ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় ত্রাণ প্রবেশের জন্য বিশেষ যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা চালিয়েছে যুদ্ধবাজ ইসরাইল। এতে কমপকক্ষে ৬৩ জন নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে ৩৪ জন ছিলেন ত্রাণপ্রার্থী। আল জাজিরা, রয়টার্স, বিবিসি, এএফপি।

গত রোববার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানায় সংবাদমাধ্যম ।

এর আগে, গাজার তিনটি এলাকায় প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সামরিক অভিযান স্থগিত রাখার ঘোষণা দেয় ইসরাইলী সেনাবাহিনী। মানবিক সহায়তার কাজ আরও সহজ করতেই এই বিরতি দেওয়া হয় বলে জানায় তারা। এখন থেকে সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে এবং পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত তা প্রতিদিন চালু থাকবে।

এদিন বার্তসংস্থা রয়টার্স জানায়, চলমান যুদ্ধের মধ্যে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে অবশেষে গাজার কিছু অংশে সামরিক অভিযান সাময়িকভাবে স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে ইসরাইল। একইসঙ্গে নতুন ত্রাণ করিডোর চালুর কথাও জানিয়েছে তারা।

রোববার ইসরাইলী সেনাবাহিনী জানায়, প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত গাজার আল-মাওয়াসি, দেইর আল-বালাহ এবং গাজা সিটি এলাকায় তারা সামরিক অভিযান বন্ধ রাখবে। এই এলাকায় মার্চ মাস থেকে নতুন করে স্থল অভিযান শুরু হয়নি।

সেনাবাহিনী আরও জানায়, প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত খাবার ও ওষুধবাহী গাড়িবহরের জন্য নির্ধারিত নিরাপদ পথও চালু থাকবে।

এদিকে মিশরের রাষ্ট্রায়ত্ত আল-কাহেরা নিউজ টিভি জানায়, রোববার থেকে মিসর সীমান্ত দিয়ে গাজার উদ্দেশে ত্রাণ পরিবহন শুরু হয়েছে। এর আগে, ইসরাইল বিমান থেকে ত্রাণ ফেলাও শুরু করে বলে জানায়, যা তারা গাজার মানবিক পরিস্থিতি কিছুটা সহজ করতে নেওয়া উদ্যোগ হিসেবে উল্লেখ করেছে তারা।

এর আগে গত বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ জানায়, গাজায় মানবিক বিরতি ঘোষণার ফলে ত্রাণ সরবরাহের পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব হবে। তবে তারা অভিযোগ করে, ইসরাইল তাদের গাড়িবহরের জন্য যথেষ্ট বিকল্প রুট দিচ্ছে না, যা ত্রাণ কার্যক্রম ব্যাহত করছে।

গাজায় একদিনে অনাহারে প্রাণ গেল ১৪ ফিলিস্তিনির

ইসরাইলের টানা অবরোধের ফলে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় গত ২৪ ঘণ্টায় আরও অন্তত ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে দুই শিশুও রয়েছে বলে সোমবার জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। খবর আনাদোলু এজেন্সির।

এক বিবৃতিতে মন্ত্রণালয় জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় গাজার বিভিন্ন হাসপাতালে অনাহার ও অপুষ্টিজনিত কারণে নতুন করে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে দুজন শিশু ক্ষুধায় মারা গেছে।

এ সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত গাজায় অনাহারে মারা যাওয়াদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪৭ জনে, যার মধ্যে ৮৮ জনই শিশু।

প্রসঙ্গত, ইসরাইল গত ১৮ বছর ধরে গাজা উপত্যকার ওপর অবরোধ আরোপ করে রেখেছে। চলতি বছরের ২ মার্চ থেকে তারা গাজার সব সীমান্তপথ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দিয়েছে, যা মানবিক পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যুদ্ধবিরতির আহ্বান উপেক্ষা করে ইসরাইল ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ভয়াবহ সামরিক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৬০ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু।

টানা বোমাবর্ষণ এবং অবরোধে গাজার অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে এবং খাবার, পানি ও ওষুধের মারাত্মক সংকট তৈরি হয়েছে।

২০২৩ সালের নবেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) গাজায় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে।

এছাড়াও গাজায় গণহত্যার অভিযোগে ইসরাইল বর্তমানে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) বিচারের মুখোমুখি রয়েছে।

গাজায় অপুষ্টি উদ্বেগজনক পর্যায়ে সতর্ক করল ডব্লিউএইচও

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) সতর্ক করে বলেছে, ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় অপুষ্টির মাত্রা উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা বিপজ্জনক গতিপথে রয়েছে।

