ইসরইলী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ‘সিদ্ধান্তমূলক পর্যায়ে’ পৌঁছানোর ঘোষণার পর গাজায় হামলা আরও জোরদার হয়েছে। দখলদার বাহিনীর আগ্রাসনে গত মঙ্গলবার সারাদিনে অন্তত ১০৫ ফিলিস্তিনী নিহত হয়েছেন। আল জাজিরার, মেহের।
কাতারভিত্তিক গণমাধ্যমটি জানিয়েছে, ইসরাইল গাজার সবচেয়ে বড় নগরকেন্দ্রটির (গাজা সিটি) নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছে। যেখানে প্রায় ১০ লাখ মানুষ বসবাস করেন। এ কারণে আরও বর্বর হয়ে উঠেছে জায়নিস্ট বাহিনী। গত মঙ্গলবার একদিনেই গাজা জুড়ে অন্তত ১০৫ জন ফিলিস্তিনী নিহত হয়েছেন। বিশেষ করে আল-সাবরা এলাকায় ইর্সইলী হামলা ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল ধ্বংস করে দিয়েছে। নিহতদের মধ্যে অন্তত ৩২ জন ত্রাণ সহায়তার খোঁজে গিয়ে প্রাণ হারান। যার মধ্যে সাতজন শিশু। তারা সবাই দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসের নিকটবর্তী আল-মাওয়াসি এলাকায় পানির লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় ইর্সইলী ড্রোন হামলায় প্রাণ হারান।
আল জাজিরার সাংবাদিক হিন্দ খুদারি বলেন, ‘ফিলিস্তিনীরা এখন গাজা সিটিতে যেন খাঁচার ভেতরে বন্দি। তারা যতটা সম্ভব বিমান হামলা থেকে বাঁচতে চেষ্টা করছে। কিন্তু যেখানে যাচ্ছে, হামলা তাদের অনুসরণ করছে। খাদ্য ও সাহায্যের অবরোধে তারাও মারা যাচ্ছে, কারণ তারা ন্যূনতম বেঁচে থাকার উপকরণও পাচ্ছে না।’ এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় অন্তত ১৩ জন অনাহারে মারা গেছেন। এতে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ক্ষুধাজনিত মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৬১। এর মধ্যে ৮৩ জন মারা গেছেন ২২ আগস্ট গাজায় দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি নিশ্চিত হওয়ার পর থেকে। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গত এক মাসে গাজায় প্রবেশ করা মানবিক সহায়তার ট্রাক সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় মাত্র ১৫ শতাংশ। তবু ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু আগস্টে জাতিসংঘ সমর্থিত খাদ্য নিরাপত্তা মূল্যায়ন সংস্থার (আইপিসি) দুর্ভিক্ষ সংক্রান্ত প্রতিবেদনের সত্যতা অস্বীকার করে একে ‘পুরোপুরি মিথ্যা’ বলে দাবি করেন।
গাজায় কৃত্রিম দুর্ভিক্ষে আরও ১৩ মৃত্যু
গাজায় কৃত্রিম দুর্ভিক্ষে মৃত্যু বাড়ছে। বিশেষ করে বোমা হামলা বা অসুস্থতার কারণে যারা অচল হয়ে পড়েছেন, তারা ত্রাণ সংগ্রহে যেতে না পেরে অবধারিতভাবে মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছেন। এই কাতারে অন্তঃসত্ত্বা ও বয়স্করাও রয়েছেন। ত্রাণকেন্দ্রে গেলে সেখানেও বেছে বেছে হত্যা করা হচ্ছে। এ অবস্থায় গতকাল মঙ্গলবার এক দিনে অনাহার-অপুষ্টিতে তিন শিশুসহ আরও ১৩ জনের প্রাণ গেছে। গত আগস্ট মাসে সব মিলিয়ে না খেয়ে মারা গেছেন ১৮৫ জন। গত ২৭ মের পর এ পর্যন্ত এ ধরনের মৃতের সংখ্যা ৩৬১ জন, যার মধ্যে ১৩০ শিশু রয়েছে।
ত্রাণবাহী গাড়ির প্রবেশ করতে না দেওয়া ও সরবরাহে বাধা দেওয়ায় গাজায় পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত খারাপের দিকে যাচ্ছে। গতকাল মঙ্গলবার আলজাজিরা জানায়, দুর্ভিক্ষের পাশাপাশি গাজায় ব্যাপক হামলাও চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। এতে গতকাল এক দিনে আরও ৬৩ জন নিহত হয়েছেন। হতাহতদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। তাদের মধ্যে অন্তঃসত্ত্বা নারীও রয়েছেন। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, উপত্যকায় পাঁচ বছরের কম বয়সী ৪৩ হাজার শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে। ৫৫ হাজারের বেশি অন্তঃসত্ত্বা ও স্তন্যদানকারী নারীও আছেন, যারা চরম অপুষ্টিতে ভুগছেন। দুই-তৃতীয়াংশ অন্তঃসত্ত্বা নারী রক্তাল্পতায় ভুগছেন। মা ও নবজাতকরা সবচেয়ে বেশি অপুষ্টির ঝুঁকিতে।
২০২৩ সালে ৭ অক্টোবর গাজায় ইসরাইলের গণহত্যা শুরু হলে এ পর্যন্ত ৬৩ হাজার ৫৫৭ জন নিহত হন। আহতের সংখ্যা এক লাখ ৬০ হাজার ৬৬০। জাতিসংঘ সমর্থিত খাদ্য নিরাপত্তা মূল্যায়নবিষয়ক সংস্থা আইপিসি গত ২২ আগস্ট ঘোষণা করে, গাজা উপত্যকায় পাঁচ লাখ ১৪ হাজার মানুষ দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি। সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ এ সংখ্যা বেড়ে ছয় লাখ ৪১ হাজারে পৌঁছাবে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করা হয়।
গত ২৩ মাস ধরে চলা যুদ্ধে ইসরাইল গাজার মানুষের চিকিৎসা সুবিধা, স্কুল, অবকাঠামোসহ প্রায় সবকিছু ধ্বংস করেছে। সেই সঙ্গে উপত্যকায় সহায়তার প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছে; খাবার নিতে আসা ফিলিস্তিনীদের লক্ষ্যবস্তু করে হত্যা করা হচ্ছে।
‘গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে ইসরাইল’ : বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় গণহত্যা বিশেষজ্ঞদের সংগঠন ঘোষণা করেছে, গাজায় ইসরাইল গণহত্যা চালাচ্ছে। গতকাল মঙ্গলবার বিবিসি জানায়, আন্তর্জাতিক গণহত্যা বিশেষজ্ঞদের সংগঠন আইএজিএস গৃহীত এক প্রস্তাবে বলা হয়, ইসরাইলের আচরণ জাতিসংঘের গণহত্যা-সংক্রান্ত কনভেনশনে বর্ণিত আইনি সংজ্ঞা পূরণ করে। তিন পৃষ্ঠার প্রস্তাবে আইএজিএস গাজায় ইসরাইলের পদক্ষেপের তালিকা তুলে ধরা হয়, যেখানে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
আইএজিএস হলো বিশ্বের বৃহত্তম পেশাদার গণহত্যা বিশেষজ্ঞদের সংগঠন। এতে বেশ কয়েকজন হলোকাস্ট বিশেষজ্ঞও অন্তর্ভুক্ত আছেন। এর ৫০০ সদস্যের মধ্যে ২৮ শতাংশ ভোটে অংশ নিয়েছিলেন। যারা ভোট দিয়েছিলেন তাদের ৮৬ শতাংশ এ প্রস্তাবকে সমর্থন করেন। ইসরাইলের নীতি ও কর্মকা-ের সংক্ষিপ্তসার, ঘোষণাপত্রে স্বাস্থ্যসেবা, সাহায্য, শিক্ষা খাতসহ বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় কর্মী ও সুযোগ-সুবিধা উভয়ের ওপর ব্যাপক হামলার কথা এতে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রস্তাবে ইউনিসেফের তুলে ধরা ইসরাইলের হাতে গাজার ৫০ হাজার শিশু হতাহত হওয়ার বিষয়টিও রয়েছে।
ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেবে বেলজিয়াম: বেলজিয়ামের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ম্যাক্সিম প্রিভোট চলতি সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার এক্সে প্রিভোট লেখেন, ‘জাতিসংঘের অধিবেশনে বেলজিয়াম ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেবে। সেই সঙ্গে ইসরাইল সরকারের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে।’ এএফপির খবরে বলা হয়, গাজায় সংঘটিত ‘মানবিক ট্র্যাজেডির’ পরিপ্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রিভোট।
এর আগে গত জুলাইয়ে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ বলেন, ফ্রান্স ৯ সেপ্টেম্বর থেকে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিতব্য জাতিসংঘের অধিবেশনে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেবে। পরে এক ডজনেরও বেশি পশ্চিমা দেশ ফিলিস্তিনের সমর্থনে এগিয়ে আসতে শুরু করে। যুক্তরাজ্যও ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা ভাবছে। এমনটা হলে ইসরাইলের একমাত্র সমর্থক দেশ হিসেবে অবশিষ্ট থাকবে কেবল যুক্তরাষ্ট্র।
হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রে থেমে গেল
ইসরইলী বিমানবন্দরের প্রাণচাঞ্চল্য
ইয়েমেন থেকে ছোড়া একটি হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে দখলদার ইসরাইলের বেন গুরিয়ন বিমানবন্দরের ফ্লাইট কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। ইসরাইলের হিব্রু ভাষার গণমাধ্যম ইয়েদিওথ আহরোনোথ জানিয়েছে, ইয়েমেন থেকে দখলকৃত ফিলিস্তিন ভূখ-ের দিকে একটি হাইপারসনিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়। এ হামলার পর অধিকৃত ফিলিস্তিনের বেশ কিছু এলাকায় সাইরেন বেজে ওঠে। খবরে আরও বলা হয়, এমন প্রেক্ষাপটে রাজধানী তেলআবিবের বেন গুরিয়ন বিমানবন্দরের আকাশসীমা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে বন্ধ করে দিয়েছে ইর্সইলী কর্তৃপক্ষ। এদিকে হামলার বিষয়টি নিশ্চিত করে ইয়েমেনি সশস্ত্র বাহিনী বুধবার জানিয়েছে, তারা ইর্সইলী লক্ষ্যবস্তুতে দুটি ভিন্ন ধরণের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে হামলা চালিয়েছে। ইয়েমেনি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইয়াহিয়া সারি এক বিবৃতিতে জানান, এই অভিযানে একটি প্যালেস্টাইন–২ ক্লাস্টার ক্ষেপণাস্ত্র এবং একটি জুলফিকার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে তেলআবিবের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা চালানো হয়েছে।
তার ভাষ্যমতে, এ হামলার ফলে ‘লক্ষ লক্ষ বসতি স্থাপনকারী’ আশ্রয়কেন্দ্রে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে এবং বেন গুরিয়ন বিমানবন্দরে বিমান চলাচল স্থগিত হয়ে গেছে। ইয়েমেনি মুখপাত্র আরও জানান, এ অভিযানটি গাজার ফিলিস্তিনী জনগণের সমর্থনে এবং ইয়েমেনের বিরুদ্ধে ইর্সইলী আগ্রাসনের অন্যতম জবাব হিসেবে পরিচালিত হয়েছে। পাশাপাশি ‘দখলদার ও যুদ্ধবাজ জায়নিস্ট শাসনকে কখনো নিরাপত্তা ও শান্তি ভোগ করতে দেওয়া হবে না’ বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন ইয়াহিয়া সারি। তিনি সতর্কবার্তা দিয়ে বলেন, ইয়েমেনি অভিযানের মাত্রা পরবর্তী পর্যায়ে আরও তীব্র হবে।
এর আগে, সোমবার দেওয়া এক বিবৃতিতে ইয়েমেনি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইয়াহিয়া সারি বলেন, সানার ওপর সাম্প্রতিক ইর্সইলী আগ্রাসনের পর তাদের সশস্ত্র বাহিনী চারটি ড্রোন ব্যবহার করে ইর্সইলী লক্ষ্যবস্তুর ওপর চারটি সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছে। তার ভাষায়, ‘আমরা ইর্সইলী শাসনের লক্ষ্যবস্তুর ওপর চারটি ড্রোন দিয়ে চারটি সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছি। এর মধ্যে অধিকৃত জাফায় (তেলআবিব) শত্রুর জয়েন্ট স্টাফ ভবনকে একটি সামাদ–৪ ড্রোন দিয়ে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে। এছাড়া হাদেরা বিদ্যুৎকেন্দ্র, আল-লাদ বিমানবন্দর (বেন গুরিয়ন) এবং অশদোদ বন্দরকে আরও তিনটি ড্রোন দিয়ে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে’।
সারি বলেন, ‘এই ড্রোন অভিযান আল্লাহর কৃপায় সফলভাবে তার লক্ষ্য অর্জন করেছে’। তিনি আরও জানান, ‘উত্তর লোহিত সাগরে এমএসসি এবাই (গঝঈ অইণ) নামের একটি জাহাজকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে। জাহাজটি অধিকৃত ফিলিস্তিনের বন্দরগুলোতে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ভেঙেছিল এবং ইর্সইলী শাসনের সঙ্গে এর সম্পর্ক ছিল। আমরা এই জাহাজে দুটি ড্রোন এবং একটি ক্রুজ মিসাইল নিক্ষেপ করেছি, যা আল্লাহর কৃপায় যথাযথভাবে লক্ষ্যভেদ করেছে’।
বিবৃতির শেষে সারি জোর দিয়ে বলেন, ‘গাজায় আমাদের ভাইদের সহায়তার জন্য এসব অভিযান অব্যাহত থাকবে, যতক্ষণ না তাদের ওপর হামলা বন্ধ হয় এবং গাজার অবরোধ সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার করা হয়’। উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ফিলিস্তিনীদের ওপর ধ্বংসাত্মক আগ্রাসন ও অবরোধ চাপিয়ে দিলে ইয়েমেনিরা প্রকাশ্যে ফিলিস্তিনের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করে এবং একের পর এক হামলা অব্যাহত রেখেছে। পালটা হিসেবে সানাসহ ইয়েমেনে বিরুদ্ধেও ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়ে আসছে ইসরাইল। এতে এখন পর্যন্ত বহু সংখ্যক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।