা এলাকায় এক হাজারেরও বেশি ভবন পুরোপুরি ধ্বংস করেছে ইসরাইল। যার ফলে শত শত মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়েছে।
গত ৬ আগস্ট থেকে শুরু করা হামলায় এসব ভবন ধ্বংস হয়েছে বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিনী সিভিল ডিফেন্স। গত রোববার সংস্থাটি এক বিবৃতিতে বলেছে, চলমান গোলাবর্ষণ এবং প্রবেশ পথ বন্ধ করে দেওয়ার কারণে অনেক উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
সিভিল ডিফেন্স জানিয়েছে, গাজা শহরে ইসরাইলী বাহিনীর ক্রমাগত অনুপ্রবেশ নিয়ে গভীর উদ্বেগ রয়েছে, এমন সময়ে যখন মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের চলমান ইসরাইলী আক্রমণের তীব্রতা মোকাবিলা করার ক্ষমতা নেই।
সংস্থাটি সতর্ক করে জানিয়েছে, গাজার কোথাও নিরাপদ এলাকা নেই— উত্তর থেকে দক্ষিণ— সবখানেই বেসামরিক মানুষকে লক্ষ্য করে ঘরবাড়ি, আশ্রয়কেন্দ্র এমনকি ত্রাণ শিবির পর্যন্ত বোমা বর্ষণ চলছে।
গাজা শহর পুরোপুরি দখলে নিতে ইসরাইলী সেনারা ট্যাংক নিয়ে সাবরা এলাকায় ঢুকে পড়েছে। এতে প্রায় ১০ লাখ ফিলিস্তিনীকে দক্ষিণ দিকে সরে যেতে বাধ্য করা হয়েছে।
সিভিল ডিফেন্সের এই তথ্য বহু মানুষের আশঙ্কা সত্যি করছে যে, ইসরাইল পুরো গাজা শহর ধ্বংস করতে চাইছে— যেমনটি তারা রাফাহ শহরে করেছিল।
অধিকারকর্মীরা বলছেন, এর লক্ষ্য হতে পারে গাজা থেকে সব ফিলিস্তিনীকে উৎখাত করা।
শহরের আল-জালাআ সড়কে একটি অ্যাপার্টমেন্টে হামলায় অন্তত তিনজন নিহত হয়েছেন, এর মধ্যে একজন শিশু রয়েছে বলে জরুরি ও অ্যাম্বুলেন্স বিভাগের একটি সূত্র জানিয়েছে।
এদিকে, গত ২৪ ঘণ্টায় গাজায় ইসরাইলী হামলায় একদিনে আরও ৫১ ফিলিস্তিনী নিহত হয়েছেন। একইদিনে গাজায় মানবিক সহায়তা নিতে গিয়ে প্রাণ হারান ২৪ জন। অন্যদিকে অনাহার ও অপুষ্টিতে মৃত্যু হয়েছে আরও ৮ জনের।
ইসরাইলী হামলায় ইয়েমেনে নিহত বেড়ে ৬
গাজায় চলমান যুদ্ধকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা বাড়ার মধ্যে ইসরাইলী সামরিক বাহিনী ইয়েমেনের রাজধানী সানায় বিমান হামলা চালিয়েছে। এ হামলায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৬ জনে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া আহত হয়েছেন ৮৬ জন।
ইসরাইল ও ইয়েমেনি কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা।
হুতি-সম্পর্কিত টেলিভিশন চ্যানেল আল মাসিরাহ জানিয়েছে, রোববারের (২৪ আগস্ট) এ হামলায় সানার একটি তেল স্থাপনা ও বিদ্যুৎকেন্দ্রকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়।
ইসরাইলী সেনাবাহিনী জানায়, তারা প্রেসিডেন্ট প্রাসাদকেও আঘাত করেছে, যা তাদের দাবি অনুযায়ী একটি “সামরিক কমপ্লেক্সের অংশ”।
ইসরাইলী সামরিক বাহিনী এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘হুথিদের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার জবাবে এই অভিযান পরিচালিত হয়েছে। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে তারা একাধিকবার ইসরাইলী ভূখ-ের দিকে ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ও ইউএভি (ড্রোন) পাঠিয়েছে।’
তবে হুতিদের দাবি, তাদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অধিকাংশ ইসরাইলী যুদ্ধবিমানকে প্রতিহত করেছে এবং পিছু হটতে বাধ্য করেছে। আল জাজিরা যাচাইকৃত ভিডিওতে সানার আকাশে ধোঁয়া ও আগুনের লেলিহান শিখা উঠতে দেখা গেছে।
হুতি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আল-বুখাইতি বলেন, ইসরাইলের আগ্রাসন আমাদের গাজার পক্ষে অবস্থান থেকে বিরত রাখতে পারবে না। আমাদের জন্য বিষয়টি স্পষ্ট: হয় জান্নাতে অনন্তকাল, নয়তো জাহান্নামে অনন্তকাল।
এদিকে ইসরাইলী হামলার মধ্যেও গাজার প্রতি সংহতি জানিয়ে নিজেদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন শীর্ষস্থানীয় হুথি নেতা আবদুল কাদির আল-মুরতাদা। তিনি বলেছেন, হুথিরা গাজার মানুষের প্রতি সংহতি জানাতে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখবে।