ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় ইসরাইলী হামলায় একদিনে আরও ৯১ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ৪৮ জনই গাজা সিটির বাসিন্দা। যার মধ্যে ছয়জন ত্রাণ নেওয়ার সময় নিহত হন। দখলদার ইসরাইল মধ্য গাজার সারায়া এলাকায় বেসামরিক মানুষের ওপর বোমাবর্ষণ করেছে করেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে প্রতিদিন প্রায় ১০০ মানুষ নিহত হলেও থামছে না আগ্রাসন। এরইমধ্যে ইসরাইলী প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাটজ হুমকি দিয়েছেন, সব লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত গাজায় তারা যুদ্ধ থামাবেন না। এছাড়া তিনি গাজায় বর্বরতা বাড়ানোর হুমকিও দিয়েছেন। ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার যুদ্ধ বন্ধে গত বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে বসেন ৮ মুসলিম দেশের নেতারা। ওই সময় ট্রাম্প তাদের কাছে ২১ দফার প্রস্তাব পেশ করেন। বৈঠক শেষে একাধিক মুসলিম নেতা জানান, ট্রাম্পের সঙ্গে তাদের ভালো আলোচনা হয়েছে। আগামী কাল সোমবার ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বৈঠক হবে। ওই সময় জানা যাবে, এ চুক্তিটি ইসরাইল মানবে কি না। গতকাল নেতানিয়াহু জাতিসংঘের ভাষণে জানান, গাজায় তারা হামলা অব্যাহত রাখবেন। অপরদিকে ট্রাম্প সাংবাদিকদের জানান, তারা হয়ত যুদ্ধবিরতি চুক্তির দ্বারপ্রান্তে আছেন। আল-জাজিরা, দ্য টাইমস অব ইসরাইল, আনাদুলো এজেন্সি, মেহের।
জাতিসংঘে নেতানিয়াহুর ভাষণ বর্জন
যা বললেন খামেনি
জাতিসংঘে ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ভাষণ বর্জনের ঘটনায় মুখ খুলেছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। তার মতে, এর মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে বিশ্বজুড়ে একঘরে হয়ে পড়েছে ইসরাইল। তিনি বলেন, ‘আজ দুষ্ট জায়নিস্ট শাসনব্যবস্থাই পৃথিবীর সবচেয়ে ঘৃণিত ও নিঃসঙ্গ শাসনব্যবস্থা।’ গত শুক্রবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে নেতানিয়াহুর ভাষণের সময় শতাধিক কূটনীতিক সভাকক্ষ ত্যাগ করেন। এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেতানিয়াহুর একটি ছবি প্রকাশ করে খামেনি লিখেছেন, ‘শয়তান জায়নিস্ট রেজিম এখন পৃথিবীর সবচেয়ে ঘৃণিত ও বিচ্ছিন্ন শক্তি।’ নেতানিয়াহুর বক্তব্য শুরু হওয়ার আগেই বহু দেশের প্রতিনিধি সভাকক্ষ ছেড়ে যান।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ইসরাইলের গণহত্যামূলক অভিযান শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত দুই লাখ ৩৮ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনী নিহত, আহত বা নিখোঁজ হয়েছেন। সম্প্রতি ফাঁস হওয়া ইসরাইলী সামরিক গোয়েন্দা তথ্যেও দেখা গেছে, চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত গাজায় নিহতদের ৮০ শতাংশের বেশি ছিলেন সাধারণ নাগরিক। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে গাজার প্রায় সব আবাসিক এলাকা, বিদ্যালয় ও হাসপাতাল। যুদ্ধের কারণে প্রায় পুরো জনগোষ্ঠী অন্তত একবার হলেও গৃহহীন হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে সামাজিকমাধ্যম ব্যবহার
প্রভাব বিস্তার করছে ইসরাইল
ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু শুক্রবার স্বীকার করেছেন যে তার সরকার সামাজিক মাধ্যমকে একটি ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করছে যুক্তরাষ্ট্রে দেশটির রাইট-উইং রাজনৈতিক ঘরানার সমর্থন নিশ্চিত করার জন্য। নিউ ইয়র্কে ইসরাইলের কনস্যুলেট জেনারেলে মার্কিন ইনফ্লুয়েন্সারদের সঙ্গে বৈঠকে নেতানিয়াহু বলেন, সামাজিক মাধ্যম ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র আমাদের ভিত্তি নিশ্চিত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে।’ এই সাক্ষাৎকারের ভিডিও ইনফ্লুয়েন্সার দেব্রা লিয়ার এক্স অ্যাকাউন্টে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি টিকটককে উল্লেখ করে বলেন, ‘এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘ক্রয়’ হচ্ছে যার নিয়ন্ত্রণ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে।’ এছাড়া তিনি এক্স (সাবেক টুইটার)-এর কথাও উল্লেখ করেছেন, ‘আমরা এলন মাস্কের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তিনি শত্রু নয়, বন্ধু।’ নেতানিয়াহু দাবি করেছেন, টিকটক ও এক্স-এর ওপর প্রভাব অর্জন করা গেলে, ইসরাইল অনেক সুবিধা পাবে।
এরপরের দিনে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেন, যা নিশ্চিত করে যে টিকটকের মার্কিন কার্যক্রম একটি আমেরিকান কনসোর্টিয়ামের কাছে হস্তান্তরের চুক্তি জাতীয় নিরাপত্তা অনুযায়ী অনুমোদিত। কনসোর্টিয়ামে থাকবেন টেক কোম্পানি ওরাকল, মাইকেল ডেল, রুপার্ট মারডক ও অন্যান্য।
বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, ওরাকলের প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি এলিসনের দীর্ঘদিনের ইসরাইল সমর্থন টিকটকের ওপর কোম্পানির ক্ষমতা ইসরাইলী সরকারের স্বার্থে ব্যবহার হতে পারে। নেতানিয়াহুর এই মন্তব্য আসে এমন সময়ে, যখন গাজায় ইসরাইলের গণহত্যা যুদ্ধের কারণে দেশটি ক্রমশ আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। অক্টোবর ২০২৩ থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৬৫,৬০০ ফিলিস্তিনী নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে অধিকাংশই নারী ও শিশু। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে নেতানিয়াহু প্রায় খালি হলে বক্তব্য দেন, কারণ বহু দেশের প্রতিনিধি ইসরাইলের গাজা অভিযান প্রতিবাদে সভাকক্ষ ত্যাগ করেছেন।
ইরানের দাবি
ইসরাইলের ১৬ পাইলট নিহত
ইরানের সঙ্গে ১২ দিনের যুদ্ধের ইসরাইলের ১৬ জনেরও বেশি পাইলট নিহত হয়েছেন বলে দাবি করেছেন দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির জ্যেষ্ঠ সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল ইয়াহিয়া রাহিম-সাফাভি। মেজর জেনারেল ইয়াহিয়া রাহিম-সাফাভি এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘যুদ্ধের প্রথম দিকে ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ও গোয়েন্দা ব্যবস্থায় কিছু দুর্বলতা প্রকাশ পেলেও সেগুলো এখন মেরামত ও পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় রয়েছে।’ তিনি ব্যাখ্যা করেন, যুদ্ধের প্রথম দুই থেকে তিন দিনে কিছু ঘাটতি দেখা গেলেও চতুর্থ দিন থেকে পরিস্থিতির মোড় ঘুরে যায় এবং শেষ পর্যায়ে এসে ইরান পূর্ণ আধিপত্য কায়েম করে। বিদেশি মূল্যায়ন অনুসারে, প্রায় ৬০ শতাংশ পর্যবেক্ষক ইরানকেই এ যুদ্ধে বিজয়ী হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
তিনি বলেন, ‘প্রথম দুই থেকে তিন দিনে দুর্বলতা ছিল, কিন্তু চতুর্থ দিন থেকে ভারসাম্য পাল্টে যায় এবং শেষ দিনগুলোতে বিজয় ছিল আমাদের।’ তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘ইসরাইল তাদের ঘোষিত কোনো লক্ষ্যই অর্জন করতে পারেনিÍ না ইরানের ভেতরে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে, না গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ও সামরিক ও পারমাণবিক সক্ষমতা ধ্বংস করতে;বরং ইরান তার উদ্দেশ্য পূরণে সফল হয়েছে।’ তিনি জানান, শত্রুর কমান্ড ও কন্ট্রোল সেন্টার, বিদ্যুৎকেন্দ্র ও টার্মিনালে হামলা চালানো হয়, যা তাদেরকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে। তিনি আরও দাবি করেন, অভিযানে ‘১৬ জনেরও বেশি ইসরাইলী পাইলট নিহত হয়েছে। ‘
সাফাভি আরও ঘোষণা করেন, অভিযানে শত্রুপক্ষ ৬০০Ñ৬৪০টিরও বেশি আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে, ফলে তারা ব্যপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ইরান বর্তমানে মহাকাশ ও বিমান প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম পুনর্গঠন করছে এবং শক্তি বাড়াচ্ছে। আকাশ প্রতিরক্ষা, রাডার সিস্টেম, ক্ষেপণাস্ত্র অস্ত্র ও বিমানবাহিনীর কিছু ইউনিট ক্ষতিগ্রস্ত হলেও নতুন কমান্ডার নিয়োগ ও পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সক্ষমতা দ্রুত পুনরুদ্ধার করা হচ্ছে। তিনি ঘোষণা দেন, ইরান কেবল তার সামরিক ক্ষমতা পুনরুদ্ধারই করবে না, বরং আকাশ, মহাকাশসহ সবক্ষেত্রে আক্রমণাত্মক শক্তি আরও বৃদ্ধি করবে।
সতর্ক করে তিনি বলেন, যদি আবারও শত্রুপক্ষ কোনো আগ্রাসী পদক্ষেপ নেয়, তবে তেহরান আগের চেয়েও অনেক বেশি শক্তি নিয়ে জবাব দেবে। গত ১৩ জুন বিনা উসকানিতে ইরানে হামলা চালায় ইসরাইল,যা ১২ দিনের যুদ্ধে রূপ নেয়। এ যুদ্ধে অন্তত এক হাজার ৬৪ জন নিহত হন, যাদের মধ্যে ছিলেন সামরিক কমান্ডার, পারমাণবিক বিজ্ঞানী ও সাধারণ মানুষ। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়। ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের হামলার জবাবে ইরানি সশস্ত্র বাহিনী তেল আবিবের কৌশলগত স্থাপনায় হামলা চালায় এবং পশ্চিম এশিয়ার সবচেয়ে বড় মার্কিন সামরিক ঘাঁটি কাতারের ‘আল-উদেইদ’ ঘাঁটিকেও লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ২৪ জুন উভয় দেশের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়।