দীর্ঘ বিরতির পর গাজায় উড়োজাহাজ থেকে ত্রাণসামগ্রী ফেলার কার্যক্রম আবার শুরুর পর ডব্লিউএইচওর কাছ থেকে এ সতর্কবার্তা এল।

গতকাল রোববার জর্ডান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত গাজায় উড়োজাহাজ থেকে ত্রাণসামগ্রী ফেলে। এর আগে ইসরাইল জানায়, তারা গাজার কিছু অংশে প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা করে যুদ্ধ বন্ধ রাখবে। যাকে তারা বলছে, ‘ কৌশলগত বিরতি’। এ বিরতির আওতায় জাতিসংঘের ত্রাণবহরের জন্য করিডর তৈরি করে দেওয়ার কথাও জানায় তারা।

অবরুদ্ধ গাজায় ত্রাণসহায়তা প্রবেশ করতে না দেওয়া নিয়ে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে তীব্র আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়ে ইসরাইল। এর মধ্যে গাজায় চরম খাদ্যসংকট ও অনাহারের ঘটনা নিয়ে একের পর এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হতে থাকে। এ চাপে পড়ে ইসরাইল এখন কিছুটা নমনীয় হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) বলেছে, গাজার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ কয়েক দিন ধরে না খেয়ে দিন পার করছে। আর প্রতি চারজনের একজন দুর্ভিক্ষসদৃশ পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে।

যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি বলেছেন, উড়োজাহাজ থেকে ত্রাণ ফেলা চরম দুর্ভোগ লাঘবে সহায়ক হবে। তবে গাজায় ত্রাণসহায়তা পাঠানোর একমাত্র কার্যকর ও টেকসই উপায় হলো স্থলপথ।

গাজায় যুদ্ধ বন্ধে আন্তর্জাতিক চাপ আরও বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক। তিনি বলেছেন, প্রতিদিন গাজায় আরও ধ্বংস, আরও হত্যাকা- ও ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে আরও অমানবিকতা চলছে।

এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, তাঁর প্রশাসন গাজায় আরও ত্রাণ পাঠাবে। তবে তিনি এ কথাও বলেন, এটি একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা, যুক্তরাষ্ট্রের সমস্যা নয়।

অনাহারে গাজাবাসীদের মৃত্যু রোধে অবিলম্বে পদক্ষেপের আহ্বান ওবামার

ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় চলমান মানবিক সংকটের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। স্থানীয় সময় সোমবার এক্স-এ (সাবেক টুইটার) দেওয়া একটি পোস্টে তিনি ‘প্রতিরোধযোগ্য’ দুর্ভিক্ষ বন্ধে অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান।

একটি মার্কিন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে ওবামা লেখেন, যদিও গাজা সংকটের স্থায়ী সমাধানের জন্য সব জিম্মিদের মুক্তি এবং ইসরাইলি সামরিক অভিযান বন্ধ করা আবশ্যক, এই নিবন্ধগুলো নিরীহ মানুষের মৃত্যু রোধে অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তাকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে।

তিনি আরও বলেন, গাজা উপত্যকার মানুষের কাছে মানবিক সহায়তা পৌঁছাতে দিতে হবে। বেসামরিক মানুষদের কাছ থেকে খাবার ও পানি দূরে রাখার কোনও যুক্তি থাকতে পারে না।

এর আগে, রবিবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানায়, গাজায় অপুষ্টির হার ‘উদ্বেগজনক পর্যায়ে’ পৌঁছেছে। সংস্থাটি বলেছে, সহায়তার ‘ইচ্ছাকৃত অবরোধ’ সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধযোগ্য ছিল এবং এর ফলে বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

২০২৫ সালের মধ্যে অপুষ্টিজনিত মৃত্যুর সংখ্যা ৭৪ জনে পৌঁছেছে, যার মধ্যে শুধুমাত্র জুলাই মাসেই মারা গেছে ৬৩ জন। এর মধ্যে রয়েছে পাঁচ বছরের কম বয়সি ২৪ শিশু, একজন বড় শিশু এবং ৩৮ জন প্রাপ্তবয়স্ক।

ডব্লিউএইচও আরও জানায়, গাজায় প্রতি পাঁচজন শিশুর মধ্যে একজন এখন তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে। জুনের তুলনায় চার থেকে ছয় বছর বয়সি শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির হার তিনগুণ বেড়েছে।

গাজায় চলমান সামরিক অভিযান ও মানবিক অবরোধের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বেগ বাড়ছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, খাদ্য, পানি ও ওষুধের প্রবেশে বাধা তৈরি করে ফিলিস্তিনিদের ‘ধীরে ধীরে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে’, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘনের শামিল।